.
মা, তুমি আমার কাছে তোমার অসুখের চিকিৎসা করাতে এসেছিলে। অসহায় চোখে তাকিয়েছিলে যেন চিকিৎসা করি। ভিক্ষে চাইছিলে। চিকিৎসা ভিক্ষে চাইছিলে আমার কাছে, মা। যেন সুস্থ করে তুলি তোমাকে। না মা, তোমাকে আমি কিছুই করিনি। আমাকে আর কোনও বিরক্তি দিতে তুমি চাওনি। আর কোনও অসুবিধে, অশান্তি দিতে তুমি চাওনি। বুঝেছো যে অসুখ নিয়েই তোমাকে চলে যেতে হচ্ছে। তিনমাস আমার কাছে থেকেও, আমাকে বারবার অসুখের কথা বলেও দেখেছো কোনও লাভ হয়নি। আমি তোমার অসুখের কোনও উপসর্গকে কোনও উপসর্গ বলেই মনে করিনি। দেখলে আমি আমার লেখালেখি নিয়ে ব্যস্ত। দেশ ছাড়ার পর লিখিনি কিছু, বসে বসে সময় কাটিয়েছি, আর যেই না তুমি এলে, দিন রাত লেখা নিয়ে পড়ে থেকেছি। তুমি দেখলে আমার অন্যরকম বিদেশি জীবন নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত আমি। আমার ব্যস্ততায় তুমি ব্যাঘাত ঘটাতে চাওনি। চলে গেলে। যেতে বাধ্য হলে। কী করবে? আমি তো তোমাকে জানিয়ে দিয়েছি তোমার কোনও অসুখ নেই। তুমি দিব্যি সুস্থ। বড় বড় ডাক্তাররা দেখেছে তোমাকে। তোমার মতো ভাগ্য কজনের আছে! তুমি কি এই ভেবেও চলে গিয়েছিলে মা যে তোমার হয়তো সময় আর বেশিদিন নেই! হয়তো চিকিৎসা করাতেও আসেনি। তুমি বুঝতে পেরেছিলে তোমার ভেতরের ভীষণ অসুখটি তোমাকে বাঁচতে দেবে না, তাই তুমি আমাকে শেষ দেখা দেখতে এসেছিলে। আমাকে নিয়ে দেশে ফেরত যেতে চেয়েছিলে। যেন আমি ক্ষমা চেয়ে হলেও দেশে ফিরতে পারি। তুমি সবকিছুতে ব্যর্থ হলে।
মা তোমার তো কোনও শৈশব ছিলো না, কোনও কৈশোর ছিলো না। যখন বলতে, ক্লাস ফোরে যখন পড়ো, বিয়ে হয়ে গেছে, আমি সারাজীবন একবারও ভাবিনি তোমার ওই ন দশ বছর বয়সে বিয়ে হয়েছে। ভাবতাম, তুমি বোধহয় খারাপ ছাত্রী ছিলে, কুড়ি বছর বয়সে চতুর্থ শ্রেণীতে পড়েছে। বিয়ের পর ওই শিশু বয়সে তোমার ওপর শারীরিক কষ্ট গেছে। নিজে শিশু হয়ে শিশু জন্ম দিয়েছো। অভাবে অনাহারে কাটিয়েছে। স্বামী ডাক্তারি পড়ছে। তোমার বাবার দয়া দাক্ষিণ্যে তুমি বাঁচছো। শিশুর কোলে শিশু। যৌবনে পৌঁছেলে যখন, দেখলে স্বামী আসক্ত অন্য রমণীতে। কোনওদিন তোমার ভালোবাসা কী জিনিস জানা হয়নি। তোমার জীবনের কথা ভাবলে আমি কেমন শিউরে উঠি আজকাল। চারদিকে তাকিয়ে দেখি তোমার মতো অসহায়, তোমার মতো দুর্ভাগা আর দ্বিতীয় একটি মানুষ পৃথিবীতে আছে কী না। নেই মা। বস্তিতে বাস করা মেয়েগুলোও তোমার চেয়ে অনেক সুখী। তারাও কারও না কারও ভালোবাসা পায়, আদর পায়। ঘুঁটে কুড়োনি মেয়েরাও আমোদ আহ্লাদ করে। ইট ভাঙার কাজ করে যে মেয়েরা, তারাও নিজেরপয়সায় নিজের যা খুশি তাই করার সুযোগপায়। ভিখিরি মেয়েরাও তোমার মতো অসহায় নয়।
