যারা তোমার কিচ্ছুহয়নি, কোনও অসুখ হয়নি বলে অবজ্ঞা করেছে, তুমি নাকি বানিয়ে অভিযোগ করছে বলে অভিযোগ করেছে, তারা আজ সবাই স্বীকার করছে যে তোমার এমন এক বড় অসুখ হয়েছে, যে অসুখে হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে, এমনকী অপারেশন করতে হবে। হাসপাতালে তোমার অপারেশন হচ্ছে, দাদা অপরাশেন থিয়েটারের বাইরে দাঁড়িয়ে রইলো, ছোটদা রইলো, বাবা রইলো। বাবাও নাকি খুব চুকচুক করে দুঃখ করেছে, বাবাও নাকি মাথায় হাত দিয়ে বসে ছিল। ফোনে বাবাকে আমি খুব দোষ দিয়েছি, তুমি এত কাঁদারপরও বাবা তোমার অসুখ সারায়নি বলে। যে ডাক্তার শহরের নামকরা ডাক্তার, অন্য ডাক্তাররা রোগ ধরতে না পারলে যে ডাক্তার যে কোনও রোগ ধরতে পারে, সেই ডাক্তার বাবাকে আমি ধিক্কার দিই। বাবা বারে বারেই বললো, আমি তো বুঝতে পারিনি। আমাকেও একবার বললো, তোমার কাছে তো কয়েক মাস ছিলো, তুমি কেন চিকিৎসা করালে না? ’ এর কী উত্তরই বা আমি দেব! আমার কি কোনও ভাষা আছে কিছু বলার? মুখ দেখানোর মুখ কি আছে? আর যার যে প্রশ্নেরই যে উত্তর দিই না কেন, এই প্রশ্নের উত্তর আমি দিতে পারি না। তোমার কাছে কত বড় অপরাধী হিসেবে আমি যে দাঁড়ালাম, তা এক আমিই জানি। তোমার সঙ্গে যখন ফোনে কথা বলছিলাম, তোমার কণ্ঠস্বর কী যে শিশুর মতো শোনাচ্ছিল। তুমি জানছো যে তোমার পেটে টিউমার হয়েছে, অপারেশন করে সেই টিউমার ফেলে দিলেই তুমি আবার আগের মতো ভালো হয়ে উঠবে। তোমার এই জানাটা যে সত্য নয়, তা এক আমি জানি, আর বাবা জানে। পাইলস পাইলস করে সতেরো বছর চিকিৎসার জন্য কেঁদেছো। সতেরো বছর পর প্রথম তুমি চিকিৎসা পেয়ে এখন সুস্থ হয়ে উঠবে, তুমি তো খুশি হবেই। তোমার আনন্দই তো স্থবির দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে হবে আমাদের।
মা, তখন আমি তোমার কাছে প্রাণপণে যেতে চাইছি। কিন্তু আর যেকেউ যেতে পারলেও আমার যাওয়া সম্ভব নয়। প্রতিদিন ছটফট করছি। বারবার ফোন করছি। চার বছরে যে ফোন করিনি, চারদিনে তার চেয়ে বেশি করছি। অপরাধবোধ? হ্যাঁ নিশ্চিতই মা, অপরাধবোধ। এর চেয়ে বড় অপরাধ কি কেউ করে জীবনে! আমি টুকরো টুকরো হয়ে গেলাম গ্লানিতে। শত ধিক দিলাম নিজেকে। ভেসে গেলাম অনুতাপে, অনুশোচনায়, ডুবে রইলাম লজ্জায়, ঘৃণায়। নিজের ওপর ঘৃণা মা। অপারেশন যে ডাক্তার করবেন, তাঁর ফোন নম্বর দাদার কাছ থেকে নিয়ে ফোনে অনেকবারই তাঁর সঙ্গে কথা বলেছি। কী মনে হচ্ছে, সাদাসিধে কোনও টিউমার কি হতে পারে না? ডাক্তার বললেন কোলোনোস্কপি করে তা মনে হচ্ছে না। টিউমার সাদাসিধে হোক, অপারেশনের পর তুমি সুস্থ হয়ে ওঠো, আমি প্রাণপণে আশা করতে থাকি। আমার তো কোনও ঈশ্বর নেই প্রার্থনা করার মা। আমি এই নিষ্ঠুর প্রকৃতির কাছেই তোমার প্রাণভিক্ষা চাই। তোমার সততা, তোমার পবিত্রতা, তোমার অকৃত্রিমতাকে ঈশ্বর মেনে তার কাছে প্রার্থনা করি তোমার সুস্থ। সারাজীবন যে যন্ত্রণা পেয়েছে, যে কষ্ট তোমাকে কামড়ে খেয়েছে, সেই তোমাকে একটু আনন্দ দিতে আমি মরিয়া হয়ে উঠি। অসুখ তোমার কেউ সারায়নি বলে আশা ছেড়ে দিয়েছিলে। আমাকে শেষ দেখা দেখতে এসেছিলে মা, যে করেই হোক এসেছিলে। বাবা মা দুজনের জন্য ভিসার ব্যবস্থা করেছিলাম। বাবাকে না নিয়ে একা এসেছো বলে তোমাকে অপমান করেছি। বাবা যে নিজেই আসতে চায়নি, সে কথা আমাকে বলেছো, বলেছে যে বাবা ভালো আছে, তারপরও আমি বিশ্বাস করিনি যে বাবা ভালো আছে। তুমি ভালো আছো, বাবা ভালো নেই, এই বিশ্বাস নিয়েই ছিলাম আমি। আমার বিশ্বাস থেকে কেউ আমাকে নড়াতে পারেনি। সেই মিথ্যে জগৎ আমার ভেঙে চুর্ণ হয়ে গেল। কী বলে সান্ত্বনা দেব আমি আমাকে!
