কেন তুমি বলেছিলে তোমাকে খুব ভালোবেসেছি আমি? জীবনে সবচেয়ে সুখের সময় বুঝি ওই সময়? রোজা রাখতে চেয়েছিলে, জীবনের নাকি ও তোমার শেষ রোজা। আমি বলেছিলাম শেষ রাতে খাওয়ার কোনও নিয়ম ও বাড়িতে নেই, সুতরাং সেহরি খাওয়া চলবে না। শুনে বলেছিলে সন্ধেবেলায় তোমার ঘরে থালায় করে খাবার নিয়ে রাখবে, কাউকে জাগতে হবে না, আমার ঘুমের কোনও ব্যাঘাত ঘটবে না। না। তাতেও আমি রাজি হইনি। রোজা তোমাকে রাখতেই দেব না। যে দেশে শীতের সময় বড়জোর দুঘণ্টা আলো থাকে, তাও আবছা আলো, সেখানে রোজা তো দুঘন্টার চেয়ে বেশি হতে পারে না। সূর্যোদয় হয় বেলা এগারোটায়, দুপুর একটায় সূর্যাস্ত। তোমাকে বলেছিলাম, ভালো যে শীতকালে রোজা পড়েছে, বুঝতে গরমকালের রোজার মজা। সূর্যের কোনও অস্ত যাওয়া নেই। তোমাকে এও বলেছি তোমার ওই রোজার নিয়ম কানুন যারা তৈরি করেছিলো আরব দেশে, তাদের পৃথিবী সম্পর্কে কোনও ধারণাই ছিল না। পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধে যে সূর্যাস্ত আর সূর্যোদয়ের অবস্থা ভিন্ন, সে সম্পর্কে জ্ঞান থাকলে নিয়ম অন্যরকম হতো। অজ্ঞতার এর চেয়ে বড় উদাহরণ আর কী আছে! তোমাকে হঠাৎ আমি ধর্ম থেকে মুক্ত করতে চাইছিলাম। অজ্ঞ আর অশিক্ষিতদের কবল থেকে উদ্ধার করতে চাইছিলাম। অপমান করে, ভ্রূকুটি করে, গা-জ্বালা কথা বলে চাইছিলাম তোমাকে নাস্তিক বানাতে। তোমার আল্লাহতায়ালা যদি মহান কেউ হন, যদি দয়ালু কেউ হন, তাহলে যারা তার পায়ে মাথা নোয়াইনি, তার জপ করিনি, তাদেরপুঁজ রক্ত খাইয়ে, গায়ে গরম পানি ঢেলে, আগুনে পোড়াবেন কেন? এ কি ক্ষমাশীল হওয়ার, উদার হওয়ার, মহান হওয়ার নমুনা? তুমি চুপ করে থাকতে। জানি না তোমার মনে কোনও সংশয় জাগতো কি না। আল্লাহকে যে এত জপছো, এই আল্লাহ তোমাকে বেহেস্তে নেবেন ঠিকই, কিন্তু বেহেস্তে বাবাকেই পাবে তুমি সঙ্গী হিসেবে, যে বাবা তোমাকে সারাজীবন লাঞ্ছিত করেছে, আর বাবা পাবে সাতাত্তর জন হুরী সুন্দরী। ওদের নিয়ে বাবা ফুর্তি করবে তোমার চোখের সামনে, সব সইতে হবে তোমাকে। ইহকালেও ভুগলে, পরকালেও ভুগতে হবে। এ কেমন বিচার বলো? বাবা যেহেতু সারাজীবন ধর্ম পালন করেনি, বাবাকে যদি দোযখে পাঠানো হয়, তাহলে তো তোমাকে একাই থাকতে হবে অনন্তকাল। হেসে হেসে বলতাম, বেহেস্তে তো তোমাকে সব কুৎসিত কুচক্রী মোল্লাদের সঙ্গে কাটাতে হবে। আর, আমি, দোযখে তোমার সব প্রিয় প্রিয় নায়ক নায়িকাঁদের সঙ্গে থাকবো, তোমার উত্তম সুচিত্রা, তোমার পাহাড়ি সান্যাল, তোমার ছবি বিশ্বাস। ওরা হিন্দু বলে ওদের তো