তুমি চলে যাওয়ার পর বেশিদিন থাকিনি সুইডেনে। নিউইয়র্কে গিয়ে ইয়াসমিন যে দালানে থাকে সেই দালানেরই সাত তলায় একটা অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া নিলাম। গীতা আমাকে অনুরোধ করছিল অনেকদিন থেকেই, সেই সুইডেনে থাকাকালীনই, যেন সুহৃদকে নিয়ে যাই আমার কাছে। গীতা নাকি আর পারছে না ওকে রাখতে, ভাবতে পারো মা, যে সুহৃদকে কোনওদিন আমাদের কাছে আসতে দিত না, এখন সে স্বেচ্ছায় ওকে দিয়ে দিতে চাইছে, যেন নিয়ে যাই, যেখানে খুশি সেখানে। সুহৃদ থাকতে শুরু করলো আমার সঙ্গে। ওর জন্য জীবন প্রায় উৎসর্গ করলাম। সেই ছোট্ট সুহৃদ পাঁচ/ছ বছর বয়স অবদি অবকাশে বড় হয়েছে। তারপর তো ওকে ছিনিয়ে নিয়েছিলো ওর বাবা মা। কিন্তু বুঝি যে সুহৃদ এর মধ্যে অনেকটাই পাল্টে গেছে। পনেরো বছর বয়স, ভালো শিক্ষা পায়নি বলে বেয়াড়া, বেপরোয়া, বেয়াদপ হয়ে বেড়ে উঠেছে। আমার কাছে আছে বটে সুহৃদ, কিন্তু আমার কোনও উপদেশ শোনার তার কোনও ইচ্ছে নেই। বুঝি যে, সময় অনেকটাই চলে গেছে। সুহৃদ যদি তার বাবার কাছে বাংলাদেশে থাকে, তবেই হয়তো পড়াশোনা করে বড় হতে পারবে। পড়ার কোনও ইচ্ছে আমি দেখি না সুহৃদের আছে। আসলে আমি হয়তো তাকে আগের মতোই দেখতে চেয়েছিলাম। অবকাশের সেই সুহৃদকে চেয়েছিলাম দেখতে। ইওরোপে ছিলাম, কিন্তু যখনই আমেরিকায় এসেছি সুহৃদকে নিয়ে ওয়াশিংটন ডিসি, ম্যারিল্যান্ড, পেনসিলভেনিয়া, বাফেলো, নায়াগ্রা, ফ্লোরিডায় বেড়াতে নিয়ে গিয়েছি। ডিসনি ওয়ার্ল্ড, স্মিথসোনিয়াম, হেরিটেজ মিউজিয়াম, মেট্রোপলিটন, মডার্ন আর্ট মিউজিয়াম, সব দেখিয়েছি, ছেলেটার যেন মন ভালো থাকে, যেন জ্ঞান বিজ্ঞানে আকর্ষণ বাড়ে। ছোটদাকে বলি সুহৃদকে বাংলাদেশে নিয়ে নিজের কাছে রাখতে। ইয়াসমিন ছোটখাটো একটা কাজ করে, বড় কাজ আর ভালো কাজ করতে বারবার বলেও কোনও কাজ হয় না, ওর আত্মবিশ্বাস শূন্যতে এসে দাঁড়িয়েছে। ওর নিজের ওপর সামান্যও আর বিশ্বাস নেই। ভালোবাসাকে ছেড়ে দূরে কোথাও যাবে না। ঘরের কাছে ছোট কাজ, ছোট কাজ করেই ওর স্বস্তি। ভালোবাসাকে ইস্কুলে দিয়ে আসে, ইস্কুল থেকে নিয়ে আসে। রান্নাবান্না করে, ঘরে থাকে। আমার সঙ্গে যেরকম দেখা হবে ভেবেছিলাম, হয় না। ও কদাচিৎ আমার কাছে বেড়াতে আসার মতো আসে। কেন ঠিক এরকমটি হয়, জানি না। ওর অ্যাপার্টমেন্টে বাড়তি ঘর নেই বলে আমাকে ভাড়া নিতে হলো নতুন অ্যাপার্টমেন্ট। একটা সংসারে যা যা থাকা দরকার সব কিনে নিলাম। বিছানা, সোফা, ডাইনিং টেবিল, ডেস্ক, বুকশেল্ফ, চেয়ার, কমপিউটার, আলমারি, রান্না ঘরের ক থেকে চন্দ্রবিন্দু। জীবনে যে কতবার সংসার