দেশ ছেড়ে চলে আসার দিন থেকে চার চারটে বছর তুমি আমার পথের দিকে চেয়ে কাটিয়েছিলে। উড়োজাহাজের শব্দ শুনে দৌড়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াতে। আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবতে হয়তো আমি এসেছি। তাকিয়ে থাকতে থাকতে চোখ তোমার ভিজে উঠতো! কত কেউ দেশে ফেরে, কেবল আমি ফিরি না। বাড়ির দরজায় আর সবাই কড়া নাড়ে, কেবল আমিই নাড়ি না। তোমার শরীরটাও, তুমি টের পাচ্ছো, যে, ভালো যাচ্ছে না। কেন ভালো যাচ্ছে না? জিজ্ঞেস করলে ফোনে তুমি উত্তর দিতে না। আসলে তুমি জানো না মা, আমি ভাবতাম তুমি মিথ্যে বলছে। ওই যে সেই কত আগে থেকেই বলতে যে তোমার কী নাকি একটা অসুখ, রক্ত যাওয়ার অসুখ আছে, নাম পাইলস। বাবা বলতো ও কিছু না। আমরাও বলতাম ও কিছুনা। আমি তো ও কিছুনাতে থেমে থাকিনি বলতাম, ‘শুধু শুধু কমপ্লেইন করবে না তো! তোমার শরীর খুবই ভালো আছে, চমৎকার আছে। আমি জানিনা কেন বিশ্বাস করতাম সবাইকে বিরক্ত করতেই শুধু অভিযোগ নিয়ে আসো, এখানে ব্যথা, ওখানে কষ্ট। অথচ বাবার সামান্য অসুখেই আমি বিচলিত বোধ করতাম। জানি তার রক্তচাপ বেশি, একবার ছোটখাটো একটা মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশান হয়েছে শুনেছি। জানি তার ডায়বেটিস। জানি যে কোনও সময় বাবার দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। তাই বাবা নিয়েই আমার রাজ্যির দুর্ভাবনা, দুশ্চিন্তা। মা, তুমি যখনই তোমার অসুখের কথা বলতে, আমি বলতাম, ‘অসুখ যদি থাকে সে বাবার, তোমার নয়। তখন হার্ট মানে কী, হার্টের অসুখ মানে কী, এনলার্জড় হার্ট মানে কী, মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশান মানে কী তা বেশ জোরে সোরেই তোমাকে বুঝিয়ে দিতাম। তুমি হাঁ হয়ে শুনতে। এরপর আর কষ্ট পেলেও কষ্টের কথা বলতে না পাছেমিছে অভিযোগ মনে করে ধমক দিই। হ্যাঁ বরাবরই আমার উদ্বেগ বাবাকে নিয়ে। বাবার সেবা যত্ন ঠিকমতো হচ্ছেনা। সারাদিন চেম্বারে বসে রোগী দেখছে, বাড়ি বাড়ি রোগী দেখতে যাচ্ছে, বাজারে যাচ্ছে বাবা কখন খাবে, কী খাবে, কখন বিশ্রাম নেবে, কতক্ষণ নেবে, বাবার দেখাশোনা কে করবে ময়মনসিংহে! দুশ্চিন্তার মুঠোর ভেতর বন্দি হয়ে ছটফট করি। বাবাকে ফোন করে বাবার কথা জিজ্ঞেস করি, তোমাকে ফোন করে ওই বাবার কথাই জিজ্ঞেস করি। না গো মা, তুমি কেমন আছো, এ কথা জিজ্ঞেস করি না। করি না কারণ, জানি, আগেও যেমন জানতাম, এখনও জানি যে, ভালো আছো তুমি। বাবা ভালো নেই বলে আমার উৎকণ্ঠা এবং উদ্বেগ দিন দিন এমনই বাড়ে যে প্রবল ভাবনায় থাকি বাবা যে প্রতিদিন অবকাশ থেকে নতুন বাজারে চেম্বারে যায়, রাতে চেম্বার থেকে বাড়ি ফেরে, গ্রামের জমি দেখতে মাঝে মাঝে নান্দাইল যায়, সব যাওয়া আসা যেন পায়ে হেঁটে, রিক্সায়, বাসে না হয়ে গাড়িতে হয়। আমার নিজের গাড়ি পড়ে আছে ঢাকায়। ছোটদা সেটা ব্যবহার করে। ছোটদাকে অনেক বলেছি গাড়িটা যেন বাবাকে ব্যবহারের জন্য দেওয়া হয়। যতবারই ছোটদাকে গাড়ি পাঠানোর কথা বলি, ছোটদা বলে, বাবা গাড়ি নেবে না। নেবে না আবার কী, গাড়ি তুমি ময়মনসিংহে চালিয়ে নিয়ে গিয়ে বাড়িতে রেখে ট্রেনে করে ঢাকা চলে এসো। ছোটদা অবশ্য বলে যে হ্যাঁ ঠিক আছে তাই করবো। সম্ভবত দূরের একটা গর্দভকে শান্ত করার জন্যই বলে। এক দুই করে মাস যেতে থাকে, খবর নিয়ে দেখি ছোটদা বাবাকে গাড়ি দেয়নি। আমার নিজের গাড়ির ওপর আমার কোনও অধিকার নেই, অধিকার ছোটদার। গাড়ি সে কাউকে দেবে না, কারণ গাড়ি সে ব্যবহার করে। ছোটদা একবার আমাকে