যতদিন ছিলে আমার সঙ্গে, কিছুই দেখনি তুমি, আমার খ্যাতি, প্রতিপত্তি, যশ, কিছুই। কোনও দেশ থেকেও আমার জন্য কোনও আমন্ত্রণ আসেনি। আমি যে কত দেশে বক্তৃতা করেছি, কত সম্মান পেয়েছি, কত পুরস্কার, কিছুই তোমার নিজের চোখে দেখা হয়নি। ওসবে তোমার আগ্রহ খুব বেশি নেই। তুমি মনের খবর নিতে চাও। ভালো আছি তো। সুখে আছি তো। আমার সুখ দেখতে চাও তুমি। আর কিছু না। আমার ভালো লাগতো না একটুও, যে, তুমি দেখছো না মানুষ কী করে কত হাততালি দেয় আমার বক্তৃতা শুনে। একটা কোনও স্বর্ণপদকও পেতে দেখনি। কী দেখেছো মা তুমি? বাবা তো দেখেছিলো অনেক, আমার সঙ্গে দেশও ঘুরেছিলো অনেকগুলো। আমার বাবা বলে বাবাকেও অনেক সম্মান করেছে মানুষ। তুমিই সম্মান পাওনি। তোমাকেই কোথাও নিয়ে যেতে পারেনি। অন্য লোকের বাড়ির নিচতলায় পড়ে ছিলে, যতদিন ছিলে। আমি যে ঠিক স্বনির্ভর নই, দেখে গেছে। আমার মতো একশ ভাগ স্বনির্ভর মানুষকে পরনির্ভর হতে দেখে তোমার খুব দুঃখ হয়েছে সম্ভবত। একবার, রোজার সময় তোমাকে বলেছিলাম চল তুরস্ক থেকে ঘুরে আসি। ওটা মুসলিম দেশ, রোজা রাখতে পারবে। তুমি রাজি। কিন্তু একটা গরিব দেশের পাসপোর্ট বহন করছে বলে তোমাকে তুরস্কের ভিসা দেওয়া হল না। আমরা ফিরে এলাম ঘরে। তোমার মন খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল। আমার হাতে রাষ্ট্রপুঞ্জের ট্রাভেল ডকুমেন্ট। বাংলাদেশ ছাড়া আর সব দেশে ভ্রমণ করার অধিকার আমার আছে। তুরস্কেও যেতে পারি। কিন্তু তোমার পাসপোর্টে ভিসাই দেওয়া হবে না তোমাকে। নিয়ম হলো ভিসা নিজের দেশ থেকে সংগ্রহ করতে হয়, অন্য দেশ থেকে ভিসা হয় না। কিন্তু মা, বাবাকে এই সুইডেন থেকেই জার্মানির ভিসা, ডেনমার্কের ভিসা, ইংলন্ডের ভিসা তখন করিয়ে দিয়েছিলাম। ওসব জায়গায় সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলাম। আসলে সরকার থেকে বা বড় কোনও প্রতিষ্ঠান থেকে যখন আমন্ত্রণ জানানো হয়, তখন বস্তাপচা নিয়ম কানুনগুলো খাটে না। এত যে বিদেশের নিয়ম কানুনের সতোর প্রশংসা করে মুখে ফেনা তুলে ফেলি, একটু তলিয়ে দেখলেই তো দেখি, মামা কাকার জোর এখানেও খাটে। সরকারের লোক সাহায্য করলে এখানেও অসম্ভবকে সম্ভব করা যায়। তুমি আমাকে দেখেছো পরনির্ভর তোমার মতোই, আমার সেই জেদ তেজ, আমার সেই অহংকার, আত্মবিশ্বাস, আশ্চর্য সৌন্দর্য, সেই প্রাণ, সেই প্রতাপ কিছুআর নেই। পথে যখন বেরোই, আমি সেই আমি নই যাকে একশ লোকে চেনে। দেখেছো কেউ হয়তো কনুই ঠেলে চলে গেল। এত যে লোক ছিলো, রাস্তায় আমি হাঁটলে কাছে এগিয়ে আসতো, তুমি যতদিন সঙ্গে ছিলে, কেউ আসেনি আমার কাছে। আমি আর তুমি বরফ ছাওয়া রাস্তায় হেঁটেছি, ধনী সাদাদের দেশে দরিদ্র কালোরা যেভাবে হাঁটে, সেভাবে পায়ে পায়ে আড়ষ্টতা, হীনম্মন্যতা, সংশয়, শংকা। অন্তত আমি হেঁটেছি ওভাবে, তোমার ভেতরে কালো সাদা নিয়ে আমি কোনও রকম হীনম্মন্যতা দেখিনি। তুমি যে আন্তরিক স্বরে কালোদের সঙ্গে কথা বলো, সাদাদের সঙ্গে একই স্বরে বলো। তুমি সাদা শরীর যেরকম হৃদয় দিয়ে স্পর্শ করো, কালো বা বাদামি শরীর একই ভাবে করো। সাদাদের বেশি আদর করার, বা তাদের বড় মনে করার কোনও রকম প্রবণতা তোমার মধ্যে দেখিনি। এত আধুনিক তো আমিও সামান্য হতে পারিনি মা।