সাজাতে হল মা! বিদেশ বিভুইয়ে দুটো মাত্র বোন দেশ ছেড়ে, নিজেদের ঘরবাড়ি ছেড়ে পড়ে আছে, সেখানেও আলাদা থাকতে হয়! কী জানি, জানি না, কষ্ট কেন হয়। বুঝি যে ইয়াসমিন আমার মতো একা থাকেনা। একটা সংসার আছে ওর। কিন্তু ওর স্বামী সন্তান নিয়েই তো ঢাকায় আমার কাছে থাকতো। বিদেশ কি তবে আমাদের সবাইকে আলাদা করে দিল! দেশের আত্মীয়দের থেকে আলাদা, এমন কী বিদেশেও পরস্পর থেকে আলাদা, নিজেদের মধ্যেও দাঁড়িয়ে গেছে শক্ত দেয়াল। কে এই দেয়াল দাঁড় করায়, সময় নাকি অন্য কিছু! এই ব্যবধান, এই বিচ্ছেদ, এই বাধা, এই বিদেশ আমার মানতে ইচ্ছে করে না। মাঝে মাঝে চিৎকার করে মনে হয় কাঁদি। ভালো যে আমি কোনও পুরুষের সঙ্গে সংসার পাতিনি, তাহলে বোধহয় আমিও আর সবার মতো বৈষয়িক হয়ে যেতাম। আমার জগৎ সংসার ওই চার দেয়ালের মধ্যেই খাবি খেতো। তুমি থাকাকালীন কিছু না এলেও তুমি দেশে ফিরে যাওয়ার পর পরই আমার আমন্ত্রণ আসাও শুরু হলো বিভিন্ন দেশ থেকে। নিউইয়র্ক থেকেইতালি যাচ্ছি, স্পেন যাচ্ছি, ফ্রান্স যাচ্ছি, অস্ট্রিয়া যাচ্ছি, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে। যেদিন অস্ট্রিয়া থেকে নিউইয়র্ক ফিরে এলাম, সেদিন ফোন এলো ঢাকা থেকে। ছোটদা বললো, তুমি নাকি কিছু আর খেতে পাচ্ছিলে না, কিছু মুখে নিলেই বমি হয়ে যাচ্ছিল। ডাক্তার দেখিয়েছে, ডাক্তার বলেছে কোলোনোস্কোপি করতে। কোলোনোস্কপি করারপর খুব বড় টিউমার পাওয়া গেছে পেটে। বায়োপসির রেজাল্টও এসে গেছে। আমার হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছিল, শুধু জিজ্ঞেস করলাম, ডায়াগনসিস কী লিখেছে? ছোটদা অসুখের নাম বললো, কোলনকারসিনোমা। তার মানে? তার মানে তোমার ক্যানসার হয়েছেমা। ক্যানসার। শুনে বিশ্বাস করো, দুনিয়া দুলতে শুরু করলো আমার সামনে। সারা জীবনে কি এর চেয়ে বড় কোনও দুঃসংবাদ আমি শুনেছিনাকি শুনবো! এই ক্যানসার নিয়েই তুমি আমার কাছে এসেছিলে মা, এই ক্যানসারকেই তুমি বলেছিলে খুব বড় এক অসুখ, ঠিক যে জায়গাটায় ক্যানসার, পেটের সে জায়গাটা তুমি আমাকে অনেক অনেক বার দেখিয়েছে, আমি তোমাকে বলেছি ও কিছুনা, বার বার বলেছিও কিছুনা, একটু বোধহয় তোমার খাদ্যনালীর চামড়ায় কিছুর ঘসা টসা লেগেছে, তাই ব্যথা। নিজের মেয়ে বলেছে তোমাকে। যে মেয়েকে আদর যত্ন করেছে ডাক্তারি যখন পড়েছে, বছরের পর বছর তার আদেশ আবদার সব মেনেছো, আদরে ভরিয়ে রেখেছো। তুমি বুঝতে পারছো, তোমার বড় কোনও অসুখ হয়েছে, তোমার আদরের ডাক্তার মেয়ে তা বোঝেনি। এতদিন থেকেছিলে আমার কাছে, আমি তোমাকে বুঝতে চেষ্টা করিনি। চেষ্টা করিনি বলে আমাকে একটুও চাপ দাওনি চেষ্টা