.
এত কম খেতে, বিস্বাদ বিদঘুঁটে জিনিস খেতে, এত কৃচ্ছসাধন, অথচ তোমার রক্ত থেকে চিনি কমতো না। আমি বিরক্ত হতাম। আমার এই বিরক্তি তোমাকে অস্বস্তিতে ফেলতো। তোমার জন্য তোমার মেয়ের দুর্ভাবনা হচ্ছে, মেয়ে তোমার সুগার নিয়ে দুশ্চিন্তা করছে, এ তোমার ভালো লাগতো না। তুমি না খেয়ে না খেয়ে চাইতে সুগার কমাতে, তোমাকে সুস্থতা দিতে নয়, আমাকে স্বস্তি দিতে। তুমি তোমার জন্য নয়, আমার জন্য ভাবতে। কারণ ডায়বেটিস নিয়ে তোমার দুশ্চিন্তা ছিল না, বিরক্তি ছিল হয়তো, কিন্তু আমাকে যেন বিরক্ত হতে না হয়, আমি যেন আমোদে প্রমোদে উৎকণ্ঠাহীন জীবন কাটাই, তা নিয়েই ভাবতে। তুমি তো জানো তোমার অন্য একটা বড় অসুখ আছে। আমি তো সে বড় অসুখের কথা একবারও ভাবিনি, ভেবেছি ডায়বেটিস নিয়ে। আমিই তো শুধু ভোগাইনি। বাজে বাজে ডাক্তারেরা তোমাকে কী ভীষণ ভুগিয়েছে মা। কী ভীষণ ভুগিয়েছে। ওইসব ডাক্তার, যেহেতু তাদের রং সাদা, যেহেতু তারা ধনী দেশের ডাক্তার, তোমাকে বলেছি, এরা বিদেশি ডাক্তার, অনেক বড়, অনেক ভালো, আমাদের গরিব দেশের ডাক্তাররা তো কিছুই জানে না, ডাক্তারিশাস্ত্র এদেরই আবিষ্কার, এরাই জানে সব, এরাই বোঝে সব, এদের চিকিৎসা পেলে তোমার সব অসুখ সেরে যাবে। আমার ভেতরে তখনও ওই হীনম্মন্য বোধটা ছিল। ভাবতাম সাদাদের জ্ঞান বেশি, বুদ্ধি বেশি। সাদারা আমাদের চেয়ে, কালো-বাদামি মানুষের চেয়ে অনেক বেশি বোঝে, সব কিছুতেই আমাদের চেয়ে পারদর্শী বেশি। দেখ না, দেশগুলো কী রকম বানিয়েছে! দেখলেই তা মনে হতো, স্বর্গ বানিয়ে রেখেছে, স্বর্গ। সুতরাং, আমাদের চেয়ে ওরা উন্নতমানের মানুষ। বুঝলে মা, সত্যিকার হীনম্মন্যতা। নিশ্চিতই একটা বর্ণবাদী ছিলাম, সুয়েনসনও বর্ণবাদী। দুজনেই ভাবতাম সাদারা কালোদের চেয়ে সবকিছুতে ভালো। এক বর্ণবাদী আরেক বর্ণবাদীকে তো বর্ণবাদী হিসেবে চিনতে পারে না। সাদাদের বড় মনে করতাম, না হলে সুয়েনসনের মতো লোকের সঙ্গে আমি কেন থাকি? কী যোগ্যতা ছিল তার আমার সঙ্গ পাওয়ার? যন্ত্রের মতো একটা মাথামোটা লোক, অনুভূতি বলতে লেশমাত্র কিছু নেই। একে হিংসুক, তার ওপর স্বার্থপর। তাকে কোনও উপহার দিলে রাগ করতো, ভাবতে বিনিময়ে বুঝি আমাকে কিছু দিতে হবে তার। কিছু নিতে চাইতো না, দিতে হবে এই ভয়ে। আমার তো আবার দেওয়ার অভ্যেস। দিয়ে দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছি, আমাকে না দিলেও চলবে। আমি ও দেশের ভাষা জানি না, কিচ্ছু না। বড় একজন ডাক্তারের দেখা কী করে পেতে হয়, আমি তার কিছু জানি না। আমাকে কোনও পথ সে দেখায়নি। জানে সে পথের কথা, তারপরও মুখ বুজে থেকেছে। একটা