তুমি ঢাকা ময়মনসিংহ দৌড়োদৌড়ি করো, বাসে করো, তুমি যে ময়মনসিংহে গিয়ে এর বাড়ি ওর বাড়ি যাও, রিক্সায় যাও। কোনওদিন গাড়ি চড়োনি। না মা, তুমি চড়োনি। তুমি তো ভালো আছো। তুমি চড়বে কেন। কিন্তু ভালো থাকা তুমি একদিন শুনি আমাকে দেখতে সুইডেনে আসবে। শরীরটা নাকি ভালো নেই। শরীর ভালো না থাকার কথা বলা তোমার নতুন নয়। ও আমাকে মোটেও উদ্বিগ্ন করে না। ছোটদাকে ঘন ঘন ফোন করি, বাবাকে আসতে বলো। ছোটদা জানালো, বাবা আসতে চাইছে না, মা আসবে। আমার সাফ কথা, মা যখন আসতে চাইছে আসুক, সবচেয়ে ভালো হয় বাবা এলে। কারণ বাবা তো অসুস্থ। এ সময় তার পা থেকে মাথা পর্যন্ত বিদেশ থেকেপরীক্ষা করিয়ে নেবো, অসুখ বিসুখ থাকলে বিদেশেই চিকিৎসাটা হবে। বাবা আসবে না, কারণ তার কাজের চাপ। অবসরপ্রাপ্ত ডাক্তার, তার কী এমন কাজ যে মেয়েকে দেখতে আসতে পারবে না! খুব মন খারাপ হয়ে যায়। বাবাকেই বেশি চাই দেখতে। তোমার আসায় না আসায়, সত্যি বলছি, কিছু যায় আসে না আমার।
বাবাকে রাজি করাতে না পেরে ছোটদা আমাকে জানিয়ে দিল তুমি একা আসছে। বিমানে চাকরি করার কারণে নিজের বাবা মার জন্য ছোট দা ফ্রি টিকিট পায়, সেই টিকিট ব্যবহার করে ব্রাসেলস অবধি তোমাকে আনতে তার কোনও অসুবিধে নেই। ব্রাসেলস থেকে তোমাকে তুলে নেওয়ার দায়িত্ব আমার। চার বছর পর তোমাকে দেখার উত্তেজনা ছিল। বাড়ির কারও সঙ্গে দেখা। তুমি না হয়ে যে কেউ হলেই উত্তেজনাটা থাকতো বোধহয়। ওরকম নির্জন নির্বাসনে বছরের পর বছর একা পড়ে থাকলে আত্মীয় বা বন্ধু কাউকে পাওয়ার অর্থ যে কী তোমাকে বোঝাতে পারবো না। আত্মীয় বন্ধুর কথা ছেড়ে দাও। চেনা কেউ, চেনা না হলেও দেশের কেউ, বাংলা ভাষায় কথা বলে কেউ, তাকেই কত আপন মনে হয়। শুধু তাই নয়, ভারত, পাকিস্তান, এমনকী শ্রীলঙ্কার লোকদেরও আপন মনে হয়। বিদেশি কোনও লোক বাংলাদেশ বা ভারত ঘুরেছে শুনলে তাকেও মনে হয় ঘরের লোক। ব্রাসেলস বিমান বন্দরে আমাকে নিতে এসেছিল ছোটদা। সে যে কী আনন্দ আমার ছোটদাকে দেখে। ছোটদাকে তো চারবছরে আরও কয়েকবার দেখেছি। একবার সেই আমস্টারডাম গিয়ে। ওকে স্টকহোমেও নিয়ে গিয়েছিলাম। অক্সফোর্ডে এসেছিল বাবাকে আমার কাছে তুলে দিতে। এরপর একবার নিয়ে এসেছিলাম বার্লিনে। তারপরও ছোটদাকে দেখে খুশিতে জড়িয়ে ধরি। মাকে নিয়ে এলে না কেন এয়ারপোর্টে? ছোটদা বললো, মা শীতে কাঁপছে, তাই বার করিনি বাইরে। শহর ছাড়িয়ে একটি মাঝারি গোছের হোটেলে বিমানের ক্রুরা থাকে। সেই হোটেল নভোটেলের নিচতলার একটি ঘরে তখন তুমি। তোমাকে দেখে আমি চমকে উঠি প্রথম। এ কাকে দেখছি! যে মাকে শেষ দেখেছিলাম, এ তো সে মা নয়। তোমাকে অমন চেহারায় এর আগে দেখিনি কোনওদিন। যতই বলছি এ কেমন শরীর হয়েছে তোমার! তুমি বলছো, ডায়বেটিস। ডায়বেটিসে জানি শরীর শুকিয়ে যায়। কিন্তু তোমাকে কি এতটাই ডায়বেটিস ধরেছে! ছোটদা বললো তুমি নাকি ইনসুলিন নাও, তাও আবার নিজে নিজে।
