ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করি, লিভারের অপারেশন করা যায় কি না। ডাক্তার বললেন, দেশে ওই অপারেশন হয় না। বিদেশে হবে? বললেন, হতে পারে, চেষ্টা করে দেখতে পারি। আমি অনুযোগ করলাম, কোনও লাভ নেই জেনেও করলাম, কেন র্যাডিক্যাল সার্জারি করতে গেলেন, এতে তো ক্যানসার আরও ছড়িয়েছে! ডাক্তার আর কী বলবেন, ওই লিভারের রিপোর্টকেই দোষ দিয়ে নিজের ভুলের কথা এড়িয়ে যান। এক বুক দীর্ঘশ্বাস নিয়ে আমি বসে থাকি, একা।
ছোটদার বান্ধবী জুই নিউইয়র্কে আসছে শুনে তোমার জন্য জ্যাকসন হাইটসের সোনার দোকান থেকে গয়নার সেট কিনলাম। গলার হার, কানের দুল, হাতের চুড়ি। জীবনে তোমার খুব শখ ছিল সোনার গয়না পরার। দাদা তার বিয়ের আগে তোমাকে দুটো অনন্তবালা গড়িয়ে দিয়েছিল। সে দুটো তুমি দিয়েও দিয়েছোপরে, একটা তোমার মাকে, আরেকটা তোমার মেয়েকে। ইয়াসমিনকে। ইয়াসমিনেরও অলংকারের সাধ। আমারই গয়নাগাটির সাধ আহ্লাদ কিছু নেই। মা, যে মানুষ জীবনে তোমার জন্য কিছুই কিনিনি, সে আমি কত দামি জিনিস অকাতরে কিনে ফেললাম! তোমাকে একটুখানি সুখ দিতে। সত্যি বলতে তোমার সময় আর বেশি নেই বলেই চাইছি তোমাকে আনন্দ দিতে, নিজের গ্লানি মোচন করতে নিজের অপরাধ ঢাকতে চাইছি। তা ছাড়া আর কী! যখন জুইকে তার হোটেলে গিয়ে দিতে চাই তোমার গয়নার বাক্স, কিছুতেই সে নিতে চাইছিল না। সে নাকি ছোটদার প্রেমিকা, তোমাকে না কি সে খুব ভালোবাসে। তাদের নাকি ইমিগ্রেশনে চেক হয়, বাড়তি কোনও জিনিস থাকলে খুব নাকি ঝককি পোহাতে হয়। অথচ দেখ প্রতিবারই বিদেশ এসে ক্রুরা বিস্তর জিনিস কিনে নিয়ে দেশে ফেরে, ওগুলো বেশি দামে বিক্রি করে যা টাকা ওরা রোজগার করে, তা ওদের চাকরির মাইনের টাকার চেয়েও বেশি। আর তোমার জন্য সামান্য ওইটুকু অলংকার নেওয়া জুইএর কাছে মনে হচ্ছিল যেন গোটা একটা হিমালয় বয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো। যখন অনেক বলে কয়ে রাজি করালাম, বিরক্ত কণ্ঠে বললো, বাক্সটা ফেলে দিয়ে গয়নাগুলো তাকে পরে নিতে হবে। নিক, যে করেই হোক নিক। আমি চাই তোমার মুখে হাসি ফোঁটাতে। তোমাকে সামান্য ভালো লাগা দিতে। সারাজীবনে ভালোবাসা তো কিছুই পাওনি। অন্তত তোমার এই অপদার্থ মেয়েটি তোমাকে ভালোবাসে -এই ভেবেও যেন তোমার সামান্য সুখ হয়। ক্যানসার নামের ভয়ংকর রোগে তুমি আক্রান্ত, তোমার অন্ত্র আক্রান্ত, ক্যানসারের চেয়েও ভয়ংকর হলো মেটাসটাসিস, তাতেও আক্রান্ত তুমি। এসবের কিছুই জানতে না তুমি। জানতো বাড়ির সবাই। জানতাম আমি। অনুতাপ আমাকে দিয়ে ইয়াসমিনকে বারবার অনুরোধ করালো। যা তুই মার কাছে যা। মার কাছে থাক। মাকে একটু আদর কর গেগিয়ে। মার তো কোনওদিন কিছু পাওয়া হয়নি আমাদের