করার জন্য। বাবা তোমাকে কোনও টাকা পয়সা দেয় না, দাদার দেবার তো প্রশ্ন ওঠে না, ছোটদা তো নেবে আরও, দেবে কী, যাদের ভূরি ভূরি আছে তাদেরই যখন আমি ঢেলে দিচ্ছি, তখন তোমাকে শূন্য হাতে ফেরত পাঠালাম। দেশে ফিরে তোমার সেই সমস্যাগুলো ক্রমশ বাড়ছিল মা। পরে সব জেনেছি যে বাড়ছিলো। তুমি ঢাকায় একা, তুমি অসুস্থ, তুমি খেতে পারছে না, যদিখাও কিছু, বমি হয়ে যাচ্ছে। ওইশরীর নিয়েই তুমি ময়মনসিংহে গেলে বাসে। এই বাসে করেই তো তুমি বাবার কাছ থেকে চাল ডাল তেল নুন নিয়ে ঢাকা এসেছে। অসুখ শরীরেও এসব তোমাকে করতে হয়েছে। ছোটদাকে রান্না করে খাওয়াবে। তুমি তার দায়িত্ব না নিলে নেবে কে? যখন আর পারছে না, হাতে কোনও টাকা নেই ঢাকায় কোনও ডাক্তার দেখানোর, তুমি ময়মনসিংহে গিয়ে বাবাকে বললে অসুখের কথা। কিছু খেলেই বমি হচ্ছে, পেট ফুলে আছে, ব্যথা হচ্ছে প্রচণ্ড। শুনে বাবা কটমট করে তোমার দিকে তাকালো। চেম্বার থেকে, যে চেম্বারে বসে রোগী দেখছিল, তোমাকেদূরদূর করে তাড়ালো। জ্বর কফ কাশির রোগীদের যত্ন করে দেখলো, তোমাকে দেখলো না। কেন ময়মনসিংহে এসেছো, ঢাকায় ছোটদার খাওয়া দাওয়ার অসুবিধে করে তোমাকে কে আসতে বলেছে ময়মনসিংহে, প্রচণ্ড গালাগালি খেলে তুমি। তোমার এই অসুখটসুখের কথা শুনতে ইচ্ছে করে না তার। বাবা বাড়ি ফিরলেও বারবার বলেছো, তোমার পেটের ভেতর কিছু একটা ভয়ংকর লুকিয়ে আছে। তাতে বাবার কী আসে যায়! বাবা জিজ্ঞেস করছিল, আমার কাছ থেকে কত টাকা এনেছো। তুমি যতবারই বলেছে যে আমি তোমাকে কোনও টাকা দিইনি, বাবা বিশ্বাস করছিল না, ভেবেছিলো তুমি মিথ্যে বলছে, বলেছে নাক মুখ খিঁচিয়ে যে তুমি মিথ্যে বলছে, প্রচুর টাকা নাকি আমি দিয়েছি। আল্লাহর কসম কেটে বলেছে, কোরান ছুঁয়ে বলেছে, কেঁদে কেঁদে প্রায় পায়ে পড়ে বলেছো যে না তোমার কাছে কোনও টাকা নেই, আমি তোমাকে একটি পয়সাও দিইনি। বাবার কী খুব হিংসে হচ্ছিল, রাগ হচ্ছিল! তোমার হাতে টাকা পয়সা থাকুক, তুমি স্বস্তিতে শান্তিতে থাকো, তা কি বাবা কোনওদিন চেয়েছিলো? না, বাবা তোমার কান্নাকে মোটেও কান্না বলে মনে করেনি। তুমি নানিবাড়িতে যাবে, রিক্সায় চড়তে পারো না, রিক্সার ঝাঁকুনিতে তোমার পেটে ভীষণ ব্যথা হয়। দাদাকে অনুরোধ করলে তার গাড়িটা দিয়ে একটু নানিবাড়িতে পৌঁছে দিতে। দাদা সোজা না করে দিল। তোমার অসুখ, তোমার পেটে কোনও কিছু এমনকী জল অবদি থাকছে না, পেটে প্রচণ্ড ব্যথা, তাতে দাদার কিছু যায় আসে না। যতরকম টিপ্পনি আছে, সব কাটলো দাদা। অপমান যতভাবে করা যায় করলো। গাড়ি দিল না তোমাকে। তুমি রিক্সা নিয়েই নানিবাড়ি গেলে। যখন ঝাঁকুনি খাচ্ছিল রিক্সা, তুমি