একসময় সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, সুয়েনসনের সঙ্গে কোনও কিছু নিয়ে কথা কাটাকাটি হওয়ায় সম্ভবত, যে, ওর গাড়ি আর ব্যবহার করবো না। এই সিদ্ধান্তটি তুমি থাকাকালীন ভয়াবহ শীতকালটায় না নিলেও পারতাম। তুমি চলে যাওয়ার পর সিদ্ধান্ত তো ঠিকই বদলেছিলাম। তোমাকে নিয়ে বাইরে বাজার করতে গিয়েছি বাসে চড়ে, পিচ্ছিল বরফে পায়ে হেঁটে। ওই জমে যাওয়া ঠাণ্ডায় বের করে করে তোমার নিউমোনিয়া বাধিয়ে ফেললাম। মা, খুব কষ্ট দিয়েছিলাম তোমাকে। আমি ট্যাক্সি নিতে পারতাম। কিন্তু নেবো কেন? তুমি সুইডেনে আসারপর হাড়কিপ্টের মতো হঠাৎ টাকার হিসেব করতে শুরু করেছিলাম মা। জানি না কেন, তুমি বলেই কী? আমি তো অঢেল টাকা পাঠাচ্ছিলাম অনেককে। কলকাতার এক বন্ধুকে গাড়ি কেনার টাকা, বাবাকেও গাড়ি কেনার টাকা, মাঝে মাঝে অকারণে টাকা, সুহৃদকে থিয়েটার, কনসার্ট ইত্যাদি দেখার জন্য, বড় বড় রেস্তোরাঁয় খাওয়ার জন্য, জমিয়ে কালচার করার জন্য টাকা। সুহৃদের টাকা পাঠাতাম ওয়ারেন নামে আমার এক আমেরিকার বন্ধুর কাছে। ওকে দায়িত্ব দিয়েছিলাম সুহৃদকে মানুষ করার জন্য বা মস্ত একটা আঁতেল বানানোর জন্য।
.
আমাকে নিতে এসেছিলে, ফিরে গেছো একা। খালি হাতে। এ নিয়ে তোমার দুঃখ ছিল। আমার ছিল না। জাতিসংঘের পাসপোর্টে বাংলাদেশ যাওয়া যাবে না, এ কথা বলে তোমার সব ইচ্ছেকে দুমড়ে দিয়েছি। তুমি দেশে ফিরে গেলে। আমি রয়ে গেলাম, অন্যের বাড়িতে, অন্যের আশ্রয়ে, অন্যের আদেশ নিষেধ মেনে। অন্যের বাড়িতে বাড়ি ভাড়া দিতে হতো না, কিন্তু বাকি দায়িত্ব ছিল আমার। কেউ দেয়নি সে দায়িত্ব, নিজেই নিয়েছিলাম। বাড়ির জিনিসপত্র কেনা, ঘরে বাইরে খাওয়া দাওয়া, ঘোরাঘুরি, সব আমার টাকায়। মাঝে মাঝে ভাবি, যে টাকা খরচ হতো আমার, তা দিয়ে দিব্যি শহরে কোনও বাড়ি ভাড়া নিতে পারতাম, এবং নিজের মতো করে থাকতে পারতাম। কিন্তু মা, যে দেশের ভাষা জানি না, চেনা মানুষগুলো হাওয়া হয়ে গেছে, সরকারি শুভাকাঙ্ক্ষীগুলোও হাওয়া, তখন কেমন যেন ভয় হতো বিদেশ বিভুইএ একা বাস করতে। অবশ্য হাওয়া কি সত্যিই হয়েছিল? নিজ থেকে কারও সঙ্গে যোগাযোগ করার আমার অভ্যেস ছিল না, ওরা যোগাযোগ করলে তবে যোগাযোগ হবে। ওরা না করলে? আগ বাড়িয়ে আজ অবধি কারও সঙ্গে যেচে কথা বলা আমার পক্ষে সম্ভবহয় না। তুরস্কে তো তোমাকে যেতে দিল না। সুইডেনের কোথাও তোমাকে নিয়ে যাওয়া হয়নি। শুধু স্টকহোম শহরটা দেখেছে। ফিনল্যান্ডে নিয়ে যাবো তোমাকে, জাহাজে করে সারারাতে যাবো, সারাদিন হেলসিংকি শহরে ঘুরে