কাছ থেকে। মাকে অনেক কিছু উপহার দে। মাকে বোঝা যে ভালোবাসিস খুব। মা, তুমি তো জানো না ইয়াসমিনকে আমি বলে বলে পাঠিয়েছিলাম যেন সারাক্ষণ তোমার সঙ্গে সময় কাটায়। তোমার যেন ভালো লাগে। তোমার যেন আনন্দ হয়। কয়েক হাজার ডলার দিলাম তোমার জন্য। সব খরচ করে আয় মার জন্য। হায়, তোমার জন্য খরচ করার আর কী কিছু আছে! ধার কর্জ যা করেছে হাসপাতালের খরচ মেটাতে, সব যেন মেটায়। তোমার যা খেতে ইচ্ছে করে, যা করতে ইচ্ছে করে, সব যেন করতে পারো, খেতে পারো। দুজনই খুব দামি দামি জামা কাপড় কিনলাম তোমার জন্য। না, মা, টাকার হিসেব তখন আর করিনি। পারলে তোমাকে পৃথিবীর যত ভালো কিছু আছে, সব কিনে দিই। ইয়াসমিন তোমার কাছে যাওয়ার পর নির্ভার হলাম, অন্তত কিছুটা হলেও সুখ স্বস্তি তো পাচ্ছো। মেয়ে সঙ্গে আছে। ছেলেদের সঙ্গে থাকা আর মেয়ের সঙ্গে থাকার মধ্যে অনেক তফাৎ। ঠিক মনে নেই ইয়াসমিন কতদিন ছিল, ফিরে এলো যখন, দেখলাম ও খুব ঘুরেছে এর ওর বাড়ি, ভিডিও করেছে দেখালো, প্রচুর জিনিস কিনে এনেছে, গলায় তার চেইন, আল্লাহু লেখা লকেট। বললো, তুমি টাকা দিয়েছো কিনতে, কিনেছে। কোথায় ও তোমার জন্য করবে, নয়তো তুমিই ওকে আদর করে ওর জন্য খরচ করেছো। আমি সারাক্ষণই অস্থির তখন, কী করে যাবো তোমার কাছে। কী করে তোমাকে সুখ দেব, যে সুখ কোনওদিন পাওনি, সেই সুখ। তোমাকে অনেক অনেক ভালোবাসা দেবার জন্য হৃদয় পেতে বসে ছিলাম মা, তোমার কাছে পৌঁছোবার কোনও সাধ্য আমার ছিল না। দেশে গিয়েছিল বলে ইয়াসমিনকে ইমিগ্রেশনের লোকেরা প্রশ্নবাণে বিদ্ধ করেছে, আমেরিকায় রাজনৈতিক আশ্রয় পাওয়া মানুষ দেশে যাবে কেন, এর মানে কি এই যে দেশে তার কোনও রাজনৈতিক সমস্যা নেই! ইয়াসমিনের সমস্ত রাগ গিয়ে পড়লো আমার ওপর। বললো, আমিই নাকি ওর সর্বনাশ করেছি দেশে পাঠিয়ে। কী হবে ওর আমেরিকার গ্রিন কার্ড দিয়ে, পাসপোর্ট দিয়ে! কী জানি কেন যে নিজের মার জীবনের চেয়ে বেশি মূল্যবান মনে করে ওরা বিদেশের পাসপোর্টকে। কী হয়পাসপোর্ট দিয়ে? রাজনৈতিক আশ্রয় পেয়েছে, পাসপোের্ট একদিন না একদিন হবেই ওর। তাই বলে অনুতাপ করবে, কেন তোমাকে দেখতে দেশে গেল, কেন সে নিজের জীবনের এত বড় ক্ষতি করলো! কী অনুশোচনা! আমি যেন কোত্থেকে এক ডাইনি এসেছি ওকে মারতে! আমি শুধু নরম গলায় বলেছি, ‘আমি যেহেতু যেতেপারছি না, তাই তোকে বলেছি দেশে যেতে। আজ যে তুই আফশোস করছিস মাকে দেখতে গিয়েছিস বলে, আজ যে ভাবছিস মাকে দেখতে গিয়ে ভুল করেছিস, সেটা কোনও একদিন তুই করবি না। কোনও একদিন তোর মনে হবে, জীবনে কোনও যদি ভালো কাজ করে থাকিস, ওই ওটাই। অসুস্থ মার পাশে কিছুদিন কাটিয়ে এসেছিস, মার চিরতরে চলে যাবার আগেমার সঙ্গে থেকে মাকে একটুখানি সুখ দিয়েছিস।