তোমার ধর্মবিশ্বাস নিয়ে ব্যঙ্গ করা আমার কখনও ফুরোতো না। যেদিন রোজা রাখবে বললে, তোমার রোজা রাখার ইচ্ছেকে আমি যাচ্ছেতাই ভাষায় গুঁড়ো করে দিতে চাইলাম। তুমি যে তর্ক করবে, চিৎকার করবে তা কিন্তু করলে না, বরং মিষ্টি হেসে, আমার চুলে পিঠে হাতে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললে, জীবনের হয়তো শেষ রোজা মা, কোনওদিনই ভাঙিনি, এবার ভাঙবো না। আমায় রাখতে দাও মা। আমি হো হো করে খুব জোরে হেসে উঠতাম। আমার অট্টহাসি তোমাকে বিব্রত করতো। আমি চাইতাম তোমাকে বিব্রত করতে, আমি চাইতাম তুমি কষ্ট পাও। তোমার ওই ধর্মবিশ্বাসের অপরাধে ইচ্ছে করেই তোমাকে কষ্ট দিতে চাইতাম আমি। তোমার ধর্মবিশ্বাসকে, তোমার বোরখা পরাকে, তোমার ওই কোরান হাদিস পড়াকে, তসবিহ জপাকে সেই ছোটবেলা থেকেই ঘণা করতাম। তোমাকে মা হিসেবে মানতে আমার লজ্জা হতো। তোমাকে বোকা, বুদ্ধিহীন, গবেট, গদর্ভ ছাড়া কিছু মনে হয়নি। যাকে দেখতে নারি তার চরণ বাঁকা বলে একটা কথা আছেনা? তোমার কিছুই আমার পছন্দ হতো না। তোমাকে দেখতেও লাগতো খুব বিচ্ছিরি। তুমি আর নিজের দিকে তাকাবার সময় পেতে কোথায় মা? তোমাকে তো বাবা বলেই দিয়েছিল যে তুমি কুৎসিত। সুন্দর করে কুচি দিয়ে শাড়ি পরে, চুল আঁচড়ে, মুখে পাউডার লাগিয়ে বাবার সামনে দাঁড়িয়েও দেখেছো বাবা ফিরেও তাকায় না তোমার দিকে, বরং আরও জোরে সোরেই কুৎসিত বলে গালি দেয়। তুমি এরপর ছেড়েই দিয়েছিলে নিজের যত্ন নিতে। তোমার সময়ই বা কোথায় ছিল। সারাদিন তো রান্নাঘরেই যেতো তোমার। সবার জন্য রান্না, সবার জন্য বাড়া। সবাইকে খুশি রাখা। গোসল করে তোমার ভেজা চুল হাতের কাছে যা পেতে তাই দিয়ে, দড়ি বা গামছা, বেঁধে রাখতে। ওভাবে রাখতে রাখতেচুলপড়তে শুরু করলো, তাতেই বা তোমার ভূক্ষেপ হবে কেন? কে আর তোমাকে কবে কেশবতী বলবে! কুরূপা কুৎসিত নামই তো খোদাই করে জীবনে গেঁথে দেওয়া হয়েছে। ঠোঁট শুকিয়ে চড়চড় করতো। ধুলোবালি, আগুন, ছাই আর নোংরার মধ্যে থাকতে থাকতে তুমি জানতে না নিজের শরীর বলে কিছু আছে তোমার। নিজের জীবন বলে কিছু আছে। অন্যের গোলামি করার জন্য তোমার জন্ম। তোমাকে কুৎসিত বললে তোমার আর কোনও দুঃখ হতো না। তুমি নিজেও বলতে আমাদের, আমি তো কুৎসিত, কিন্তু তোমরা সুন্দর হয়ে থাকো। তোমার দুটো মেয়ে যেন প্রতিদিন গোসল করে, চুল শুকোয়, চুল আঁচড়ায়, মুখে ক্রিম দেয়, গায়ে অলিভ ওয়েল মাখে, ত্বকের যত্ন করে বলতে। নিজের কথা ভাবার তোমার কোনও প্রয়োজন