ওদিকে ঢাকায় কিমোথেরাপি শুরু হয়ে গেছে তোমার। বাড়িতে লোক এসে দিয়ে যায় ইনজেকশন। ওসব ইনজেকশনে কোনও কাজ হয় না। তোমার লিভারে অসুখ ছড়িয়েছে। তারপরও কিমোথেরাপি নেওয়ারপর তুমি আশ্চর্য এক স্বস্তি পেতে। কিছু একটা চিকিৎসা তোমার হচ্ছে, এ ভেবেই বোধহয় পেতে। কিমোথেরাপির বিষ তোমার শরীরে যাওয়ারপর তোমার তো আরও অসুস্থ হয়ে পড়ার কথা। না, তুমি বরং বলতে যে তোমার এখন ভালো লাগছে। আসলে ও তোমার মনের ভালো লাগা, শরীরে কিমোথেরাপির ওষুধ কোনও ভালো লাগা দেয় না। বরং শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে ফেলে, চারদিকের ব্যাকটেরিয়া দ্বারা আগের চেয়ে আরও বেশি আক্রান্ত হতে থাকো। অত বড় অপারেশনের ধকলও কাটিয়ে উঠলে। তুমি ভাবছো তুমি সুস্থ হয়ে উঠছে। আমি তো বুঝতে পারছি, সুইডেনে তোমার অসুখ না ধরতে পারা, বাংলাদেশে তোমার ভুল অপারেশন করা সবকিছু তোমার অসুখ যত না ভয়ংকর, তার চেয়েও বেশি ভয়ংকর করে তুলেছে। ঘণ্টা বাজছে, সেই শব্দ আমি শুনতে পাচ্ছি। বাবা ডাক্তার, বাবাও নিশ্চয়ই শুনতে পাচ্ছিল। আমি মরিয়া হয়ে উঠলাম কোথাও কোনও আধুনিক চিকিৎসা আছে কিনা দেখতে। তোমাকে ভারতে নিয়ে যাওয়া যায় কিনা, সিঙ্গাপুরে, নাকি সুইডেনে, নাকি আমেরিকায়। ভারতের বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলে হাসপাতাল আর ডাক্তার সবই ঠিক করে ফেললাম, কিন্তু মুশকিল হল ও দেশ আমাকে ভিসা দেয় না। কীকরে যাবো! সিঙ্গাপুর আর সুইডেনে কোনও অসুবিধে নেই। কিন্তু সুইডেনের ওপর আমার প্রচণ্ড ক্ষোভ, তোমার অসুখ ধরতে পারেনি, তারপর তোমাকে দিনের পর দিন ভুল চিকিৎসা দিয়ে ভুগিয়েছে। আমেরিকায় কিছু পাওয়া যায় কি না তা দেখি। নেট ঘেঁটে নিউইয়র্কের মেমোরিয়াল স্লোন কেটেরিং হাসপাতালের সন্ধান পেলাম। নিউইয়র্ক শহরেই সেই ক্যানসার হাসপাতাল। কোলন ক্যানসারে যে লিভার মেটাসটাসিস হয়, তার বিশেষজ্ঞ আছে ওই হাসপাতালে। তারা নতুন একটি জাপানি উদ্ভিদের রস সরাসরি রক্তে ঢুকিয়ে কিছু কিছু ক্ষেত্রে নাকি ভালো ফল পাচ্ছে। আমি ওটিই ভাবলাম চেষ্টা করবো তোমার জন্য। শেষ চেষ্টা। তোমাকে বাঁচানোর জন্য পাগল হয়ে উঠলাম মা। ওই স্লোন কেটেরিং হাসপাতালে একদিন গিয়ে জেনে এসেছি নিয়ম কানুন। আমার আমেরিকান বন্ধু ওয়ারেন অ্যালেন স্মিথকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলাম। রোগীর সোশাল সিকিউরিটি নম্বর লাগবে, তবেই ওরা চিকিৎসা করবে। পরে ফোনে খবর নিয়ে জেনেছি, অন্য দেশের রোগীদের ক্ষেত্রে তেরো হাজার ডলার জমা দিতে হবে, ওরাই বিমান বন্দর থেকে রোগী নিয়ে আসা থেকে প্রয়োজন অনুযায়ী সব চিকিৎসা করবে। হাসপাতালেও ভর্তি হওয়ার ঘটনা ঘটতে পারে। এসব খোঁজ খবর নেওয়া, দিনে কুড়িবার করে দেশে ফোন করে আমেরিকার দূতাবাসে গিয়ে ভিসা যেন