জীবনে প্রথম কোনও অপারেশন তোমার। ছোটদা তার এক বন্ধুর কাছ থেকে টাকা ধার করে চিকিৎসার খরচ দিচ্ছে, তাকে বলা আছে সব খরচ আমি মেটাবো। তুমি তো জানো সব। তোমার কি একবারও রাগ হয়নি, চিকিৎসার খরচ কেন বাবা দেবে না? বাবা এসেছে ঢাকায় অসুস্থ তোমার পাশে থাকতে, এটাই তোমাকে সব ভুলিয়ে দিয়েছে। বাবার মতো মানুষের এইটুকু ভালোবাসা পেয়েই বোধহয় ধন্য হলে। এত ক্ষমা জানি না কেমন করে করতে পারো তুমি।
অপারেশন যেদিন হচ্ছে, সেদিন আমি দিন রাত ফোন করছিলাম মা। দাদা, ছোটদা, বাবা সবার কাছ থেকে জানতে চাইছিলাম কী ঘটছে। এমনকী সার্জনের সঙ্গেও কথা বলেছিলাম। অপারেশন করে টিউমার বার করে তারপর বায়োপসি করতে হবে। যদি ওই টিউমারটি সাদাসিধে না হয়ে ম্যালিগনেন্ট হয়, যদি কারসিনোমাই হয়, বা ক্যানসারই হয়, তবে মেটাসটাসিস হয়নি তো! সাধারণত কোলন থেকে লিভারে মেটাসটাসিস হয়। লিভারের সবপরীক্ষা করানো হয়েছে। ডাক্তার বলে দিলেন, একেবারে পারফেক্ট আছে লিভার। কিডনি, হার্ট সব ঠিক আছে। কোথাও কোনও সমস্যা নেই। ডাক্তারের কথা সমুদ্রে ডুবে যেতে থাকা মানুষের জন্য খড়কুটোর মতো। রক্তপরীক্ষায় দেখা গেছে তোমার ওই এক কোলন ছাড়া শরীরের কোথাও কোনও অসুখ নেই। ডাক্তার বললেন, এই ক্ষেত্রে একটা র্যাডিক্যাল সার্জারি করতে হবে। অসুস্থ কোলনের আশেপাশে যা কিছু আছে, সব কেটে বাদ দিতে হবে। যখন তোমার অপারেশন হচ্ছিল, মামা খালারাও এসেছিলো। তোমার রক্তের দরকার হবে, ছটকু, শরাফ মামা সব দাঁড়িয়ে ছিল তোমাকে রক্ত দেওয়ার জন্য। তুমি দেখতে পাচ্ছো তোমার অনেক আত্মীয়কে। এত আদর করে তোমার সঙ্গে বোধহয় আগে কেউ কথা বলেনি। অপারেশন হল সাড়ে চার ঘণ্টা ধরে। আমি ফোন নিয়ে বসে আছি। অপেক্ষা করছি অপারেশন কেমন হলো, টিউমারের আকার আকৃতি চরিত্র স্বভাব কেমন, সেইসব খবর শোনার জন্য। কী যে অস্থির সেই অপেক্ষা। পায়চারি করছি ঘরময়। জল খাচ্ছি ঘনঘন, চোখের জল মুছছি ঘনঘন। শেষ পর্যন্ত ডাক্তার জানালেন খবর। আমি বাকরুদ্ধ বসে রইলাম সে খবর পেয়ে। অবিরল চোখের ধারাকে আমি বন্ধ করতে পারছিলাম না। ডাক্তার জানালেন, সাড়ে চার ঘণ্টা ধরে তোমার যা কিছু আছে পেটে সব কেটে বাদ দিয়ে, ক্ষুদ্রান্ত্রের, বৃহদন্ত্রের প্রায় সব ফেলে দিয়ে শুধু পাকস্থলির সঙ্গে সামান্য বৃহদন্ত্র জোড়া লাগিয়ে দিয়েছে। লিম্ফ নোড টোড সব ফেলে দিয়েছে। আশেপাশে যা থাকে, সব সাফ করার পর পেট সেলাই করার আগে লিভারটা হাত দিয়ে পরখ করেছে, দেখেছে তিনটেনড়ল। তার