কাজই সে আমার জন্য করতে পারতো, গাড়ি চালিয়ে এখানে ওখানে নিয়ে যেতেপারতো। গাড়ি সে আমাকে ভালোবেসে বা আমার কোনও উপকার হবে বলে চালাতো না। চালাতে তার ভালো লাগতো বলে চালাতো। কত যে গ্রামের অলি গলিতে অনর্থক ঘুরেছে। ভেবেছি আমাদের নিয়ে সে বেড়াচ্ছে। আসলে সে একা একাই ওসব করে। বন্ধু বান্ধব কিছু নেই। হয় বই নিয়ে পড়ে থাকে, যতসব ক্রাইম স্টোরি আর ফ্যান্টাসি, নয় অনর্থক অলিগলিতে গাড়ি চালায়। আমি দুবছরেও যা বুঝিনি, তুমি দুদিনেই তা বুঝেছিলে। আমাকে বলতে দেশে যেন ফিরে যাই। তুমি কোনওদিন ভাবোনি সুয়েনসন আমাকে ভালোবাসে, বা তার বাড়িতে থাকার আমার কোনও প্রয়োজন আছে। আমার এক বন্ধু মাইকেলকেই বরং তোমার আপন মনে হয়েছিল। ওকে জড়িয়ে ধরে চলে যাবার আগের দিন কেঁদেছিলে, বলেছিলে, আমার মেয়েটাকে দেখে রেখো। তুমি কিন্তু ইংরেজিতেই বলেছিলে। সুইডেনে মাত্র কদিন থেকেই ইংরেজি শিখে গিয়েছিলে। ইস্কুলের গণ্ডি তোমার পেরোনো হয়নি বলে তোমাকে আমি কম তুচ্ছ করেছি! প্রয়োজনে ইংরেজি কেন, সুইডেনে আর কিছুদিন থেকে গেলে তুমি সুইডিশও বলতে পারতে, ফরাসি দেশে থাকলে দুদিনে ফরাসিও হয়তো বলতে পারতে। আমার মতো নির্বোধ তুমি তো নও। কেবল বাবার সংসারে থেকে তোমার প্রতিভার কোনও স্ফুরণ হয়নি। তুমি সমাজেরপুরুষতন্ত্রের নির্মম শিকার ছাড়া আর কী! কেউ তো তোমাকে গভীরভাবে দেখেনি, তোমাকে বুঝতে চেষ্টা করেনি। তোমার জ্ঞান বুদ্ধি, বিচক্ষণতার মূল্য কোনওদিন পাওনি। ধর্মে আশ্রয় নিয়েছিলে অভিমান করেই। এই জগতের প্রতি অভিমান। ধর্ম কি ভেতরে ভেতরে জানতে না তুমি যে কী রকম যুক্তিহীন! তুমি ভালোবাসতে জানতে, আবেগ ছিল প্রচণ্ড, তাই বলে একেবারে যুক্তিবুদ্ধিহীন ছিলে না তো! বর্ণবাদের লেশমাত্র তোমার ভেতরে ছিল না। ডাক্তারদের রং সাদা বলে, ধনী দেশের লোক বলে তাদের তুমি আমাদের গরিব দেশের কালো বা বাদামির চেয়ে বেশি বুদ্ধিমান বলে একবারও মনে করোনি। আবার কোনও সাদাকেও তুমি ছোট ভাবোনি। রাস্তায় একদিন একটা সাদা বাচ্চা-ছেলেকে দৌড়োতে গিয়ে পড়ে যেতে দেখে ছুটে গিয়ে আহারে ব্যথা পেয়েছে বলে উঠিয়ে দাঁড় করিয়ে হাঁটুর ধুলো মুছতে শুরু করে দিলে। আমি তোমাকে টেনে সরিয়েছি ওই মহৎ কাজ থেকে। প্যারামবুলেটরে কোনও বাচ্চাকে দেখলেও, সাদা কী কালো কী বাদামি, বাবুসোনা গো’ বলে আদর করতে চাইতে। তোমাকে বলেছি, অচেনা লোকের আদর এদেশের মানুষ গ্রহণ করে না। তোমার সরল মন বুঝে পেত না ভালোবাসার জন্য চেনা অচেনার প্রয়োজন কেন হয় বা হবে। তোমার ভেতরে এক বাচ্চা মেয়ে ছিল। এক শীতের বিকেলে বাচ্চাদের খেলার