উফ, এর মতো মর্মান্তিক আর কিছু আছে কী! তোমার সঙ্গে বাংলাদেশের শেষ কটা মাস ভাববাচ্যে কথা বলতাম। এতগুলো বছর ফোনেও ভাববাচ্যে চালিয়েছি। যখন দেখা হল বিদেশ বিভুইএ, তখনও ভাববাচ্যে। নিজের মা, তার সঙ্গে ভাববাচ্যে কথা! সারা জীবন যদি নিজের বাবার সঙ্গে ভাববাচ্যে কথা বলি, নয় কেন! শুধু কি বাবার সঙ্গেই! নানিবাড়ির প্রায় সবার সঙ্গেই তো। আমার মনে হয় এত লোকের সঙ্গে ভাববাচ্যে কথা চালানো আমি ছাড়া জগতের আর কেউ পারেনি। কী করে যেপারি, ভাবলে বিস্ময় জাগে। কোনও এক সময় কিছু একটা করেছিলে, বকেছিলে বা কিছু, যে কারণে তোমাকে তুমি বলে সম্বোধন করা বন্ধ করেছি। তোমাকে কতগুলো বছর দেখিনি, কত দূরের দেশে একলা পড়ে আছি, তারপরও তোমাকে আমি ক্ষমা করি না। জানিনা তোমার কোন ভুলের জন্য দেশ থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে নির্বাসিত আমি তোমাকে ক্ষমা করতে পারিনা। তুমি শুধু আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদো কাঁদোই। আমি বলতে থাকি, কী ব্যাপার শরীরের এই অবস্থা কেন? না, তুমি তোমার শরীর নিয়ে একটুও ভাবছো না। ভাবছো আমাকে নিয়ে। আমি ততদিনে ফুলে ঢোল, সুতরাং তোমার বলার কোনও উপায় নেই যে আমি ঠিকমতো খাচ্ছিনা। শরীরের দিকে নজর যেন আমি দিই, বলছে না। আমার মুখে পিঠে বুকে হাতে পায়ে তুমি হাত বুলিয়ে দিচ্ছ। কতদিন আমাকে না ছুঁতে পারার কষ্ট তোমার আঙুলে, আমাকে দীর্ঘ কাল না দেখতে পারার কান্না তোমার চোখে। আমার চোখে জল ছিল না। আমি হাসছিলাম। অনেকদিন পর ফ্যামিলি গেট টুগেদারের যে আনন্দ, সেই আনন্দ উথলে উঠছিলো। যথারীতি বাবার অসুখ নিয়ে আমার দুশ্চিন্তা এবং তার আরোগ্য নিয়ে তার যে উদাসীনতা সে নিয়েও আমার শেষ না হওয়া উৎকণ্ঠা প্রকাশ পেতে থাকে আমার কথাবার্তায়। কথা বেশি বলছিলাম ছোটদার সঙ্গে। ছোটদার সঙ্গে আমার ভাববাচ্য চলে না। বলছিলাম দেশের কথা, দশের কথা। ওসব তো তোমার সঙ্গে আলোচনার কথা নয়। ছোটদাই বললো তুমি উমরাহ করে এসেছে। উমরাহ। ছি ছি। এ নিয়ে চললো আমার ছিছিককার। কেন উমরাহ করতে গেলে! এ কোনও কাজের কাজ! ছোটদার ফ্রি টিকিট ছিল, তাই যেতে পেরেছো তুমি। তোমার