সিট থেকে শরীরটাকে উঠিয়ে রাখলে, ভয়ংকর ব্যথা থেকে বাঁচতে। নানিবাড়িতে তো আর কোনও ডাক্তার নেই। কিন্তু বাড়ির সামনে সুলেখাদের বাড়ি। সুলেখার ছোট ভাই জাহাঙ্গীর ডাক্তারি পড়েছে। সে তো অন্তত বিনে পয়সায় তোমাকে দেখে দেবে। তোমার অসুখটা অন্তত বুঝতে পারবে। মা, তোমার নিজের মেয়ে তোমাকে দেখলো না, তোমার স্বামী দেখলো না, তোমার ছেলেরা দেখলো না। অনাত্মীয় একজন দেখলো। পাশের বাড়ির কেউ দেখলো। জাহাঙ্গীর বললো পেটের একটা এক্সরে করতে। এক্সরে করার টাকা কোথায় পাবে তুমি? কে দেবে টাকা! বাবাকে দাদাকে দুজনকেই বললে, এক্সরে করতে হবে। বাবা তো জাহাঙ্গীরকে অসুখ দেখিয়েছো শুনে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো। তোমাকে প্রায় ঘাড় ধাক্কা দিয়ে অবকাশ থেকে তাড়ায়। অসুখ নিয়ে তোমার বাড়াবাড়ি যে সীমা ছাড়িয়ে গেছে তাই বললো বাবা। এক্সরে করতে হবে! ’দাঁত মুখ খিঁচিয়ে বাবা তোমারপণ্ডিতিকে ব্যঙ্গ করলো। তুমি যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে সব শুনলে মা। এক্সরে করতে অনেক টাকা লাগে। ছটকুর কাছ থেকে কিছু টাকা ধার করে গেলে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ, যে কলেজের অধ্যাপক ছিল তোমার স্বামী, যে কলেজ থেকে পাশ করেছে তোমার মেয়ে, সেই কলেজের হাসপাতালের এমারজেন্সিতে। হাসপাতালে আর সব দরিদ্র রোগীদের সঙ্গে লাইনে দাঁড়িয়ে তুমি পেটের এক্সরে করালে মা। না, এতে তোমার কোনও গ্লানি হয়নি। দরিদ্রদের তুমি কখনও হেলা করোনি। তোমার তো ওদের সঙ্গেই ছিল বেশি ওঠাবসা। এক্সরে বাবাকে দেখাতে গেলে, বাবা দেখলোও না। অন্য কোনও ডাক্তারকে যে এক্সরে দেখাবে, সে টাকা তোমার ছিল না। ছটকুর কাছে লজ্জায় আরও টাকা চাইতে পারোনি। বাড়ির ডাবগাছগুলো থেকে ডাবনারকেল পাড়িয়ে বিক্রি করে দুশ তিনশ টাকা হতো তোমার। সেটাও তো হাতছাড়া হয়ে গেলো। ঢাকা থেকে এসে অবকাশের ডাবওয়ালাকে ডেকে পাঠাতে গিয়ে দেখলে দাদার বউ সব বিক্রি করে দিয়েছে। সে-ই টাকা নিয়ে বসে আছে। সামান্য যে অধিকারটুকু ছিল তোমার অবকাশে, সেটুকুও হাসিনা ছিনিয়ে নিলো। তুমি ফিরে এলে ঢাকায়। শয্যা নিলে। তোমাকে সুস্থ করার কেউ নেই। টয়লেট ভরে রক্ত, বেসিন ভরে বমি –এই চলছে। আর চলছে তোমার কান্না, তোমার অসহায়তা, তোমার ভয়াবহ একাকীত্ব। ছোটদা বিমানের বিদেশ ডিউটি করে এসে একদিন বাড়ির কাছের এক ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলো। ছোটদাই শেষ অবধি তোমার সহায় হল। তোমার প্রচণ্ড অসুস্থ শরীরটাকে কোনওভাবে নিয়ে ফেললো ডাক্তারের চেম্বারে। ওই ডাক্তারই পরীক্ষা করে বলে দিল, ক্যানসার। বারডেমে