মাঠের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম। তুমি দিব্যি ওখানে দোলনায় চড়ে দুলে দুলে গান গাইতে লাগলে, তোমার শৈশবের গান। শৈশবে শোনা কিছু গান তুমি মনে রেখেছো বটে। তোমার তো কোনও শৈশব ছিল না। যখন দোলনায় দুলে, ছুটে বেড়িয়ে, খেলাধুলা করে শৈশব কাটাবে, তখনই তোমাকে বিয়ে দিয়ে বয়স্ক করে দেওয়া হল, কোলে বাচ্চা দিয়ে মা করে দেওয়া হল। সংসার সন্তানের দুরূহ দায়িত্ব ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হল। দেশের কোনও দোলনায় তুমি চড়তে পারতে না, সে প্রশ্নই উঠতো না। অবকাশের মাঠে যখন বাবা আমাদের জন্য দোলনা বসিয়ে দিয়েছিল, তোমার নিশ্চয়ই ইচ্ছে করতো চড়তে! কোনওদিন তোমার ইচ্ছের কথা কাউকে বলোনি। তোমার কন্যাদের জন্য দোলনা, সেই দোলনায় তোমাকে চড়লে লোকে তোমাকে আস্ত পাগল বলবে! গভীর রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে তারপর যে দোলনায় চড়ে না পাওয়া শৈশবকে একটুখানি পাবে, তারও উপায় ছিল না। বাবা হা হা করে তেড়ে আসবে এই আশংকা ছিল তোমার। শুধু বাবা কেন, তেড়ে তো নিশ্চয়ই আমরাও আসতাম। পাগল ভেবে হয়তো তোমাকে শেকলে বেঁধে রাখার ব্যবস্থা হত। আহা, তোমাকে যদি টেনে এনে একদিন বলতাম, মা তুমিও দোলনা চড়ো। ইচ্ছেগুলোকে কী দীর্ঘ দীর্ঘকাল তুমি শাসন করেছো মা। স্বাধীনতার স্বাদ কখনও তুমি পাওনি। যদি ক্ষমতা থাকতো, তোমাকে তোমার শৈশব ফিরিয়ে দিতাম আমি। যে শৈশবে তুমি শিশু যেভাবে বেড়ে ওঠে, উঠতে, তোমার কৈশোরকে তুমি যাপন করতে, যৌবনকে উপভোগ করতে। কী দোষ করেছিলে যে জীবনের শুরুতেই এক গাদা বার্ধক্যের বোঝা ফেলে তোমাকে পিষে ফেলা হল!
০৩. নিজেকে সঁপে দিয়েছিলে
নিজেকে সঁপে দিয়েছিলে আমার কাছেই। আর আমি তোমাকে কী করলাম মা? তলপেটের বাঁ দিকে তোমার ব্যথা নিয়ে গেলাম বাড়ির কাছের বাজারের ভেতরে একটা ছোটখাটো ডাক্তারখানায়। ডাক্তার তোমার পেটের ওদিকটায় চাপ দিতেই তুমি কঁকিয়ে উঠলে। ডাক্তার তোমাকে পাঠালো আলট্রাসোনোগ্রাম করতে। ঠিক একইঞ্চি জায়গা বলে দিয়েছে ওই পরীক্ষাটা করতে। ইঞ্চি মেপে দেয় তো ওরা। ওরা মেপে সব কিছু করে। সুয়েনসন রান্না করতে গেলে যেমন মেপে চাল দেয়, বা জল দেয়, বা দুধ ঢালে। রান্নাঘরে এদের মশলা পাতি মাপার জন্য যেমন দাঁড়িপাল্লা থাকে, কাপ গেলাসেও মিলিলিটার ডেসিলিটারের দাগ বসানো থাকে। যে নার্স তোমার পেটের ওইইঞ্চি বা সেন্টিমিটারের জায়গাটুকুতে আন্ট্রাসোনোগ্রাম করছিল, তোমার মনে আছে কিনা জানি না আমি বলেছিলাম যন্ত্রটা আরেকটু এদিক ওদিক ঘোরাতে, দেখছেই যখন পেটের আরও কিছু জায়গা দেখে নিক। না, ডাক্তারের