ছিল না। আর নিজের যত্ন যদিকরতে চাইতে, তাহলে সংসারের কাজে ফাঁকি দিচ্ছ বলেই মনে করবে হয়তো, তাই যত্ন করতে হয়তো ভয়ও পেতে। সেই তোমাকে, সুইডেনে প্রথম বললাম আমি, মা, তুমি তো খুব সুন্দর। বললাম, কারণ তুমি আসলেই খুব সুন্দর। তুমি আমার কথা শুনে চমকে উঠেছে, বিশ্বাস করোনি। কারণ তুমি বিশ্বাস করো না যে সৌন্দর্যের ছিটেফোঁটা তোমার শরীরে কোথাও আছে। তোমার জীবনে তুমি বোধহয় আর কিছুতে অত খুশি হওনি, যত খুশি হয়েছিলে তোমাকে সুন্দর লাগছে বলায়। কোনওদিন যে কথাটি তুমি কারও কাছ থেকে শোনোনি, সে কথাটি তোমার, পঞ্চাশোর্ধ বয়সে প্রথম শুনলে, তোমার কন্যা বললো। আর কী চাই তোমার! ভালোবাসা এর চেয়ে বেশি তুমি কোনওদিন অনুভব করোনি। তুমি কুৎসিত, এই অপবাদ দিয়ে তোমার স্বামী তোমাকে সারাটা জীবন ছি ছি করেছে, পায়ে ঠেলেছে, ঝি চাকরের মতো ব্যবহার করেছে, বাইরে অন্য মহিলা নিয়ে ঘুরেছে, এমনকী বিয়েও করেছে তাদের, সেই তুমি শুনছো যে তুমি সুন্দর। আমার এই বাক্য, যদিও বিশ্বাস করোনি তুমি, চোখে তোমার জল এনেছে। বলেছো, তুমি তো ভালোবাসো আমাকে, তাই বলছে।
কে বলেছে তোমাকে ভালোবাসি আমি, মা? তোমাকে তো কোনওদিন ভালোবাসিনি। জার্মানি থেকে আনা তোমাকেশ্যাম্পুদিয়েছিলাম, বার বার বলেছি, খুব ভালো শ্যাম্পু। সারাজীবন দুদণ্ড সময় পাওনি নিজের শরীরের যত্ন করার, ভেজা চুল বেঁধে রেখে চুল উঠিয়েছে, চুলের বারোটা বাজিয়েছে, সেই চুলকেই যখন দেখতাম সুন্দর লাগতো, বলেছি, বাহ কেশবতী লাগছে। তোমাকে। আসলে তোমার চুলের প্রশংসা না করে আমি ওই বিদেশি শ্যাম্পুর প্রশংসা করতাম। তুমি চলে যাওয়ার অনেক পরে আমি নিচের তলার স্নানঘরে গিয়ে দেখেছিলাম আমার দেওয়া সেই বিখ্যাত শ্যাম্পুটিকে। আসলে ওটা ছিল কনডিশনার। শ্যাম্পু ছিল না। আমার তো জার্মান ভাষা বোঝার ক্ষমতা নেই, তাই তোমার কপালে ওই কনডিশনার জুটেছিল। আমি নিজে তো শ্যাম্পুই ব্যবহার করতাম, তোমাকে যখন দিলাম ব্যবহার করতে শ্যাম্পু, এই ভুলটা কেন হয়েছিল? আসলে আমি ইচ্ছে করে ওই ভুল করিনি। খুব তাড়াহুড়ো করেছিলাম নিশ্চয়ই, বুঝতে চেষ্টা করিনি, ও কি সত্যিই শ্যাম্পু নাকি অন্য কিছু। তুমি কি যে খুশি হয়েছিলে, বিদেশি ক্রিম বা শ্যাম্পু তোমাকে ব্যবহার করতে দিচ্ছি বলে। ওসবকেই তুমি ভালোবাসা বলে ভুল করেছিলে। আসলে বিদেশে তো বিদেশি জিনিসই মেলে মা। আমার তো সুইডেনের মতো দেশে দিশি সাবান শ্যাম্পু পাওয়ার কথা ছিল না। না মা না, ভালো তোমাকে কোনওদিন বাসিনি। বাসলে