ফিরে আসবোপরদিন, এই সিদ্ধান্ত নিলাম একদিন। তোমাকে নিয়ে যা কিছু করছি, রাজি তো তুমি হচ্ছই। যা কিছু করতে ইচ্ছে হয় করে যেন ফিরে যাই দেশে তোমার সঙ্গে, দেশে। ফিনল্যাণ্ডে যাওয়ার তিনটেটিকিট কাটলাম। সুয়েনসনকেও সঙ্গে নিয়েছিলাম। গাব্রিয়েলা নামের বিশাল জাহাজটি দেখে তোমার খুব ভালো লেগেছিলো। কিন্তু সকালে হেলসিংকিতে যখন থামলো জাহাজ, কী আশ্চর্য সবাই তরতর করে নেমে যাচ্ছে জাহাজ থেকে হেলসিংকি শহরে, শুধু আমার আর তোমার পাসপোর্ট দেখতে চাওয়া হল। জাহাজ ভর্তি লোক সবাই সাদা, শুধু আমার আর তোমার রংই অসাদা। সুয়েনসন পার হয়ে গেছে। আমিও জাতিসংঘের পাসপোর্ট দেখিয়ে পার পেয়ে গেলাম। কিন্তু তোমাকেই বাধা দেওয়া হল। তোমাকে স্পর্শ করতে দেওয়া হবে না ফিনল্যান্ডের মাটি। হায় মাটি, কত যে পবিত্র মাটি! তোমার মতো পাপী মানুষের পা সেখানে রাখতে দেওয়া যাবে না। পাপ করেছে গরিব দেশে জন্মে মা। সুয়েনসনকে বলেছিলাম, তুমি বলো যে তোমার সঙ্গে মাকে এনেছো। বললে, আমার বিশ্বাস ইমিগ্রেশনের লোকেরা তোমাকে শহর দেখতে যেতে দিত। তুমি নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছো, সুয়েনসন কিছু বলতে চায়নি। শত অনুরোধেও সে মুখ খোলেনি। এরা এমনই মা, ভেতরে ভেতরে সবাই বোধহয় বর্ণবাদী, শুধু বর্ণবাদীই নয়, ভীতু, হিংসুক, স্বার্থপর। অনেক তো দেখা হল, উদার মানুষ যে নেই তা নয়, প্রচুর আছে। আমার কপালেই শুধু জোটে এসব। আমি বেরোলাম জাহাজ থেকে, আর লোকটি হনহন করে চলে গেল আগে আগে। আমি তাকে পেছনে বারবার ডেকেও থামাতে পারিনি। দুপুরের জন্য কিছু খাবার কিনে, খাবার আর কী, কিছু স্যান্ডুইচ কিনে নিয়ে এলাম। হেলসিংকি শহরে আগে আমি এসেছি। সরকারি আমন্ত্রণে, লেখকদের আমন্ত্রণেও। একা একা দেখা শহর আবার নতুন করে দেখার কোনও ইচ্ছে আমার ছিল না। খুব ক্ষিধে পেয়েছিলো তোমার। বসে থেকেছো নতুন একটি দেশের নদীর কিনারে। জাহাজের ছোট ঘরে। কিছুই তোমার দেখা হয়নি। রাতে তোমাকে খেতে নেবো জাহাজের রেস্টুরেন্টে, অপেক্ষা করছি সুয়েনসনের। সুয়েনসন উদয় হল, তাকে নিয়ে রেস্টুরেন্টে গেলাম। চক্ষুলজ্জা নেই লোকটির, আমার টাকায় জাহাজে এলো, আমার টাকায় দিব্যি খেলো, যত দামি খাবার মন চায়, খেলো। সারাদিনের জন্য যে হাওয়া হয়ে গিয়েছিলো আমাদের একা ফেলে, একটুও কিন্তু অনুতাপ করলো না। তুমি উদার, তোমার উদারতা আমার রক্তে। কিন্তু সুয়েনসনের মতো লোক উদারতার বিন্দুমাত্র পায়নি কোথাও থেকে। এভাবেই তুমি আর আমি মানুষকে উজাড় করে দিয়ে যাই। আমি পৃথিবীর আর সবার প্রতি উদার হলেও তোমার প্রতি নই। আর তুমি কী না বলো আমি তোমাকে ভালোবেসেছি! জাহাজেও তুমি খেতেপারছিলে না। বমিভাব ছিল। বমি হয়তো করেওছিলো কিছু খেতে গেলেই বলতে একেবারে গলা পর্যন্ত ভরে আছে, ক্ষিধে নেই। আমার কি একবারও সন্দেহ হতো, যে তোমার পেটে হয়তো সত্যিই কোনও অসুখ আছে! না, মা, হতো না।