মাথায় কিডনি, শুধু কিডনিই দেখতে বলেছে। কিডনির এলাকার বাইরে এক সুতোও যাবে না নার্স। দেখা গেল কিডনি ভালো। ডাক্তারের ওই ছোট মাথায় শুধু ডায়বেটিস ছিল। ডায়বেটিসের কারণে কিডনি নষ্ট হতে পারে, তাই কিডনি দেখতে চাওয়া। তোমার রক্ত পরীক্ষায় নিশ্চয়ই কিডনি ভালো থাকার প্রমাণ ছিল। কতটুকু অশিক্ষিত হলে ডাক্তার কিডনিই শুধু দেখতে পায়। তুমি ব্যথায় উঁ করে উঠেছিলে, যখন ডাক্তার তোমার ওই তলপেটের বাঁদিকে চাপ দিয়েছিল। ডাক্তারের মাথায় গোবর না থাকলে মেপে দিত না ইঞ্চি। বলতো, পুরো পেটের আলট্রাসোনোগ্রাম করে নিয়ে এসো। তাহলেই তো ধরা পড়তো তোমার ওই ভয়ংকর অসুখটা, মা। আর, আমার মাথায় কী ছিল? বর্ণবাদ ছিল ঠাসা। না থাকলে আমি ডাক্তারের নির্বুদ্ধিতাকে গ্রহণ না করে নিজে আমি পয়সা দিয়ে তোমার পেটের পরীক্ষাটা করাতাম। পয়সা দিলে কী না হয়! একটা নিয়ম আছে জানি, ছোট ডাক্তারের কাছে আগে যেতে হয়, অসুবিধে দেখলে ছোট ডাক্তার পাঠিয়ে দেবে বড় ডাক্তারের কাছে। কিন্তু আমার ছোট ডাক্তার যদি অসুবিধেটা না বোঝে, তবে তো দায়িত্বটা নেওয়া উচিত ছিল আমার। কিন্তু আমি তো নিইনি মা। ছোট ডাক্তার বলে দিল কিডনি ঠিক আছে, কিচ্ছু হয়নি। তোমাকে আঁশ আছে এমন খাবার খেতে না করে দিল। ব্যস, শাক সবজি বন্ধ। তোমাকে শুধু মাছের সুপ গেলানো হচ্ছে। তুমি খেতে পারতে না ওইসব সামুদ্রিক মাছ। খেতে ইচ্ছে করতো না ওসব দুর্গন্ধ জিনিস। কিন্তু কী করবে মা, পৃথিবীর অন্যতম ধনী দেশে, বিদ্যাবুদ্ধির বিশেষজ্ঞ সাদা ডাক্তারদের চিকিৎসার সুবিধেপাচ্ছো, তোমার মতো ভাগ্যবতী কে আছে বলো। তোমাকে বলতাম আমি। মাছের সুপ খাইয়ে তোমাকে আমি বলতাম, নিশ্চয়ই এখন ওই ব্যথাটা তোমার জন্মের মতো গেছে। তুমি মলিন হাসতে। মাথা নেড়ে বলতে, এখনও আছে। এখনও আছে? বাজে কথা বলছো কেন? আমার অবিশ্বাস দেখে মনে মনে নিশ্চয়ই তুমি দীর্ঘশ্বাস ফেলতে। অথবা একা একা নিচের ওই খুপরি ঘরটায় গিয়ে কাঁদতে। সারাদিন না খেয়ে থাকলেও, তিনবেলা ইনসুলিন নিলেও তোমার ব্লাড সুগার যেমন উঁচুতে তেমন উঁচুতেই। এসবের কোনও কারণ জানার ইচ্ছে ওই সাদা ডাক্তারের হয়নি। তোমার বমি হয়ে যেত মাছের সুপ খেতে গিয়ে। ধমক দিয়ে বলতাম–এসবই তোমাকে খেতে হবে। এসব খেলেই তোমার অসুখ সারবে। তুমি নিশ্চয়ই ভয় পেতে আমাকে, তোমার অসুখের কিছুই বুঝতে পারেনি ডাক্তার–এ কথাটা বলতে ভয় পেতে। ভয় তোমার আমি বিরক্ত হব, আমার শান্তি নষ্ট হবে। তোমার মতো ক্ষুদ্র তুচ্ছ মানুষ আমার মতো বিশাল বিখ্যাতর শান্তি নষ্ট করলে চলবে কেন! তুমি আমাকে বললে না যে তোমার কোনও কষ্ট আর আছে, বললে না ব্যথাটা