সবাইকে ধরে ধরে দোযখে পাঠানো হবে। বড় বড় বিজ্ঞানী, বড় বড় দার্শনিক যারা কোনওদিন ধর্মবিশ্বাস করেনি, তাদের সঙ্গে দোযখে কাটাবো, আমার আর চিন্তা কী! ্যাঁ উত্তম সুচিত্রার জন্য তো পাগল ছিলে। পালিয়ে পালিয়ে গিয়ে সিনেমা দেখতে। সেই তুমি কি না সিনেমা ছেড়ে সব ছেড়ে ধর্মে মন দিলে। দোযখের ভয় এমনই ধরানো হয়েছিল, যে, ভয়ে সিঁটিয়ে থাকতে, ধর্ম কর্ম বাধ্য হয়ে করতে। অভাগিনীর কী আছে আর, ধর্ম ছাড়া! কিন্তু বুদ্ধি খাটালে তো অসারতা টের পেতে মা। পেতে না?
আমি তোমাকে শ্রদ্ধা করিনি, করলে তোমার রোজা নিয়ে অত ঠাট্টা মশকরা করতাম না। বিয়ে হয়েছে বলে ইস্কুলে পড়তে দেয়নি তোমার বাবা, অথচ কত পড়তে চেয়েছো, এমনকী তোমার ছেলেমেয়েরা যখন মাধ্যমিক দিচ্ছে, ওদের সঙ্গে তুমিও প্রাইভেটে মাধ্যমিক পরীক্ষা চেয়েছে দিতে, এমনকী তোমার নাতিও যখন দিচ্ছে, চেয়েছে; সেই তোমাকে অশিক্ষিত বলে গালি দিয়েছি। অসুখ নিয়ে মেয়েকে শেষ দেখা দেখতে এসেছে সুইডেনে, ওখানেও লোকের সামনে তোমাকে তুচ্ছ করেছি। কী করে ভাবো তোমাকে ভালোবেসেছিলাম! জীবনে ভালো খাবার তোমার পাতে পড়েনি। ভালো খাবার তোমাকে খেতে দিইনি আমি। তোমার ডায়বেটিস, সুতরাং তোমাকেসব অখাদ্য খেতে উপদেশ দিতাম। লিককিনেছি, ব্রকলি কিনেছি। ডায়বেটিসের জন্য ভালো। এ দুটো তুমি জোর করে গিলতে। ব্রকলিকে চুলের মতো লাগতো, লিক খেতে ঘাসের মতো লাগতো। কিন্তু ওসব অখাদ্যই তোমাকে খেতে হয়েছে। মাঝে মাঝে মুরগি রান্না হয়েছে। অবশ্য তোমার পাতে রান তুলে দিয়েছি, দেখে তুমি অপ্রস্তুত হয়েছে মা। তুমি তো কোনওদিন বাড়িতে মুরগি রান্না হলে রান পাওনি খেতে। সব অন্যদের খাইয়েছো। রান খাবে মা? এ হয় নাকি। তোমার জন্য তো ছিল গলার হাড়, বুকের হাড়। এ ছাড়া কোনওদিন কি খেয়েছো ভালো কিছু? ওই রান খেতে দিয়েছিলাম বলেই হয়তো তুমি বলেছো ভালোবাসা পেয়েছো আমার। না মা, মুরগি হল বিদেশে সবচেয়ে সস্তার জিনিস। ওর চেয়ে সস্তায় আর কোনও খাবার মেলে না। বিশেষ করে ফ্রোজেন চিকেন। তোমাকে তো আর ফ্রেশ কিছু খাওয়াইনি। ফ্রেশ যে কেনা যায়, তাজা টাটকা কিছু যে কেনা যায়, কিনে যে বেশ সুস্বাদুকরে রান্না করা যায়, এ আমার ধারণাতেই ছিল না। যার বাড়িতে থাকতাম, সে সস্তার জিনিস কেনার জন্য চাপ দিত আমাকে। ওর নিজের যেমন কোনওদিন অভ্যেস ছিল না ভালো জিনিস কেনার, সস্তাপচা জিনিসে অভ্যস্ত ছিল, আমাকেও অভ্যস্ত করিয়েছিল। তুমি টমোটো ভালোবাসতে। অনেক রকম টমেটো ছিল বাজারে। খুব ভালো, মাঝারি ভালো, সাধারণ ভালো, আর