তোমার অপারেশন হবে। এসবের তো আমি কিছুই জানতাম না মা। পরে শুনেছি। তুমিই বলেছো অসুখ ধরা পড়ার আগে তোমার দুঃসহ দিনগুলোর কথা। বাবা আর দাদার দুর্ব্যবহারের কথা। আমি তো তোমাকে কোনও করিনি। তুমি দেশে ফিরে যাওয়ারপর তোমার ব্যাংকে সরাসরি টাকা পাঠিয়ে দেওয়ার যে কথা ছিল, সেটা পাঠালে তোমাকে তো বাবা আর দাদার কাছ থেকে চিকিৎসা ভিক্ষে করতে হত না, এক্সরে করার জন্য হাত পাততে হত না, নিজেই ডাক্তার দেখাতে পারতে। তোমাকে আমার চেয়ে বেশি আর কে ঠকিয়েছে মা? কেউ না। কেন আমাকে সব বুঝেও ক্ষমা করে দিয়েছিলে মা? আর যাকেই ক্ষমা করো, আমাকে করো না মা। আমি তো নিজেকে ক্ষমা করিনি। আজও করিনি। কোনওদিন করবো না। মা, তোমার অসুখের নামটা জানারপর তুমি যদি দেখতে কীভাবে স্তব্ধ হয়ে বসে থেকেছি, অনুশোচনার আগুনে কী করেপুড়েছি, কীভাবে কেঁদেছি দিনের পর দিন! মা, তোমার সঙ্গে ফোনে কথা বলতে গিয়েও চিৎকার করে কেঁদেছিমা। অপরাধবোধে সেই যে ভুগতে শুরু করেছি, আজও ভুগছি। কী রকম যেন শকুনে খেয়ে যাওয়া কিছুর মতো মনে হয়, যেন বধ্যভূমিতে পড়ে আছি কোনও খুলি, কোনও পাঁজর। বারডেম হাসপাতালের ডাক্তাররা সিদ্ধান্ত নিয়েছে, জরুরি অপারেশন করতে হবে। তোমার নিশ্চয়ই তখন ভালো লাগছিলো এই ভেবে যে, শেষ অবধি চিকিৎসা হচ্ছে। যে রোগের চিকিৎসা তোমার সতেরো বছর ধরে হয়নি, সেটির চিকিৎসা শেষপর্যন্ত হচ্ছে তোমার। হাসপাতালে তখন দাদাও এলো, বাবাও এলো। চারদিকে যত স্বজন আছে, সবাই এলো। তখন সবাই তোমার সেবায় নিয়োজিত। সেবা কিন্তু কোনও টাকা পয়সা দিয়ে সেবা নয়। চিকিৎসার খাতে যা খরচ হয়, সব আমিই দেব, টাকা পয়সার জন্য যেন কোনও কিছু আটকে না থাকে, তা বারবারই বাবা, দাদা, ছোটদা সবাইকে বলে দিয়েছিলাম। তোমাকে জানানো হয়নি কী অসুখ তোমার হয়েছে। শুধু বলা হয়েছে পেটে তোমার টিউমার হয়েছে। ফোনে আমাকে বলছিলে, মাগো, তোমাকে তো বলেছিলাম, বলেছিলাম না পেটে আমার ব্যথা হয়, আর ডাক্তার যখন পেটে চাপ দিয়েছিলে, আমি উ করে উঠেছিলাম ব্যথায়। তোমার মনে আছে? মনে আমার থাকবে না কেন মা? মনে না থাকার কোনও তো কারণ নেই। এই নিয়েই তো কত অশ্রদ্ধা করেছি তোমাকে, ভেবেছি বানিয়ে বানিয়ে অসুখের গল্প করছো। বলেছি ওইসব ফালতু ব্যথা ট্যাথার কথা ভুলে ডায়বেটিস নিয়ে ভাবো, ওটিই আসল রোগ। তুমি কী কম দীর্ঘশ্বাস ফেলেছো! সব দীর্ঘশ্বাস এখন আমি ফেলছি মা। যে তুমি ভিখিরির মত নিঃসঙ্গ ছিলে, তোমার ভয়ংকর অসুখটিকে শুধু সঙ্গী করে, সেই তুমি আর একা নও। এখন তোমাকে দিব্যি ঘিরে আছে তোমার আত্মীয় স্বজন। এতকাল একা একা ভুগেছো, এখন তোমারপাশেপরিবারের সবাই এসে দাঁড়িয়েছে।