স্বপ্ন ছিল কোনওদিন আরব দেশে যাবে, সে স্বপ্ন বা শখ মিটেছে। আমি মনে করিয়ে দিয়েছি তোমার আমিরুল্লাহ পীরের কথা, যে বলেছিল তোমাদের নাকি আল্লাহর অলৌকিক বাহনে করে উড়িয়ে আরব দেশে নিয়ে যাবে। ওভাবে উড়ে যে যাওয়া তোমার হল না, মানুষের তৈরি উড়োজাহাজে যেতে হল–তাই বলে বলে আমি হাসছিলাম। শ্লেষের হাসি। তুমি কেবল আমার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলে আর চোখের জল ফেলছিলে। ফেলছিলে আমাকে দেখার আনন্দে। আর আমার নাস্তিকতার প্রমাণ আমি দিচ্ছিলাম তোমাকে আঘাত করে করে। নাস্তিকরা কি খুব নিষ্ঠুর হয়? হয় বোধহয়। নাকি আমিই নিষ্ঠুর! জগতে এক আমিই নিষ্ঠুর। যে মা আমার সঙ্গে জন্মের পর থেকে যতদিন দেশে ছিলাম, পাশে ছিল, তার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে চার চারটে বছর পার হওয়ার পর যখন তাকে প্রথম দেখি তার ধর্মবিশ্বাস নিয়ে ব্যঙ্গ করছি আমি, তার অন্ধ বিশ্বাসের কারণে সে যেন নুয়ে থাকে, লজ্জা পায়, তার চেষ্টা আমি করছি। আমি থামছিনা। আমি তাকে আঘাত করছি জেনেও আঘাত করছি। তোমার কষ্ট দেখে আমার অভ্যেস আছে। তোমার ধর্মবিশ্বাস নিয়ে চিরকালই আমি কটুক্তি করেছি। এ নতুন কিছু নয়। আমি যে সেই আমিই আছি, তা বোঝানোও হয়তো গেল কিছু। দেশ থেকে মৌলবাদীদের উৎপাতে নির্বাসন হলেও আমি যে আমার আদর্শ থেকে বিন্দুমাত্র বিচ্যুত হইনি তাও বোঝানো গেল। আর, এও আমি বোঝাতে চাইলাম যে বিদেশের সংস্কৃতিতে বেশ অভ্যস্ত হয়ে গেছি আমি, জানি অনেক, বুঝি অনেক। মা দেশি লোক। বিদেশে প্রথম। আরব দেশকে আর বিদেশ বলি না। সাদাদের ইওরোপ আমেরিকাকেই সত্যিকার বিদেশ বলি। মাকে আমার শেখাবার অনেক কিছু আছে। শেখাতে শুরু করে দিই তড়িঘড়ি। শীতকাল। শীতকালে ইওরোপে দেখার কিছু নেই। প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় জমে যেতে হবে। সবচেয়ে ভালো হল সামার। আমি গরমকাল কে আর গরমকাল বা গ্রীষ্মকাল বলি না। সামার বলি। তোমাকে গরম কাপড় পরতে হবে। স্যান্ডেল চলবে না, জুতোপরতে হবে। খুব পাতলা মোজাপরলে চলবে না। উলেন মোজা চাই। ইনার চাই, থারমাল চাই। মাথায় টুপি চাই। তুমি বিস্ময় চোখে দেখতে লাগলে আমাকে। কী দেখছিলে? আমি যে বিদেশের কত কিছু শিখে গেছি? আমি যে অনেক বিদেশি হয়ে গেছি, দেখছিলে? আমি তোপরে এসেছিলাম ওভারকোট, মাথায় টুপি, পায়ে ছেলেদের জুতোর মতো বুটজুতো। আমি বুঝিয়ে দিচ্ছিলাম, ছেলেদের মতো দেখতে তোমার মনে হতে পারে, কারণ দেশে তো মেয়েরা এরকম জুতো পরে না, কিন্তু এ জুতো মেয়েদের জুতো। তুমি