সময় মতোনাও তার তাগাদা দিচ্ছিলাম। পাশে কাউকেপাইনি আমাকে সাহায্য করার। ইয়াসমিন যখন শুনলো আমি তোমাকে আমেরিকায় আনছি চিকিৎসার জন্য, সে খুশি না হয়ে বরং উল্টেআমার সঙ্গে মেজাজ দেখালো। তুমি যদি আসবেই, তাহলে শুধু শুধু তাকে দেশে যেতে হলো কেন! কেন আমি তার আমেরিকার নাগরিকত্ব পাওয়ার বারোটা বাজিয়ে দিলাম! রাজনৈতিক আশ্রয় আমার বোন হিসেবেই সে পেয়েছে। তার বারোটার কিছুই বাজেনি মা, কিন্তু আমেরিকার নাগরিকত্ব পেতে আবার কোনও অসুবিধে হয় কি না এই আশংকায় সে বীভৎস হয়ে উঠলো। আমি যে কত একা ছিলাম দিন রাত, কত যে তোমার জন্য একা একা ভেবেছি, কেঁদেছি, সে আমিই জানি। তুমি আর বাবা এলে। বিমান বন্দরে আমি গেলাম, ইয়াসমিন যায়নি। সে কেন যাবে, সে তো ফুঁসছে। তোমার জন্য বাংলাদেশে গিয়ে ভীষণ ভুল সে করে ফেলেছে, সেই ভুলের সব দায় দায়িত্ব আমার, পারলে আমার মুখ দেখা সে বন্ধ করে দেয়। তার কাছে আমেরিকার নাগরিকত্বের চেয়ে বড় কোনও কিছু এই জগতে নেই। বাবা মা ভাই বোন তার কাছে আর বড় ব্যাপার নয়। তার নিজের আর তার স্বামী সন্তানের নাগরিক ভবিষ্যৎ নিয়েই তার যাবতীয় ভাবনা। ওর ভেতরে যে আবেগ ছিল, যে ভালোবাসা ছিল, সে কোথায় গেল, আমি বুঝে পাই না। আমেরিকার স্বপ্ন তাকে ছোটদা আর মিলন শিখিয়েছে দেখতে। তা না হলে ও একটা হৃদয়হীন মানুষের মতো এমন অসভ্য আচরণ করতো না। ওর নাগরিকত্ব পেতে সামান্যও কোনও ব্যাঘাত ঘটেনি মা। যখন পাওয়ার, নির্বিঘ্নে পেয়ে গেছে।
বাংলাদেশ বিমানে ছোটদাই ফ্রি টিকিটে তোমাদের নিয়ে এলো। এয়ারপোর্টে তোমাদের নামিয়ে দিয়ে আবার চলেও গেল। আমার পাঠানো গয়নাগুলো তুমি পরে এসেছে। না মা, তোমাকে সুন্দর দেখাবে বলে নয়, আমাকে খুশি করতে পরেছে। আমাকে খুশি করার জন্য তুমি আগেও যেমন সব করেছে, তখনও করেছে। আমি বোধহয় ওই প্রথম আমার জীবনে তোমাকে খুশি করতে চাইছিলাম। আমি কি পারছিলাম মা? তুমি অসম্ভব শান্ত, স্নিগ্ধ, তোমাকে দেখে একটুও মনে হচ্ছিল না যে প্রায় তিরিশ ঘণ্টার একটা দীর্ঘ ক্লান্তিকর যাত্রা সবে শেষ করেছো। বাড়ির পথে যেতে যেতে ট্যাক্সির জানালায় তোমাকে নিইউয়র্ক শহরটাকে দেখাতে চাইছিলাম। না, মা, তুমি শুধু আমার দিকেই তাকিয়েছিলে। আমার একটা হাত ধরে বসেছিলে, সেই হাতে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলে। পরেও যখন তোমাকে ম্যানহাটনের দিকে যেতে উঁচু উঁচু দালানগুলো দেখাতে চেয়েছি, তুমি একবার তাকিয়েই চোখ সরিয়ে নিয়েছে। পৃথিবীর সব লোকই এসে অবাক চোখে ওই উঁচু বাড়িগুলো দেখে, এসব দেখে তোমার কোনও বিস্ময় জাগে না। যেন তুমি এসব অনেক দেখেছো। এত নিস্পৃহ চোখে জগৎ দেখতে আর কাউকে দেখিনি আমি। এত উৎসাহ ভরে মানুষ দেখতেও আর কাউকে দেখিনি। তোমার কাছে মানুষ আর মানুষের হৃদয়ের দাম ছিল সবচেয়ে বেশি।