.
একদিন সকালে তোমার ওই নিচের তলার ছোট ঘরটিতে গিয়ে দেখি তুমি জ্বরে কাতরাচ্ছো। সারারাত আমাকে ডাকোনি। কপালে হাত রেখে দেখি গা তোমার পুড়ে যাচ্ছে। সেদিন আমি তোমার জন্য মায়ায় করুণায় কথা বলছিলাম কেঁদে কেঁদে, বলছিলাম, চলো, হাসপাতালে চলো। আমি তোমার জন্য কাঁদছি, তোমার এমন ভীষণ জ্বর হয়েছে বলে। ওই জ্বরের কষ্ট তুমি মুহূর্তে ভুলে গেলে, তোমার মুখে কী একটা দাতি ছিল মা। পরে তুমি আমার জন্য কাঁদছিলে মা? ” বলছিলে যখন, তোমার চোখ বেয়ে বৃষ্টির মতো জল ঝরছিল। ওই জ্বর-কাতর মুখে তৃপ্তি। প্রথম বোধহয় কাউকে জীবনে তোমার জন্য কাঁদতে দেখেছো। কতটুকু আর কেঁদেছি, কয়েক ফোঁটা চোখের জল। তোমাকে জ্বর থেকে বাঁচাতে হবে। জ্বর কমছিল না কিছুতেই তোমার। যাচ্ছে আসছে। ঠান্ডা জল-ভেজা তোয়ালে দিয়ে গা মুছিয়ে দিচ্ছি। ওষুধ দিচ্ছি। আবার আগুন হয়ে যাচ্ছে শরীর। শেষে হাসপাতাল। হাসপাতাল থেকে ফিরে তুমি দেশে ফিরে গেলে মা। আর থাকোনি। আমিও আর থাকতে বলিনি। তোমাকে ব্রাসেলসে ছোটদার কাছে দিয়ে এসেছিলাম। তোমাদের সঙ্গে একদিন থেকে, তোমাদের বিমান বন্দরে বিদায় জানিয়ে তবে আমি স্টকহোম ফিরেছি। বিদেশে একা একা চলা ফেরায় আমি ভীষণ অভ্যস্ত। তোমার হাতে বলেছিলাম আমি কিছুটাকা দিয়ে দেব। শেষ অবধি দিইনি মা। বলেছি, ‘ছোটদার খুব টাকার লোভ, ও তোমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নেবে। ছোটদার স্বভাব থেকে সাবধান থাকার জন্য আমি কপর্দকশূন্য তোমাকে কপর্দকশূন্য হিসেবেই দেশেপাঠালাম। বলেছিলাম, তোমার হাতে না দিয়ে টাকা তোমার ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে পাঠিয়ে দেব। তুমিও গেলে, আমিও টাকা পাঠানোর কথা ভুলে গেলাম। তোমার হাতে কোনও টাকা পয়সা দেবার তো কেউ ছিল না মা কোনওদিন। আমার কাছে হয়তো আশা করেছিলে মনে মনে, কিন্তু পেলে না। আমি ইচ্ছে করলেই কি টাকা তোমাকে দিতে পারতাম না? আমার তো অভাব ছিল না মা! কেন তবে তুমি বলো যে জীবনের সবচেয়ে সুখের সময় তুমি সুইডেনে আমার সঙ্গে কাটিয়েছে, কেন বলো তোমাকে আমি ভালোবাসা দিয়েছি খুব! দিইনি মা, সারাজীবন ঠকেছো তুমি। তোমাকে তোমার মেয়ে আবারও ঠকালো। তুমি বোকা, চিরকালের বোকা, তাই বোঝোনি কিছু।