তোমাকে দেশে থাকাকালীনই ভালোবাসতাম। চার বছর বিদেশে থাকার পর তোমাকে হঠাৎ করে ভালোবাসবো, অত ভালো তো আমি নই মা। ভালোবাসলে তোমাকে আমি যে করেই হোক একজন বড় ডাক্তার দেখাতাম, আমার একটা বড় অসুখ আছে, তোমার ওই কথাকে আমি গুরুত্ব দিতাম, ভালোবাসলে তোমাকে নিয়ে আমি ভালো কোনও হোটেলে থাকতাম, শুধু তুমি আর আমি, অন্যের বাড়িতে অন্যের অঙ্গুলি নির্দেশে চলতাম না, ভালোবাসলে তোমাকে আমি টাকা পাঠাতাম, প্রচুর তো পাঠিয়েছি বাবাকে। যার ছিল তাকে দিয়েছি, যে কোনওদিন টাকা পয়সার মুখ দেখেনি, তাকে কেবল অন্যরাই বঞ্চিত করেনি, আমিও করেছি। ভালোবাসলে তোমাকে রান্নাঘরের দিকে ঠেলে দিয়ে আমি বই লিখতে বসতাম না। ভালোবাসলে তোমার ভালোবাসাকে আমি মূল্য দিতাম। কিছুই করিনি আমি। বরং এক ঘর অতিথির সামনে তোমাকে অশিক্ষিত বলেছি, যেহেতু তুমি সহজে ইংরেজি বলতেপারো না। ভালোবাসলে তোমাকে সামান্য হলেও শ্রদ্ধা করতাম আমি। অথচ এই তুমিই কি না বলেছো যখন সুইডেনে গিয়েছিলে আমি নাকিতখন প্রচুর ভালোবেসেছি তোমাকে, অথচ এই তুমিই বলেছো, তোমার জীবনের সবচেয়ে সুখের সময় তুমি কাটিয়েছো সুইডেনে। আহ মা, এমন কেন তুমি ভাবলে বলো তো! এক তুষার ছাড়া আর তো কিছু দেখনি। আর তো কিছু তোমাকে দেখাইনি। আর তোকিছুই তোমার জন্য করিনি। তুষার কী আমি দেখিয়েছিনাকি। ও তো আকাশ থেকে ঝরেছে বলে দেখেছো। তুষারপাত দেখে তোমার সে কী বিস্ময়। না, তোমার ওই মুগ্ধতার পেছনে আমার কোনও ভূমিকা নেই মা। আমি শুধু তুষারে বা বরফে তোমাকে ছেড়ে দিয়ে কিছু ছবি তুলেছি তোমার ভিডিও ক্যামেরা কিনেছিলাম, তোমার ওই বরফ বিস্ময় তুলে রেখেছি। এ ছাড়া আমি তো আর তোমার জন্য ভালো কিছু করিনি মা। যদি তোমার চিকিৎসা করাতাম, তুমি বেঁচে যেতে মা। তোমার ওই ভয়ংকর অসুখ থেকে বাঁচতে তুমি। আমি তো করিনি। আমি তো বাঁচাইনি তোমাকে, বরং মেরেছি। তুমি হয়তো স্বীকার করবে না যে আমি তোমাকে মেরেছি, কিন্তু আমি তো জানি মা। স্বীকার না করলেও মনে মনে তো জানো তুমি মা। তোমার স্বামী, তোমার দুই ছেলে, তোমার দুই মেয়ে, অবহেলা করতে করতে তোমাকে মেরেছে। চিকিৎসা না করাতে করাতে মেরেছে। তোমার খুব আশা ছিল আমার কাছে এলে আমি তোমার ডাক্তার মেয়ে, বোধহয় তোমার ওই ভয়ংকর অসুখের, যে অসুখকে অসুখ বলে কেউ মানিনি, কিন্তু তুমি বুঝতে, তুমি একাই শুধু বুঝতে, চিকিৎসা আমি করাবো। কিন্তু মা, তোমার শুধু আশায় বসতি। তোমার ডাক্তার মেয়ে, যাকে নিয়ে কত স্বপ্ন দেখতে, সে তোমার