গাড়ি কিনে দেবে বলে টাকা নিয়ে গিয়েছিল, আর ফেরত দেয়নি। অনেকদিন সেই টাকার জন্য অপেক্ষা করে পরে নিজেই একটি গাড়ি কিনি, ভেতরে দামি সিট কভার, মেঝেয় ম্যাট, পারফিউম, জানালার রোদপর্দা ইত্যাদি কত কিছু দিয়ে গাড়িটি সাজানোর পরপরই আমাকে দেশ ছাড়তে হলো। গাড়িটি ব্যবহার করতে শুরু করলো একা ছোটদা। তুমি যে ঢাকায় বেরোতে, তোমাকেও তো কোনওদিন আমার গাড়ি ব্যবহার করতে দেয়নি। তুমি বাজারে যেতে, বড় মামার বাড়ি যেতে, ঝুনুখালার বাড়ি যেতে, সবখানেই রিক্সায় যেতে। আমার গাড়ির ওপর তোমারও কোনও অধিকার ছিল না, কোনও অধিকার দাবি করার কথাও কোনওদিন কল্পনাও করোনি। ছোটদা তার বান্ধবীদের নিয়ে গাড়ি নিয়ে ঘুরবে, যেন সেটাই নিয়ম ছিল। ওই নিয়মের বাইরে অন্য কোনও কিছু যে হতে পারে, খুব স্বাভাবিক কিছু, তা ভুলেই গিয়েছিলে বা ছোটা তোমাকে ভুলিয়ে দিয়েছিলো। বাবা ঢাকায় এলেও তাই হতো। বাসে ঢাকায় আসতো, ঢাকায় যদি কাজ থাকতো কোথাও, বিক্সায় যেত। আর দেশ থেকে কয়েক হাজার মাইল দূরে বসে এক গর্দভ বাবার রিক্সায় চলার বিরুদ্ধে চেঁচাতো। আমার চেঁচানোর কোনও মূল্য ছোটদার কাছে কখনও ছিল না। শেষপর্যন্ত আমি সিদ্ধান্ত নিই যে বাবাকে গাড়ি কেনার জন্য টাকাঁপাঠাবো। বাবা বলে দিল কোনও টাকা পাঠানোর দরকার নেই। কিন্তু বললেই তো হবে না, আমাকে তো দুশ্চিন্তামুক্ত হতে হবে, বাবা কৃপণ বলে আমি তো কৃপণনই। আমি ভুল ভেবেছিলাম, ভেবেছিলাম বাবা কৃপণ বলে নিজের টাকা খরচ করে না, সম্ভবত অন্যের টাকা খরচ করবে। কিন্তু যে নিজের টাকা খরচ করে না, সে যে অন্যেরটাও করে না, তা আমার বোঝা উচিত ছিল। বাবা কিছুতেই তার ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট নম্বর আমাকে জানাবে না। আগেও তো জানায়নি। তখন তোমার অ্যাকাউন্টে আমি বাবার জন্য টাকা পাঠিয়েছিলাম। নিজের অ্যাকাউন্ট নম্বর আমাকে জানাবেই না, শেষ পর্যন্ত দাদার অ্যাকাউন্ট নম্বর নিয়ে ওখানে বাবার গাড়ি কেনার জন্য টাকা পাঠালাম। সাড়ে চার লাখ বা পাঁচ লাখ টাকা। দাদা বললো রেজিস্ট্রেশনের জন্য তো টাকা লাগবে। তাও পাঠালাম। দাদাকে পই পই করে বলে দিই যেন বাবার নামে গাড়ির রেজিস্ট্রেশন হয়। গাড়ি কেনা হচ্ছে কিনা, কবে কেনা হবে, এসব আমি প্রতিদিনই বাবা আর দাদাকে ফোন করে জিজ্ঞেস করি। তাগাদা দিই তাড়াতাড়ি করার জন্য। সব কিছুর কারণ ছিল, বাবা যেন ভেবে মনে সুখ পায় যে গাড়িটা তার, গাড়িটা তাকে তার সুযোগ্য কন্যা উপহার দিয়েছে। গাড়িটা যেন বাবা তার নিজের চলাফেরার জন্য ব্যবহার করে। গাড়ি কেনা হল, গাড়ির রেজিস্ট্রেশন হল, সব আমিই ফোন করে করে খবর নিয়েছি। এরকম নয় যে দাদা বা বাবা নিজে থেকে আমাকেকিছু জানিয়েছে। গাড়ির রেজিস্ট্রেশন বাবার নামে হয়েছে তো, বারবার জিজ্ঞেস করি। দাদা বললো বাবার নামেই হয়েছে। গাড়ি কেনার পরও আমার প্রতিদিনের ফোন করায় কোনও ছেদ পড়ে না। কী হল, বাবা গাড়ি চড়ছে তো! বাবা সুন্দর বলে দিল, চড়ছি। দাদাকে জিজ্ঞেস করি, দাদা বললো, ড্রাইভার এখনও রাখা হয়নি। ড্রাইভার রাখা হলে আবারও খবর নিই। তোমার কাছে ফোন করে জানতে চাই বাবা গাড়ি চড়ছে কি না। তুমি বললে, ”গাড়ি তো শুধু নোমান চড়ে, আর নোমানের বউ ছেলেরা চড়ে, তোর বাবা তো চড়ে না। রেগে আগুন হই আমি। ওই আগুনে আমি একা একাই পুড়ি। আমি টাকা পাঠাতে পারি, কিন্তু টাকা দিয়ে যা করা হবে, তা তো আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না। সে শক্তি আমার নেই। আমার শুধু টাকার শক্তি। আমার শুধু যার আছে, তাকে দেওয়ার উৎসাহ।