তুমি ছোটদার পক্ষ নিয়ে কথা বলতে, বলতে ও তোমাকে ভালোবাসে। এ আমার সইতে না। ছোটদা যে মোটেও ভালো ছেলে নয়, ও যে আমার উপদেশ অমান্য করে তার বউ ছেলেমেয়েকে আমেরিকায় পাঠিয়ে মস্ত ভুল করেছে, তা-ই তোমাকে আমি দিনের পর দিন বুঝিয়েছি। সুহৃদের মানসিক অবস্থা যে খুব খারাপ বুঝিয়েছি, সুহৃদকে যে এখনও তার মা শারীরিক মানসিক অত্যাচারের মধ্যে রাখে বুঝিয়েছি, সুহৃদ হয় পাগল হয়ে যাবে, নয় আত্মহত্যা করবে বুঝিয়েছি, সুহৃদকে মানুষ করতে হলে তার মার কবল থেকে যে তাকে বাঁচাতে হবে বুঝিয়েছি। তুমি মাথা নিচু করে বুঝেছো। ছোটদার ওপর তার পরও তোমার রাগ হয় না। তুমি তারপরও আমার মতো করে ছোটদাকে দোষ দাও না। দেখে তোমার ওপরই অসন্তুষ্ট হই আমি। তোমাকে বলেছিলাম ছোটদা যে সুহৃদের জীবনটা নষ্ট করে দিল, সে সম্পর্কে কিছু বলতে। ভিডিওতে আমাদের অনেক কথপোকথন রেকর্ড করার মতো তোমার মন্তব্যও রেকর্ড করতে চাইছিলাম আমি। ছোটদা যে একটা অপদার্থ আর লোভী গোছের পাষণ্ড সে সম্পর্কে কিছু বলো চাইছিলাম। তুমি বলেছিলে, ‘এসব কথা থাক। এ নিয়ে তুমি কিছু বলতে চাও নি। ছোটদার কাছে কৃতজ্ঞ ছিলে তুমি। আমাকে ঢাকায় যখন পুলিশের গ্রেফতার এড়াতে আর মৌলবাদীদের ফাঁসি এড়াতে দীর্ঘ দুমাস লোকের বাড়িতে বাড়িতে লুকিয়ে থাকতে হয়েছিল, ব্যারিস্টার সারা হোসেন খুব জরুরি হলে বাড়ির কাউকে ডেকে পাঠালে দাদা বা ছোটদা দুজনই যেত, যেহেতু দাদাকে আবার ময়মনসিংহে চলে যেতে হত, ছোটদাই অনেক সময় যেত দেখা করতে। সারা হোসেন রলে দিত, হাইকোর্টে আমার সারেন্ডার করার সম্ভাব্য তারিখের কথা। একবার ছোটদার সঙ্গে গোপন ফোনে কথা বলে তাকে রাতের অন্ধকারে ঝএর বাড়িতে আসতে বলেছিলাম। জগতের কেউ জানে না আমি কোথায়, শুধু ছোটদা জানে, তার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে। ছোটদারই ক্ষমতা আছে আমার সঙ্গে দেখা করার। তখন থেকেই তুমি ছোটদাকে ভগবানের উচ্চতায় বসিয়ে দিলে। ছোটদা বাড়িতে এসে ভাব দেখাতো যে সে বিশাল কিছু একটা করছে আমার জন্য। বিশাল কিছু আমার জন্য করতো ক, খ, গ, ঘরা, তুমি জানতে না। কিন্তু আমার সঙ্গে যেহেতু বাড়ির আর কারও যোগাযোগ নেই, শুধু ছোটদার সঙ্গেই আছে, তুমি ভাবতে, ছোটদাই বুঝি আমার এখন সবচেয়ে বড় ভরসা। ছোটদাই আমাকে জায়গায় জায়গায় লুকিয়ে রাখছে, ছোটদাই আমাকে মৌলবাদীদের হাত থেকে রক্ষা করছে, ছোটদাই ব্যারিস্টারদের সঙ্গে কথা বলে আমাকে বাঁচানোর ব্যবস্থা করছে। তুমি তখন ছোটদাকে রাজার আদরে তো বটেই, গীতাকেও রানির আদরে রেখেছিলে। সবাই তখন আমার শান্তিনগরের বাড়িতে। কোথায় ছোটদাকে সাহায্য করলাম আমি, ডেকে নিয়ে আমার ব্যাংক থেকে যত খুশি টাকা তোলার অধিকার লিখিতভাবে দিয়ে দিলাম, আর আমাকে সাহায্য করার নাম কামালো ছোটদা।