আছে। কিন্তু পেটে হাত রেখে যখন সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে, লক্ষ করে বলতাম, কী ব্যাপার, পেটে হাত কেন? ব্যথা এখনও আছেনাকি? তুমি অপ্রস্তুত হতে। ওষুধ দিয়েছে ডাক্তার ব্যথা কমার, সুপ খেতে বলেছে, ফাইবার বন্ধ। তারপরও ব্যথা না কমার তো কোনও কারণ নেই। মানে, দোষটা ডাক্তারের নয়, চিকিৎসার নয়, দোষটা ওষুধের নয়, দোষটা ফিস সুপের নয়, দোষটা তোমার। তোমার শরীরের। তোমার শরীর নিয়ে, তোমার নিজেকে নিয়ে তোমার কুণ্ঠার শেষ ছিল না। ওই দূর নির্বাসনে তুমি আমাকে আর অস্বস্তি দিতে চাওনি। তাই নিজের রোগশোক লুকিয়ে রাখতে। বলতে না যে কমোড ভরে যায় রক্তে। বলতে না, কারণ এসেই তোমার ডায়বেটিসের দুশ্চিন্তা আমাকে দিয়েছো, পেটের ব্যথার সমস্যা দিয়েছে। ডাক্তারের কাছে দৌড়োদৌড়ি করেও না কমানো যাচ্ছে তোমার ডায়বেটিস, না পেটের ব্যথা। আবার যদি রক্তপাতের সমস্যার কথা বলো, তাহলে পাগল হয়ে যাবো। তাই বলোনি মা। তাই গোপন রেখেছিলে ওই সমস্যা। তুমি বেশ বুঝতে পারছিলে, ওই রক্তপাতের সঙ্গে তোমার ওই ভয়ংকর অসুখের কোনও সম্পর্ক আছে আর ওই ভয়ংকর অসুখের সঙ্গে তোমার পেটের ব্যথাটিরও সম্পর্ক আছে। ডায়বেটিস আর কিডনি আর ফাইবার আর ফিস সুপ এসবঅহেতুক, এসব অনর্থক। কিন্তু আমি যেহেতু তোমার বলার পরও বুঝতে পারছি না, অথবা বুঝতে চাইছি না, তুমি আর যাই করো, শরীরের সমস্যার কথা বলে আমাকে বিপর্যস্ত করোনি। সাদায় আমার ভক্তি ছিল, তোমার কাছে সাদা-কালো-বাদামি মানুষ হিসেবে সবাই সমান ছিল। সাদা দেখলে তুমি ভক্তি শ্রদ্ধায় মাথা নোয়াতে না। সাদা ডাক্তাররা যে তোমার অসুখটা খুঁজে পায়নি, তা আমি বুঝিনি, তুমি বুঝেছিলে। তোমাকে কষ্ট কি কম দিয়েছি মা! পাড়ার ছোট ডাক্তার রক্ত পরীক্ষা করতে ক্যারোলিন্সকা হাসপাতালে পাঠিয়েছিল। ক্যারোলিন্সকা সুইডেনের বড় হাসপাতাল। ওখানকার ল্যাবরটরিতে রক্ত পরীক্ষা হয়েছে। ওখানকার ডাক্তার বলে দিয়েছে রক্তে কী একটা ভয়ংকর জীবাণু পাওয়া গেছে। ডাক্তার আমাকে জরুরি তলব করলো। তোমার যে কটা নষ্ট দাঁত আছে, সব নাকি ফেলে দিতে হবে। কেন? সেই জীবাণু নাকি পচা দাঁতে জন্ম নেয়, আর দাঁত থেকে সোজা দৌড়ে যায় হৃৎপিণ্ডে, হৃৎপিণ্ডে গিয়ে যা ইচ্ছে তাই করে। তুমি হাসলে শুনে। তোমাকে দাঁতের ডাক্তারের কাছে টেনে নিয়ে গেলাম, তোমার দাঁত পরীক্ষা করে ডাক্তার বললো, আমার দাঁতের চেয়ে তোমার দাঁত বেশি মজবুত, কোনও নষ্ট বা পচা দাঁত তোমার নেই। কিন্তু ছোট ডাক্তার ক্যারোলিন্সকার বড় ডাক্তারের উপদেশ শুনে বলে দিল, দাঁত যে করেই হোক ফেলতে হবে, তা না হলে হৃৎপিণ্ডে গিয়ে