ওই অসুখের দিকে ফিরেও তাকায়নি। যতদিন সুইডেনে ছিলে, আমি শুধু বাবার কথাই বলেছি, বাবার অসুখের কথা। তুমি যখন বলতে বাবা ভালো আছে, বেশ ভালো আছে, তোমাকে আমি খুব হিংসুটে, কুচুটে এক মহিলা ভেবেছি, শুধু ভাবিইনি, প্রকাশও করেছি সে কথা। বাবার একবার হার্ট অ্যাটাক হয়ে গেছে, আবার যে কোনও সময় হতে পারে, তার রক্তচাপ বেশি, যে কোনও সময় যে কোনও একটা দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে বলে কত দুশ্চিন্তা করেছি, তোমাকে সামনে রেখে বসে বসে দুশ্চিন্তা করেছি, সরবেনীরবে। অথচ নিজেই তুমি আস্ত একটি দুর্ঘটনা হতে যাচ্ছো, সেই দুর্ঘটনার আশংকার দিকে একবারও তাকিয়ে দেখিনি, দেখতে কি চেয়েছিলাম, চাইলে তো ঠিকই দেখতাম! কুকুর বেড়ালের কষ্টের দিকে কত মায়া চোখে তাকিয়েছি, তোমার দিকে সামান্য করুণার চোখেও তাকানোর অভ্যেস কোনওদিনই আমার ছিল না। তুমি আমার কাছে এলে, তোমাকে আসতে বলিনি কোনওদিন, তারপরও এলে। আসতে বলতাম বাবাকে। তুমি একা কেন এলে, বাবা কেন এলোনা, এ নিয়েও তোমাকে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে জর্জরিত করেছি। যেন তুমি একা এসেছো, বাবা আসেনি, এ তোমার দোষ। তুমি ভয়ে ভয়ে আমার সঙ্গে কথা বলতে। অত দূর পথ পার হয়ে আমাকে দেখতে আসার স্পর্ধার জন্য ভয়। তুমি ছিলে আমার অনাকাঙ্ক্ষিত অতিথি। তুমি তো জানতে সে কথা, মা। তুমি বলোনি, কিন্তু বুঝতে। বাবাকে দেখলে যত খুশি আমি হতাম, তোমাকে দেখে তার সামান্যও হইনি। দিন রাত গেছে বাবার অসুখ নিয়ে আমার ব্যগ্রতায়, ব্যাকুলতায়। তুমি দেখেছো আমার উদ্বেগ। বাবার প্রতি আমার তীব্র ভালোবাসা দেখেছো, অপরিসীম শ্রদ্ধা দেখেছো। এত যে বলেছো বাবা তোমার হাতে একটা পয়সাও দেয় না, তুমি কী করে চলছে চলবে সে খবর বাবা রাখে না, এমনকী অবকাশের সম্পূর্ণ দায়িত্ব তোমার কাছ থেকে কেড়ে দাদার বউকে দিয়েছে, যে বাড়ি থেকে যে সংসার থেকে তোমাকে বাধ্য হয়ে বিদেয় নিতে হয়েছে, সে বাড়িতে ঢাকা থেকে মাঝে মাঝে গেলে বাবা তোমার দিকে রেগে মেগে তেড়ে আসে, বাড়ির সবচেয়ে ছোট ঘরটিতে যে খাটে তুমি ঘুমোতে, সে খাট ভেঙেপড়ে আছে, বাবা তা উঠোনে ফেলে রেখেছে, আর খাটে যে ছেঁড়া তোশকটা পেতে শুতে, সেটাও শতচ্ছিন্ন, বাবাকে শত বলেও খাট সারাতে পারোনি, শত বলেও কোনও একটা নতুন তোশক কোতে পারোনি, তুমি ঘুমোতে সামনের বারান্দায় মেঝেয়, মশার কামড় খেতে খেতে, রাস্তার অচল অক্ষম ভিখিরির মতো, বাবাও সামনে আসতো না, দাদাও