সুইডেনে শেষের দিকে তুমি অল্প কিছু খেতে, একসময় সেও আর খেতে পাচ্ছিলে না। প্রায়ই বলছিলে ক্ষিধে নেই। পেট ভরা ভরা লাগে, খেলে গা গুলিয়ে আসে। বমি ভাব হয়। ভাব কেন, বমিই হয় তোমার। খেতে পাচ্ছো না, খেলে বমি হয়ে যাচ্ছে। সুতরাং না খেয়ে কাটাবে স্থির করলে, আর আমিও তা মেনে নিলাম। এর নাম যদি ভালোবাসা, তবে অবজ্ঞা, অবহেলা, অপমান কাকে বলে মা? তোমার চলে যাওয়া ছাড়া আর কী উপায় ছিল। আমি লেখায় ব্যস্ত। তুমি যে কত বললে কত কাঁদলে যেন দেশে ফিরি, অবুঝ তুমি, তোমাকে বুঝিয়ে বললাম, আমার যাওয়া হবেনা দেশে। দেশে আমাকে ঢুকতেই দেবেনা। তখন আমার হাতে জাতিসংঘের ট্রাভেল ডকুমেন্ট। নিজের দেশের পাসপোর্টটি নেই আমার কাছে। ওটিকে আর নবায়ন করা হয় বাংলাদেশে দূতাবাস থেকে। তুমি আমাকে না নিয়ে দেশে ফিরবেনা, একথা প্রতিদিন বলতে, বারবার বলতে, সেই প্রথম দিন থেকে বলে আসছে। কিন্তু আমাকে না নিয়েই তোমাকে ফিরতে হলো মা। একা ফিরলে। তোমার দীর্ঘশ্বাসের কোনও শেষ ছিল না। কেঁদেছিলে খুব। আমি কি কেঁদেছিলাম? না মা, বরং হাতে করে নিয়ে যাওয়ার সুটকেসটায় এত বেশি কী জিনিস ভরেছো তাই নিয়ে আমি রাগ দেখাচ্ছিলাম। চাকাঅলা কোনও সুটকেস ছিল না তোমার। ব্রাসেলস এয়ারপোর্টে নিজেই তুমি বয়েছো সুটকেসটা। আমি তোমার ওই ভার বহন করিনি। আমার কিছু পুরোনো জুতো আমি ফেলে দিচ্ছিলাম, ওগুলো নিয়েছিলে দেশের গরিব মানুষকে দেওয়ার জন্য। নিজের জন্য কিছু নাওনি মা। নিজের জন্য একটা সুতোও তুমি নাওনি। যা কিনে দিয়েছিলাম, সব ধুয়ে পরিষ্কার করে ভাঁজ করে আমার আলমারিতে রেখে গেছো আমার জন্য। ওই অসুস্থ শরীরে হাবিজাবিতে ভরা ভারি সুটকেসখানি বইতে তোমার খুব কষ্ট হচ্ছিল। ওগুলো আমিই তোমাকে দিয়েছি, আবার ওগুলো এনেছো বলে আবার ফুঁসছি তোমার ওপর রাগে। অবশ্য ফুঁসছিলাম যতক্ষণ আমাকে বইতে হচ্ছিল। তোমার কাঁধে সুটকেস বহনের দায়িত্ব দেওয়ার পর আমার ফোঁসা কমে গেছে। একবারও কি ভেবেছিলাম তোমার তলপেটের যন্ত্রণার কথা! তোমার তো কোনও অসুখ নেই। ডাক্তাররা বলে দিয়েছে কিডনি ভালো, সুতরাং সব ভালো। বেশি বেশি করে ইনসুলিন দেবে, ডায়বেটিসটা কমাও, ব্যস সব ঠিক। আমি তো যাচ্ছি সুহৃদের দায়িত্ব নিতে আমেরিকায়। আমি তো ভালো, আমি তো প্রকাণ্ড হৃদয়বান। পরিবারে আমার মতো দায়িত্ববান আর কেউ আছে? কেউ নেই, তা প্রমাণ তো আমাকে করতেই হবে। যে তোমার মতো মানুষের একফোঁটা দায়িত্ব নিল না, সে ঠিক ঠিক চলে গেল আমেরিকায় অন্যের দায়িত্ব নিতে।