হৃৎপিণ্ড অচল করে দেবে ভয়ংকর ব্যাকটেরিয়া। তোমার দাঁতে কোনও সমস্যা ছিল না। তারপরও ভালো ভালো দাঁত একের পর এক তোলা হল। সাদা ডাক্তারদের চিকিৎসা। তোমাকে মানতেই হবে। তুমি না মানতে চাইলেও আমার জোর জবরদস্তিতে তুমি রাজি হলে। রাজি না হয়ে তোমার উপায় কী ছিল মা। দাঁতের ডাক্তারের খুব খারাপ লেগেছিল হয়তো ভালো দাঁতগুলো ওভাবে সাঁড়াশি দিয়ে তুলে তুলে আনতে। কিন্তু বাজে ব্যাকটেরিয়ার ব্যাপার। দাঁতের ডাক্তারের আর করার কী ছিল! হয়তো ভেবেছিলো কালো মানুষদের দাঁত থাকলেই কী, না থাকলেই কী। তাই প্রশ্ন করেনি। আফশোস করেনি। যন্ত্রের মতো মানুষদের মনে কী হচ্ছে, তা বোঝা সত্যিই শক্ত। মা, তোমাকে জোর করে দাঁত তুলিয়েই যে তোমাকে নিস্তার দিয়েছি তা নয়। তোমাকে তক্ষুণি ভর্তি করাতে বললো দানদিরুদ হাসপাতালে। দানদিরুদ হাসপাতালটা সংক্রামক রোগের জন্য। তোমার ওই ব্যাকটেরিয়া নির্মূল করতে হলে ওই হাসপাতালেই ভর্তি করতে হবে। করিয়ে দিলাম ভর্তি। সন্ধেবেলা সুয়েনসন বাড়ি ফিরলে ওর সঙ্গে একটুক্ষণের জন্য তোমাকে দেখতে যেতাম। তুমি চাইতে না আমি আমার সময় নষ্ট করি তোমার কাছে বসে থেকে। বলতে যেন বাড়ি চলে যাই। তুমি হয়তো ভেবেছিলে হাসপাতালে যখন ভর্তি হয়েছে, বড় বড় ডাক্তার তোমাকে দেখবে। তোমার ওই ভয়ংকর অসুখটা নিশ্চয়ই এবার ধরতে পারবে ওরা। কিন্তু ক্যারোলিন্সকার ল্যাবরটরিতে পাওয়া ওই ব্যাকটেরিয়া দূর করার দায়িত্ব শুধু ওরা নিয়েছে। ওরা তোমার কোনও অসুখ আবিষ্কারের জন্য তো বসে নেই। ওরা তোমাকে সাধারণ অ্যান্টিবায়োটিকের চেয়ে লক্ষ গুণ বেশি ক্ষমতার খুব কড়া কড়া অ্যান্টিবায়োটিক দিল স্যালাইনের সঙ্গে। তুমি কি ভেবেছিলে ওরকম স্যালাইনের সঙ্গে ওষুধ দিয়ে তোমার ভয়ংকর অসুখটাকে হয়তো নির্মূল করবে! না মা না। সাতদিন তোমাকে ভয়ংকর যন্ত্রণা দিল। সিরিঞ্জ ভরে ভরে প্রতিদিন তোমার রক্ত নিয়েছে আর ব্যাগ ভরে ভরে তোমার শরীরে ঢুকিয়েছে ভয়ংকর জীবাণু দূর করার জন্য ভয়ংকর জীবাণুনাশক। সাতদিন প্রায় একা একা তোমাকে থাকতে হল। তুমি থাকতে চাওনি হাসপাতালে, কারণ আমি ওই যে যাই তোমাকে দেখতে, ভেবেছো আমার স্বাভাবিক জীবন যাপনে ব্যাঘাত ঘটছে, তোমার জন্য বাড়তি ঝামেলা আমার হোক, তা মেনে নেবে কেন! তুমি বাড়ি ফিরে আসার পরদিন হাসপাতাল থেকে জানিয়ে দিয়েছে, ক্যারোলিন্সকা ল্যাবরটরির পরীক্ষায় যে ডেডলি ব্যাকটেরিয়া পাওয়া গিয়েছে বলা হয়েছিল, তা ভুল। ল্যাবরটরির ভুল। ওরকম কোনও ব্যাকটেরিয়া আসলে ছিল না রক্তে। কোথাও তাদের ভুল হয়েছিল। বাহ। তোমার দাঁতগুলো ফেলে দেওয়ারপর, তোমাকে জীবননাশ করা