না, হাসিনাও না, দাদার ছোট ছেলে সৌখিন একদিন বলেছিলো, ‘দাদু তুমি যে মাটিতে মশারি ছাড়া ঘুমাও, তোমার কষ্ট হয় না? ’ শুনে তুমি কেঁদেছে। অন্ধকারে চোখের জল বুঝি কারও চোখেপড়ে! সবাই তো বিছানায় আরাম করে সারা রাত্তির ঘুমিয়েছে, তুমি বারান্দায় একা, অন্ধকারে, মশার কামড়ে –এসব শুনেও আমি বাবা বাবাই করেছি। আমার একটুও বাবার ওপর রাগ হয়নি। দাদা বা হাসিনার ওপরও হয়নি। কেন হয়নি মা? তোমার গল্প কি আমি বিশ্বাস করিনি? নাকি তোমার গল্প আমার খুব চেনা গল্প! নাকি তোমার গল্পগুলো আমার গা সওয়া হয়ে গেছে! তুমি তো এমনই ব্যবহার পেয়ে এসেছো, আমি তো জন্ম থেকে দেখেছি। জন্ম থেকে চেনা হলে কোনও অন্যায়কে বোধহয় আর অন্যায় মনে হয় না। আশ্চর্য, কত কিছুরই তো জীবনে প্রতিবাদ করেছি, কেবল তোমার ওপর কোনও অন্যায়ের প্রতিবাদ আমি করিনি। তোমাকে ভালোবাসিনি কোনওদিন। জন্ম দিলেই বুঝি সন্তান ভালোবাসে মাকে? তুমি তো দাদাকেও জন্ম দিয়েছিলে, দাদাকে ভালো তো তুমি কম বাসোনি। দাদা তো কই বিয়ে করার পর বউ সঙ্গে নিয়ে তোমাকে জ্বালাতো। তোমার জ্বর হলে একটু ওষুধের জন্য যখন অনুরোধ করতে, পচাপুরোনোপ্যারাসিটামল এনে দিত, মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়া অচেনা দিশি কোম্পানির বাতিল অ্যান্টিবায়োটিক দিত। দাদার হাতেই ছিল বাবার ওষুধের দোকান আরোগ্য বিতানের দায়িত্ব। ওষুধপত্রের হিসেব নিকেশ দাদাই রাখতো। দাদাই তখন ডাক্তার। তোমার পেটের ছেলে, মা। তুমি ভাবতে ছোটদা তোমাকে খুব ভালোবাসে। কেন মা? যেহেতু সে বিমানের ডিউটি সেরে বাড়িতে বিমানের কিছু স্যান্ডুইচ, আপেল বা কমলার রস নিয়ে আসতো? ওসব তো গীতা থাকাকালীন তোমাকে কোনওদিন দেয়নি। গীতা ছিল না বলে অগত্যা তোমার হাতে পড়েছে। ওগুলোর জন্য তো একটি পয়সা খরচ হয়নি ছোটদার। ফ্রি জিনিস। বাড়তি জিনিস। ফেলে দেওয়া মাল। ক্রুরা বাড়িতে নিয়ে আসে বিমানেপড়ে থাকা জিনিস। আনতো বলে তুমি ভাবতে কী ভীষণই না ভালোবাসে ছোটদা তোমাকে। কেউ তোমাকে একবিন্দু দিলে তুমি তাকে এক সমুদ্র দিতে। তোমার তো টাকা পয়সা ছিল না দেওয়ার। তুমি অবকাশে গেলে বাবা আর দাদার সেবা করতে। আর ছোটদার জন্য বাবার কাছে চেয়ে চেয়ে নিয়ে আসতে চাল ডাল মাছ মাংস। ওগুলো আমার শান্তিনগরের বাড়িতে নিজে রান্না করে খাওয়াতে ছোটদাকে। বাবা থাকতে অবকাশে দাদার যত্ন করার জন্য, তোমার কাজ ছিল ঢাকায় বসে ছোটদার যত্ন করা। শুধু রান্না করে খাওয়ানো নয়, ছোটদার