আমি তোমার কত কিছুই বুঝিনি মা। মাইকেল যেদিন তার মার বাড়িতে নিয়ে গেল আমাদের, যেহেতু তার মার আলজাইমার অসুখ, দূর অতীতের কথা মনে থাকলেও কাছের অতীতের কথা ভুলে যান, একই কথা বার বার যখন বলছেন, চায়ে চিনি দেবেন কী দেবেন না, এক বিস্কুট তোমাকে অন্তত পঁচিশবার নিতে বললেন, তুমি না শব্দটিও পঁচিশবার বলেছো, একটুও বিরক্ত হওনি। চা খাওয়ার মাঝখানে একবার তুমি বাথরুমে গেলে। বাথরুম থেকে মলিন মুখে এসে বসার পর জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছে? বমি? তুমি স্নান হেসে মাথা নেড়েছিলে। না। হয়নি বমি। কিন্তু মা, তোমার তো ভীষণ রক্ত গিয়েছিল। একই রকম ব্রাসেলসের হোটেলেও কমোড ভরে রক্ত গিয়েছে। আমাকে বলোনি কিন্তু কিছুই বলোনি আমাকে, লুকিয়ে রেখেছে। যাবার আগে আমাকে আর বিব্রত করতে চাওনি। তুমি এই যে আমাকে নিতে এসেছিলে, বলেছিলে আমাকে ছাড়া তুমি দেশে ফিরবে না, তোমার এই আবদারকে আমি ছেলেমানুষি ভেবেছিলাম, আর সবার মতো, বাবা, দাদা, ছোটদা সবার মতো। তুমি কিন্তু একে ছেলেমানুষি বলে ভাবোনি। তোমার নিজের জীবনের চেয়েও তোমার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল আমার দেশে ফেরা। তাই ভেঙে গেলে, টুকরো টুকরো হয়ে গেলে, নিঃশেষ হয়ে গেলে, আমাকে তুমি শত চেষ্টা করেও দেশে ফেরাতে পারোনি। তারপরও আমাকে বলে এসেছো, অন্তত সুইডেন থেকে যেন যাই, আমেরিকায় যেতে চাইছি তাই যেন যাই, তবে যেখানেই থাকি, দেশে ফেরার চেষ্টা যেন করে যাই। নিজের বাড়িঘর, নিজের আত্মীয়স্বজন ছেড়ে যেন বিদেশ বিভুইএ না থাকি। মা, ব্রাসেলস এয়ারপোর্টে তোমাদের যখন বিদেয় দিচ্ছিলাম, খুব অসহায়, খুব মলিন লাগছিলো তোমার মুখ। মা, তুমি বিদেশের ঝকঝকে দালানকোঠা দোকানপাটের দিকে মোটেও তাকাওনি। কেবল আমার দিকে তাকিয়েছিলে। কী প্রচণ্ড ভালোবাসতে পারো তুমি মা! ভালোবেসে নিজের জীবন উৎসর্গ নাকি করে মানুষ, শুনেছি, কোনওদিন দেখিনি। তোমাকেই দেখলাম। আমাকে দুশ্চিন্তা দেওয়ার চাইতে নিজেকেই দিলে দুরারোগ্য ব্যাধি।
.
মাইকেল যখন তার মার চেয়ারের পেছনে দাঁড়িয়ে কাঁধে অল্প অল্প করে দুহাতে চাপ দিয়ে দিয়ে মালিশ করে দিচ্ছিল, তোমার বিস্মিত চোখ সে থেকে সরেনি, একসময় অঝোরে ঝরতে থাকা নিজের চোখের জল মুছতে শুরু করলে। কেন কাঁদছো জিজ্ঞেস করলে তুমি কোনও উত্তর দিতে পারোনি। যেন ভাবতে চেষ্টা করেছিলে কেঁদেছিলে কেন! আবারও জিজ্ঞেস করেছিলাম, দেশে চলে যাচ্ছে বলে? না। পেট ব্যথা করছিল? না। তবে কেন? মাইকেল তার মাকে খুব ভালোবাসে, এই দৃশ্যটা দেখতে ভালো লাগছিল, তাই। তাই কাঁদবে কেন? ভালো লাগলে মানুষ তো মাঝে মাঝে কাঁদেও। আনন্দাশ্রু। হ্যাঁ তাই। তোমার কি মনে হচ্ছিল, তোমাকে ওভাবে তো তোমার ছেলে মেয়েরা কেউ আদর করে দেয় না! কী গো মা, এত কাজ করছে, এসো তোমার পিঠটায় একটু মালিশ করে দিই, কেউ তো বলিনি কোনওদিন তোমাকে। কেউ তার মাকে আদর করছে দেখলে তোমার চোখে জল আসে কেন! কেউ তার মাকে ভালোবাসলে তোমার ভালো লাগে কেন এত! কী তুমি পাওনি, কী থেকে তুমি বঞ্চিত, তা নিশ্চয়ই তখন বুঝতে পারো। যে মায়েরা ছেলেমেয়েদের আদরপায় তাদের খুব ভাগ্যবতী বলে মনে হয় তোমার, তাই হয়তো ওদের ভাগ্য দেখে, ওদের আনন্দ দেখে তোমার চোখে আনন্দাশ্রু জমা হয়। তুমি কি মাইকেলের জায়গায় দাদাকে বা ছোটদাকে আর মাইকেলের মা’র জায়গায় তোমাকে কল্পনা করে নিয়েছিলে, তাই তোমার ওই ভালো লাগার বোধটা ছিলো? কিছুই বলেনি। তুমি যে কী নিখুঁত শিল্পী মা, কী যে উঁচু মানের মানুষ, কী যে শিক্ষিত, কী যে ভদ্র, কী যে আধুনিক, কী যে বুদ্ধিমতী তুমি–সুইডেনে ওই কটা মাস তোমাকে না দেখলে কোনওদিন জানতে হয়তো পেতাম না। তোমাকে আগে তেমন দেখিনি যেমন দেখেছিলাম। অথবা কী রকম যে তুমি, তা তখন না অনুধাবন করলেও পরে করেছি। এক এক করে যখন মনে পড়েছে তোমার সব হাসিখুশিকে, দুঃখবেদনাকে, মনে পড়েছে তোমার কথা, কাজ, তোমার বিচক্ষণতা, বুদ্ধিমত্তা। যাকে বোকা হিসেবে চিরকাল বিচার করেছি, তার বুদ্ধি দেখার পরও সেটাকে ঠিক বুদ্ধি বলে তক্ষুনি মনে হয় না। কোনও বাজে প্যাঁচাল, কোনও বাড়তি কথা বলেনি। অনর্গল বলেছি আমি। আজকাল যখনই পেছনের দিকে তাকাই, তোমাকে দেখি। তখন আমার চোখ থাকলে দেখতে পেতাম তোমাকে। স্থিত, স্নিগ্ধ তোমাকে। তুমি হয়তো বুঝতে পেরেছিলে আমাকে আর তোমার অসুখ সম্পর্কে বলে লাভ নেই। যে আমি বুঝতে পারছি না, সে আমি বুঝতে পারবোও না। দেশে ফিরে যাওয়ার আগের দিন তোমাকে ব্রাসেলস শহর থেকে খানিকটা দূরে নিয়ে গিয়েছিলাম, একটা গুহায়। গুহার ভেতর অসংখ্য স্ফটিক। হাজার বছর ধরে জল জমে জমে জল বরফ হয়ে শেষে ক্রিস্টাল হয়ে গেছে। গুহার ছাদ থেকে ঝুলে আছে, নানা আকারের ক্রিস্টাল। ভাবা যায় কোনও একসময় এরা শুধু জল ছিল! গুহাটা দেখতে প্রচুর লোক আসে। গুহায় যেতে হলে প্রচুর সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে হয়। নামতে চাইছিলে না তুমি। চাইছিলে না কারণ ওঠা নামা করলে তোমার প্রচণ্ড ব্যথা হয় পেটে। আমি তা শুনবো কেন! তোমাকে জগৎ দেখাবো। বিদেশ যে চমৎকার জায়গা তা তোমাকে না দেখালে আমার চলবে কেন? জোর করে নামালাম তোমাকে। বলতে বলতে নামালাম যে জীবনে এই জিনিসটা না দেখলে তোমার জীবন অপূর্ণ থেকে যাবে। কিন্তু ঘামতে ঘামতে হাঁপাতে হাঁপাতে কষ্টে গোঙরাতে গোঙরাতে নেমেছে বটে। উঠতে তো পারছে না। উঠতে গিয়ে কাঁদছো। কী অসহায় ছিলে তুমি! তোমাকে ক্রমাগত কঠিন কঠিন কথা বলে যাচ্ছিলাম যেন যে করেই হোক ওপরে ওঠো। তুমি সিঁড়ির রেলিং ধরে যন্ত্রণায় নীল হওয়া মা, ধীরে ধীরে ওপরে উঠলে আমার তাড়ায়। এরকম আগেও একবার তুলেছিলাম মা তোমাকে ওপরে, এক রাতে গিয়েছিলাম ইনসুলিনের পেনসিল-সিরিঞ্জ নিতে স্টকহোমের এক চেনা লোকের কাছ থেকে। সেই লোকের বাড়ি চারতলায়। তুমি উঠতে চাইছিলে না। বললে তুমি উঠে নিয়ে এসো, আমি এখানে দাঁড়াই। আমি তোমাকে বললাম না, না, ওঠো। কেন উঠিয়েই ছাড়লাম তোমাকে? তোমার না উঠতে চাওয়ার ইচ্ছেকে কোনও মূল্যই কেন দিইনি, দিতে চাইনি? তা আমি আজও ভাবি। ওর পেছনে বোধহয় একটিই কারণ, তোমাকে মানুষ মনে করিনি কোনওদিন। ভেবেছি তোমার একটিইপরিচয়–তুমি ইস্কুল কলেজপাশ করোনি, তুমি পরনির্ভর, দুনিয়ার কিছু জানোনা বোঝো না, তোমাকে চলতে হবে আমরা যেভাবে বলি সেভাবে। সেভাবেই তো চলেছো জীবনভর। সেভাবে ছাড়া তোমাকে মানাবে কেন মা? এর নাম আর যাই হোক মা, ভালোবাসা নয়। একে অন্তত ভালোবাসা বোলো না।