জীবাণুনাশক রক্তে প্রবেশ করিয়ে বলে দিল, ভুল। এই ক্যারোলিন্সকা ইনস্টিটিউট থেকে মেডিসিনে নোবেল প্রাইজ দেওয়া হয় মা। কী করবো, কোথায় যাবো। কারও বেলায় এমন হয় না, তোমার বেলায় হলো। ভুল শুধু তোমার বেলায় হয়। ভুগতে হয় তোমাকেই। হয় তোমার চিকিৎসা হয় না, যদি হলোও কখনও জীবনে, ভুল হলো। মাড়িতে দাঁত নেই, বলতে চিবোতে পারছো না খাবার। অভিযোগ করোনি, শুধু বলেছো। হেসেই বলেছো। সান্ত্বনা দিয়েছি, দাঁত গেলে এমন কী, বাঁধানো যাবে। তোমার চুলে কোনও পাক ধরেনি। ত্বকে কোনও ভাঁজপড়েনি। এত কম বয়সী একজনের দাঁত বিদেশি ডাক্তাররা মিছিমিছি তুলে নিল? আমেরিকায় হলে এই ডাক্তারদের বিরুদ্ধে ভুক্তভোগী রোগীরা বিলিয়ন ডলারের ক্ষতিপূরণ মামলা করতো। কিন্তু আমি কী করে কার বিরুদ্ধে মামলা করবো? মানুষ আমাকে সেলিব্রিটি ভাবে, বিশাল ক্ষমতাশালী কিছু একটা ভাবে, কিন্তু আমার মতো নিরীহ নিরুপায় মানুষ কজন আছে! নেই, সে কথা এখন জানি আমি। তখন জানিনি। দেশে থাকলে তোমার চিকিৎসা করাতে কোনও তো অসুবিধে হতো না মা। ওখানে আমার বন্ধুদের, বা পরিচিত ডাক্তারদের নিশ্চয়ই পেয়ে যেতাম যে কোনও হাসপাতালে। আর না পেলেও আমাকে তো সবাই চিনতো। সুইডেনে একসময় মানুষ সবাই আমাকে চিনেছিলো, খুব বড় খবর ছিলাম আমি। ধীরে ধীরে সবাই ভুলে গেছে। একসময় তো রাস্তাঘাটে চলতে গেলে মানুষ আমাকে দেখতে ভিড় করতো, দৌড়ে এসে অটোগ্রাফ চাইতো, নয়তো দূর থেকে অভিনন্দন বা শুভেচ্ছা জানাতো। এখন আমি যে কোনও সাধারণ মানুষের মতো। সারাক্ষণ যদি টিভিতে, পত্রিকার পাতায় ছবি না বেরোয়, তবে ভুলে যেতে আর কতক্ষণ এই মুখটি! রং সাদা নয় বলে যে কোনও অভিবাসীর মতোই আমি, অর্থনৈতিক সুবিধের জন্য গরিব দেশ থেকে যেমন হাজার হাজার লোক এসে ধনী দেশে আশ্রয় চায়, তাদের মতোই তো দেখতে আমি। আমার দিকে সাদারা নিশ্চয়ই তেমন চোখেই তাকায়, যেমন চোখে আর সব ডার্টি ইমিগ্রেন্টদের দিকে তাকায়। তবে নামটি শুনে এখনও লোকে স্মৃতি হাতড়ে তুলে আনে, তুমি তো লেখক, তাই না? আজকাল না বলি। নিজের পরিচয় দিতে ইচ্ছে করে না। কিন্তু ডাক্তারদের কাছে তো তোমার নাম বলতে হয়েছে, আমার নাম নয়। আগ বাড়িয়ে নিজের নাম পরিচয় দিয়ে সুবিধে চাইবো, সে রুচি আমার কোনওদিনই ছিল না, তখনও হয়নি যখন তোমার জন্য সুবিধের বড় দরকার ছিল। তোমার জন্য ব্যক্তিত্বটা একটুখানি বিসর্জন দিয়ে যে নিজেকে চেনাবো, আমি যে ডার্টি কোনও ইমিগ্রেন্ট নই, রীতিমত একজন নামকরা লোক, মনে করিয়ে দিলেই লোকের মনে পড়বে, আমার মাকে ভালোভাবে দেখবে, ভালো চিকিৎসা করবে, তা তো করিনি। এমন স্বর্গের মতো