কাপড় কাঁচা, ইস্ত্রি করা, তার যাবতীয় সবকিছু গোছানো, সব দায়িত্ব তোমার। তোমার যত্ন কে করতো মা? ছোটদা বিমানের কাজে প্রায়ই বিদেশে চলে যেতো। তুমি থাকতে তার পথ চেয়ে। ফিরে এসে মা বলে ডাকবে, ঘরে ঢুকে হয়তো একটু জড়িয়ে ধরবে। জড়িয়ে ধরার অভ্যেস তার হয়েছে গীতাকে জড়িয়ে ধরতে ধরতে। ওই ওটুকু স্পর্শই তোমাকে আনন্দ দিত। ছোটদা কি আর বাড়িতে দুদণ্ড বসতো! কাপড় পাল্টেওই তো ছুটে যেতো বান্ধবীদের কাছে। কখনও বাড়ি ফিরতো গভীর রাতে, বেশির ভাগফিরতো না। মদ খাওয়ার অভ্যেস তো ইতিমধ্যে বেশ করে নিয়েছে। তুমি মদকে মদ বলতে না। বলতে কী সব যেন’। বিয়ারের ক্যানগুলোকে বলতে সবুজ কৌটোর কোক’। বুঝতে ওসব খাওয়া ভালো নয়, বুঝতে নিশ্চয়ই। ছোটদার বিরুদ্ধে তোমার কোনও অভিযোগ ছিল না। ছোটদা কেন আমার বাড়িতে থাকে, কেন সে অন্য কোথাও চলে যায় না এসব নিয়ে আমি কম চিল্লিয়েছি? তুমি চুপ করে শুনে গেছো, মন খারাপ হয়েছে তোমার। বলতে, বাবাও তোমাকে উঠতে বসতে অপমান করে, দাদাও করে। এক ছোটদাই তোমাকে ভালোবাসে, ছোটদা সেই ছোটবেলায় বিয়ে করে বাড়ি ছেড়েছিলো, গীতা কোনওদিন ছোটদাকে বাবা মার কাছে ভিড়তে দেয়নি, ছেলেমেয়ে নিয়ে গীতা আমেরিকায় চলে যাওয়ার পর ছোটদাকে এতকাল পর কাছে পেয়েছো, সে দূরে চলে গেলে তোমাকে দেখার কেউ নেই, কিন্তু আমার বাড়িতে কে থাকবে না থাকবে তার সিদ্ধান্ত তো আমিই নেব, তাও বুঝতে। তুমি অসহায় বসে থাকতে আমার আস্ফালন দেখে। তোমাকে কষ্ট দিচ্ছি জেনেই কষ্ট দিয়েছি। শান্তিনগরের যে বাড়িতে তোমরা থাকে, সে তো আমার বাড়ি, তা আমি চিৎকার করে, গালাগালি করে, যাচ্ছেতাই কথা বলে বোঝাবো। তা না হলে বুঝবে কী করে তুমি! তোমাকে তো বোঝাতে হবে আমার প্রতাপ। তোমার নরম মনটি যে কত নরম তা বোঝার সাধ্য কেন আমার হবে। আমি তো দুর্যোগ সইছি। দেশ ছাড়তে হয়েছে। তোমাদের সবাইকে ত্যাগ করতে হয়েছে। নিজের বাড়িগাড়ি, নিজের সাজানো ঘর, নিজের যা কিছুসব ত্যাগ করতে হয়েছে। যখন বললে যে হাশেম মামার বড় মেয়ে শাবানা তার স্বামী নিয়ে দুদিন এসেছিলো আমার বাড়িতে। আমি চমকে বললাম, শুনেছি ওই স্বামী লোকটা ইসলামি শিবিরের লোক! সে কেন এসেছে আমার বাড়িতে! মুখ তোমার মুহূর্তে বেগুনি হয়ে গেল, বললে স্বামী লোকটা নাকি আমার লেখার ঘরে বসে আমার একটি বই পড়ে আমার লেখার প্রশংসা করছিলো, সে হতে পারে ধার্মিক, কিন্তু মৌলবাদী নয়। আমি তো ধার্মিক আর মৌলবাদীতে পার্থক্য করিনা, তুমি করো। তোমাকে আমি দোষ দিয়েছিতুমি আমার শত্রুদের আমার বাড়িতে আপ্যায়ন করেছো বলে। আমার একটুও মনে হয়নি, একা একা যে বাড়িতে দিনের পর দিন কাটাও, সেখানে কেউ এলে, আত্মীয় স্বজন কেউ, তোমার ভালো লাগে। নিজের সংসার হারিয়ে মেয়ের সংসারকে নিজের বলে মনে করেছিলে। তা আমি মনে করতে দেব কেন! তুমি যে আমার বাড়িতে থাকছো, সে আমি করুণা করছি বলে সে বাড়িতে তুমি থাকতে পারছো, কিন্তু বাড়িতে কে ঢুকবে বা না ঢুকবে তার সিদ্ধান্ত আমি ছাড়া আর কারর নেওয়ার অধিকার নেই, তুমি মা হয়েছে তাতে কী, তোমারও নেই। সে কথা আমি তোমাকে তিরস্কার করে বোঝাই। শরাফ মামা মালোয়েশিয়া গিয়েছিল, মালোয়েশিয়াতে তাকে, জানিনা কী কারণে, সম্ভবত বৈধ পাসপোর্ট না থাকায় জেলে ভরে রেখেছিলো, সেই জেল থেকে ছাড়া পেয়ে ঢাকায় পৌঁছে আমার শান্তিনগরের বাড়িতে একটা রাত কাটিয়ে পরদিন ময়মনসিংহে চলে যায়। কিন্তু কেন আমার বাড়িতে শরাফ মামা এলো, তা নিয়ে আমি তোমাকে তুলোধুনো করলাম। শরাফ মামার মতো বদমাশ মৌলবাদী, যে আমার বিরুদ্ধে মিছিল করেছে, কেন ঢুকলো আমার বাড়িতে? তার উত্তরে তুমি মাথা নিচু করে থেকেছো। মাঝে মাঝে নরম স্বরে কেবল বলেছো, ও খুব অসহায়। বলেছো, মিছিল শরাফ করেনি। আমি যদি শুনে থাকি কোথাও, ভুল শুনেছি। ভাইএর পক্ষ নিয়ে কথা বলছো বলে তোমাকে আমি স্বার্থপর, মাথামোটা, বদ, বোকা –কত কথাই না বলেছি। হ্যাঁ বলেছি মা। তোমাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য বলেছি। তোমাকে আমি ভালোবাসি না বলে বলেছি। তুমি তো আমার ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য ছিলে না। তোমার মতো ধর্মভীরু মানুষকে শ্রদ্ধা করার বা ভালোবাসার আমার তো কোনও কারণ ছিল না। শরাফ মামার মতো দাড়িওলাটুপিপরা লোককে, যে শুনেছি আমার বিরুদ্ধে ময়মনসিংহে সে সময় মিছিল করেছিলো; সারাদেশ জুড়ে যখন দাবি উঠছে আমার ফাঁসির জন্য, যে মৌলবাদীতাণ্ডবের কারণে সরকার আমার বিপক্ষে গেল, আমাকে দেশ ছাড়তে হলো, যারা আমার ফাঁসি চেয়েছে সে হোক না আমার আত্মীয়, হোক না মামা, আমি তাকে ক্ষমা করবো কেন? আমার বাড়িতে সে কী সাহসে পা রাখে। এই পা রাখার সাহস তো আমি যদি ও বাড়িতে থাকতাম পেতো না। পেলো তুমি ছিলে বলে। তুমিই সব নষ্টের গোড়া। আমারই বাড়িতে আমার শত্রুকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। কী করে সইবো এ খবর আমি! তুমি আমাকে বোঝাতে চাইলে শরাফের কানাকড়ি কিছু নেই। যে করেই হোক মালোয়েশিয়া গিয়েছিল