প্রায় নষ্ট। আমি খুব ভালোগুলো বা মাঝারি ভালোগুলো কিনতে চাইলে সুয়েনসন তেড়ে আসতো, বলতো করছো কী, যেটার দাম কম, সেটা কেনো, তার মানে ওই প্রায় নষ্টগুলো, বাজে জাতেরগুলো কেনো। ওর ধারণা ছিল, ও কম পয়সায় জিনিস কিনে বুদ্ধিমানের কাজ করে। যারা দামি জিনিস কেনে, তারা বোকা। দোকানিরা তোক ঠকাতে চায়, আর সে কম দামি জিনিস কিনে দোকানিদের ঠকিয়ে আসে। এই বিশ্বাস নিয়েই সে বাঁচে। কিন্তু আমি তো পারতাম বলতে যে আমার মা এসেছে, তোমার ওই সস্তা নীতি আজ থেকে আমি মানবো না। আমি তো বলিনি! আমি তো তোমার জন্য কোনও অভ্যেসের প্রতিবাদ করিনি। বাজার তো সুয়েনসনের টাকায় হত না, বাজার আমার টাকায় হতো। আমার কি টাকার অভাব ছিল মা? ছিল না। আমি সুইডেনের কুর্ট টুখোলস্কি সাহিত্যপুরস্কার পেয়েছি, ইওরোপিয়ান পার্লামেন্ট থেকে শাখারভ পুরস্কার পেয়েছি, নান্তের এডিট দ্য নান্তপুরস্কার, ফরাসি সরকার থেকে পাওয়া মানবাধিকার পুরস্কার, এক একটা পুরস্কারের টাকা বাংলাদেশের টাকায় তিরিশ চল্লিশ লাখ। তারপর বইয়ের রয়্যালটির টাকা। ইওরোপের বিভিন্ন ভাষায় বই বের করার আগে প্রকাশকরা অগ্রিম রয়্যালটি দিয়েছে, সেও অনেক। প্রায় দু কোটি টাকা পড়ে আছে ব্যাংকে। কিন্তু টাকা আমি সবার জন্য খরচ করতে চাইলেও তোমার জন্য চাইনি। মুরগির রান পাতে পেয়ে তোমার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠতো। তুমি লজ্জা পেতে খেতে। আমার থালায় তুলে দিতে। কিন্তু রানের তো অভাব ছিল না। বাড়িতে খাবার লোক মোটে তিনজন। তোমার তো আর ছেলেমেয়ে ছিল না ও বাড়িতে যাদের জন্য রেখে দেবে। তুমি রান খেয়ে যে খুশি হতে তা নয়, তোমাকে আমি ভালোবাসি এ কথা ভেবে খুশি হতে। আমি যে তোমাকে সারাজীবন যা খেয়ে এসেছে সেই বুকের হাড় বা গলার হাড় দিইনি, বরং আমরা যা খেতাম, সেই রান খেতে দিয়েছি, সে কারণেই হয়তো তোমার মনে হতো তোমাকে ভালোবাসি। সে আর কতদিনই বা খেতে পেরেছো! একসময় তো মাছ মাংস বন্ধ করে শুধু তোমাকে সেদ্ধ শাক সবজি খাওয়ার অর্ডার দিলাম। খুব মাখন ভালোবাসতে, ও পদার্থ তোমাকে স্পর্শ করতে দিইনি। পনির খুবপছন্দ করতে। বাজারে একশ রকম পনির তুমি মুগ্ধ হয়ে দেখতে। আমি ধমকে তোমাকে পনিরের জায়গা থেকে সরিয়ে এনেছি। বলেছি এসব খাওয়া চলবে না তোমার, ডায়বেটিস বাড়বে। পনির একবার কিনেছিলাম অবশ্য, সেও বাজারের সবচেয়ে কম দামি, মোটেও খেতে ভালো নয়, এমন পনির। তুমি তো আর জানোনা, ভালো কী মন্দ, কিনেছি যে পনির, সে কারণেও হয়তো তোমার মনে হয়েছিল তোমাকে ভালোবাসি।