দেশ, এমন সমতা আর সাম্যের দেশ, মনে হত সবাইকে সমান চোখেই নিশ্চয়ই দেখে এই দেশ। পরে এসব ভুল আমার ভেঙেছে মা। সুইডেনেও ওই একই, স্বজনপ্রীতি বলো, ক্ষমতা ব্যবহার বলো, সবই চলে। লেখক হলে, নামী দামী কিছু হলে খাতির জুটবেই। তুমি যখন ছিলে, এসব সত্য উদ্ধারের কোনও চেষ্টা আমি করিনি। নিজের নাম পরিচয় লুকিয়ে সাধারণ যে কোনও মানুষের মতো হাসপাতালে গিয়েছি। সবাই মিলে তোমাকে যন্ত্রণা দিয়েছি। দানদিরুদ হাসপাতালে ডাক্তার অ্যানডার্সকে দেখার পর নিজেকে সরিয়ে নিয়েছি যেন আমাকে দেখতে না পায়। ওখানেও ওই একই ব্যাপার হয়তো কাজ করেছিলো, কমপ্লেক্স। অ্যানডার্সকে গিয়ে যে বলবো আমার মা অসুস্থ, এই হাসপাতালে ভর্তি, বলিনি। যে অ্যানডার্স আমার ফোনের উত্তর দেয়নি, তার সঙ্গে কেন আমি কথা বলবো! হীনম্মন্যতা নাকি অহংকার কে জানে। অ্যানডার্স চোখের ডাক্তারের নাম ঠিকানা দিয়েছিলো বাবার চোখের ছানি কেটে যখন লেন্স পাল্টে দেওয়া হয়েছিল। বাবা চোখে কী ঝকঝকে দেখেছিল তারপর। প্রচুর টাকা লেগেছিলো সোফিয়া হেমেটের মতো বড় হাসপাতালে। পেন ক্লাবকে বলে দেবে টাকাটা দিয়ে দিতে, অ্যানডার্স বলেছিল। আমি সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করে বলেছি, পেন ক্লাব দেবে কেন, আমিই নিজেই বিল মেটাবো। পরদিনইপঁয়ত্রিশ হাজার ক্রোনার পাঠিয়ে দিয়েছিলাম ডাক্তারের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে। পরে অ্যানডার্স একদিন এসে আমাকে ডিনারে নিয়ে গিয়ে বলেছিলো, সব টাকা দিয়ে দিলে? নয় কেন? আমার বাবার চোখ অপারেশনের টাকা আমি দেব না তো কে দেবে? আমি কি ভিখিরি নাকি যে অন্যের কাছে চাইবো? সুইডিশ পেন ক্লাব থেকেপাওয়া কুর্ট টুযোলস্কি পুরস্কারের টাকা ওভাবেই খরচা করেছি। টেলিফোন বিলে, বাবার চোখ অপারেশনে, আর বাকিটা হাবিজাবিতে। টাকা উড়ে যেতে খুব বেশিদিন সময় নেয়নি। বাবার বেলায় তো এমন কাণ্ড ঘটেনি। বাবাকে একরাতও হাসপাতালে থাকতে হয়নি। যেদিন অপারেশন, সেদিনই বাড়ি ফেরা। রোগ ধরতে ডাক্তারদের কোনও অসুবিধে হয়নি। কোনও ভুল চিকিৎসা হয়নি। কী দোষ করেছিলে যার শাস্তি তোমাকে জীবনভর পেতে হলো! সম্ভবত দোষ করোনি বলেই শাস্তি পেতে হয়েছে। আমাকে নির্বাসনের শাস্তি পেতে হলো দোষ না করে, মানুষের ভালো করতে গিয়ে। তুমিও তো সারাজীবনে কেবল মানুষের ভালো করেছে, তাই সারাজীবনই তোমাকেযন্ত্রণা পোহাতে হয়েছে। সুখ পাওনি কারও কাছ থেকে। অন্যের ভালো করা যার স্বভাবে চরিত্রে রক্তে, তা কী করে কেদূর করবে! এর কারণে ভুগলেও স্বভাব কোথায় যাবে। মানুষের মার খাবে, তারপরও মানুষের জন্যই জীবন দেবে।