বুঝলে; কিন্তু জুতোয়, জামায়, কোটে, ওভারকোটে, টুপিতে তোমার কোনও কৌতূহল নেই। কৌতূহল আমাকে নিয়ে। কী করছি, কী খাচ্ছি, মন কেমন, শরীর কেমন, কবে দেশে ফিরতে পারবো, দেশে ফিরতে যা যা করতে হয় তা কি করছি? যদি না করি, কেন করছিনা? তোমার কৌতূহল মেটাতে আমার মোটেও ইচ্ছে হয় না। আমি তোমার রাজনৈতিক নির্বুদ্ধিতা নিয়ে আবারও বিদ্রূপ করি। কোনও চেষ্টা করলেও যে কোনও লাভ হবে না, দেশে যে আমাকে ফিরতে দেওয়া হবে না, এ যে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, যে তুমি বোঝো না, তা যে কেবল আমি বুঝি আর ছোটদা বোঝে, সেটাই তোমাকে বোঝাই। আমাকে দেশে ঢুকতে দিলে সে যে সরকারই হোক, ধর্মবাদীদের ভোট পাবে না বলে ভয়ে আমাকে ঢুকতে দেয় না। তুমি কী বুঝলে কতটুকু বুঝলে কিছুই বলল না, শুধু বলো, যেন চেষ্টা করি দেশে ফেরার। যেন ফিরি। একটা মানুষ কী করে চেষ্টা করতে পারে, কী করে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তকে টলিয়ে ফেলতে পারে, মৌলবাদে ছেয়ে যাচ্ছে দেশ, রাজনীতিবিদরা মৌলবাদেরপক্ষে যাবে, নাকিআমার পক্ষে গিয়ে বিপদ ডেকে আনবে নিজেদের, এসব জিজ্ঞেস করি তোমাকে। তোমার পক্ষে তো এসবের উত্তর দেওয়া সম্ভব হয় না, শুধু বলো, দেশে ফেরো দেশে ফেরো। একসময় বলল, তোমাকে না নিয়ে আমি দেশে ফিরবো না। তোমার বালখিল্য কথা আবারও হাস্যরসের যোগান দেয়। তুমি জগতের দুর্বলতম মানুষ, তুমি কিনা আমাকে দেশে ফিরিয়ে নেবে! না হেসে কী করবো। তোমার মুখে হাসি নেই। সারা মুখে আমাকে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার সংকল্প, একই সঙ্গে কষ্টে ডুবে থাকা চোখ। তোমার ভেতর এমন দৃঢ়তা আগে কখনও দেখেছি বলে মনে করতেপারি না। তোমার ওজন অস্বাভাবিক কমে যাওয়া, চিরকালের দুর্বল মনের মানুষটির সবল হওয়া দুটোই আমার কাছে নতুন। তুমি ঠিক আগের তুমিনও। সামান্য হলেও কিছুপরিবর্তন তোমার মধ্যে ঘটেছে। কিন্তু তোমার আর কত, সবচেয়ে বেশি পরিবর্তন যে ঘটেছে আমার মধ্যে। আমি শীত গ্রীষ্ম জানি, বিদেশের পথে একা একা হাঁটতে জানি। কোন দোকানে কী পাওয়া যায়, কী জিনিস দিয়ে কী করতে হয় জানি। এমনকী এক দেশ থেকে আরেক দেশে চলে যেতে জানি। এসব কিছুই তুমি জানো না মা। তুমি দেশে পড়ে থাকা আটপৌরে শাড়ি পরা অবুঝ অশিক্ষিত মা। বিদেশে আমাকে নিয়ে কী সব কাণ্ড হয়েছে তোমাকে বলি। কত কাণ্ড। বাবা কি কিছু গিয়ে বলেছে? না বলেনি। আমি যে ছোটদার হাতে এত এত ভিডিও ক্যাসেট পাঠিয়ে দিয়েছি, এত এত বই, অ্যালবাম! না তুমি কিছু দেখনি।