মানে লিভারে ধরে গেছে ক্যানসার। লিভারে যদি ধরেই যায়, তখন এভাবে সব ফেলে অপারেশন করতে হয় না। তখন খুব দ্রুত শুধু অন্ত্রের টিউমারটা বের করে পেট সেলাই করে দিতে হয়। দীর্ঘক্ষণ অপারেশন করা মানে, রক্ত দেওয়া মানে ক্যানসারকে সারা শরীরে ছড়িয়ে দেওয়া। ডাক্তাররা তাই করেছেন বাংলাদেশে। তোমাকে বাঁচানোর বদলে তোমাকে মেরেছেন। সবার শেষে নয়, পেট খুলেই অপারেশন শুরু করার আগে তাঁদের উচিত ছিল তোমার লিভার পরীক্ষা করে দেখা। তাই দেখেন যে কোনও অভিজ্ঞ ডাক্তার। কিন্তু ওঁরা ল্যাবরটরির লিভার পরীক্ষার ফলের ওপর ভরসা করে তোমার লিভারটা ওই বিরাট অপারেশন শুরু করার আগে পরখ করে নেননি। ওঁদের লিভার টেস্ট ভুল রিপোর্ট দিয়েছে মা। তুমি তো শুয়ে আছো, তুমি তো জানো তোমার এতদিনে চিকিৎসা হল, তুমি সুস্থ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কী যে ভয়ংকর ভুল চিকিৎসা হল তোমার, তুমি জানো না। তুমি জানো না তোমার ক্যানসার হয়েছে। জানো তোমার ওই অসুখটা সারার সব ব্যবস্থা করা। হচ্ছে। রক্ত দেওয়া হচ্ছে। ইন্টারনেট ঘেঁটে মেডিক্যাল জার্নাল যোগাড় করে তোমার অসুখ নিয়ে যত তথ্য আছে, সবপড়েছি। ভুলে যাওয়া ডাক্তারি বিদ্যেকে আবার ঝালিয়ে নিতে বিভিন্ন হাসপাতালের ওয়েব সাইট আমাকে সাহায্য করে। সারাদিন নেটেই ঝুঁকে থাকি। কোলন ক্যানসারকে খুব ভালো ক্যানসার হিসেবে বিচার করা হয়। যখন অন্ত্রে কোনও পলিপ দেখা দেয়, সেই পলিপ থেকে রক্তক্ষরণ হতে থাকে। সেই পলিপটাকে কেটে বিদেয় করে দিলেই পলিপ আর ক্যানসারে পরিণত হয় না। কিন্তু তোমার অন্ত্রের পলিপকে কেউ আমরা বিদেয় করতে সাহায্য করিনি। অচেনা অজানা কত শত মানুষেরপলিপ বিদেয় করেছি, মানুষকে বাঁচিয়েছি। পলিপ বহু বছর নেয় বড় হতে। খুব ধীরে ধীরে বড় হয়। রক্ত যায়, লোকে পাইলসের রক্ত ভেবে ভুল করে। কোলন ক্যানসার আগেভাগে চিকিৎসা করলে সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা অন্য যে কোনও ক্যানসারের চেয়েও বেশি। তুমি ওই যে অত দীর্ঘদিন কাটালে আমার কাছে, ওই সময় যদি ওই সুইডেনের গাধা-ডাক্তাররা ধরতেপারতো তোমার অসুখ, তুমি বাঁচতে, তখনও লিভারেনিশ্চয়ই এই সর্বনাশা রোগটি গিয়ে বাসা বাঁধেনি। মেটাসটাসিস না হলে, রোগটা কোলন থেকে বাইরে না গেলেও তো অন্তত কেমোথেরাপি দিয়ে দিয়ে ভালো থাকতে পারতে। কিছুই তুমি জানো না এসবের। সত্য লুকোনো হয়েছে তোমার কাছে। তোমাকে বলা হয়েছে, যে, অপারেশনের পরই তুমি ভালো হয়ে উঠবে।