দুটো টাকা রোজগার করতে, যেন সংসার চালাতে পারে। তাও ভাগ্যে হলো না। শরাফ মামা শুধু একটা রাত কাটিয়েছে আমার বাড়িতে, দীর্ঘ যাত্রার পর বিমান বন্দর থেকে আবার বাসে করে ময়মনসিংহে যেতে তার শরীর কুলোচ্ছিল না, একটা রাতের বিশ্রাম দরকার ছিল। মালোয়েশিয়ার জেলে এমনকী মেরেছেও তাকে। কিন্তু আমি শুনবো কেন। আমার কেন মায়া হবে শরাফ মামার জন্য। আজ আমার মনে হয় না, বাবা যে বলেছিলো শরাফ মামা মিছিলে গিয়েছিল, সত্যিই সে গিয়েছিল। শরাফ মামা পরে আমাকে বলেছে মিছিলে যায়নি সে। বরং মিছিলের লোকদের চেষ্টা করেছিলো সরিয়ে নিতে। মামাদের কাউকে তো বাবা পছন্দ করতো না। তাই হয়তো বলেছিলো। যখন দেশে তাণ্ডব চলছিল, শরাফ মামা একবার আমার শান্তিনগরের বাড়িতে আসতে চেয়েছিলো দেখা করতে, ইন্টারকমে তুমি শুনেছো নিচে সে দাঁড়িয়ে আছে। খুব ভয় পেয়েছিলে, আবার খবর টবর নিতে এলো না তো! কোথায় আমি, কী করছি! তুমি শরাফ মামাকে বাড়িতে ঢুকতে দাওনি। আমার কোনও খবরইতুমি দাওনি তাকে। তুমি তো তোমার ভাইদের চেয়েও বেশি ভালোবাসতে আমাকে মা। আমি সব ভুলে গিয়েছিলাম, সব। তোমাকে কাঁদিয়েছি, দিনেরপর দিন তোমাকে কাঁদিয়েছি। তারপরও তুমি চোখ মুছে বলেছে, দেশে চল মা। কী করে পেরেছো আমাকে ক্ষমা করতে মা? কী করে আবার বুকে টেনে নিতে পেরেছো আমাকে মা। এত কষ্ট দিয়েছি, তারপরও বলো তুমি নাকি জীবনের সবচেয়ে সুখের সময় কাটিয়েছো আমার কাছে। আমি নাকি তোমাকে খুব ভালোবাসা দিয়েছি। তুমি না পেতে না পেতে এতই অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলে যে সামান্য ওই পাওয়াই তোমার স্বর্গসুখের মতো মনে, হয়। তোমাকে যে সুন্দর বলেছিলাম, তোমাকে যে দুটো গরম জামা জুতো কিনে দিয়েছিলাম সুইডেনের ভয়াবহ শীতকালটা কাটাতে, তোমার যে সামান্য কটা ছবি তুলেছিলাম, তাই বোধহয় বলেছে। তা না হলে আর কী! তোমাকে চিকিৎসা না করানো, ভালো ডাক্তার না দেখানো, তোমাকে কাঁদানো, তোমাকে যাচ্ছেতাই ভাষায় অপমান করা, কষ্ট দেওয়া সব ভুলে তুমি ওইটুকুই কেবল মনে রেখেছে। ওইটুকু সুখের স্মৃতি নিয়ে তুমি ফিরে গেছে। তুমি কিন্তু তোমার গরম জামা জুতো টুপি মোজা যা দিয়েছিলাম, কিছুই নিয়ে যাওনি, সব রেখে গেছে। শুধু তাই নয়, তোমার নিজের সালোয়ার কামিজ, তোমার নিজের নতুন সব জামা কাপড় সব রেখে গেছো আমার জন্য। আমি যেনপরি, যদি কোনওদিনপরতে ইচ্ছে হয়। আমাকে দেশে ফেরত নেওয়ার যে সংকল্প ছিল তোমার, স্বপ্ন ছিল সব কিছুকেপুড়িয়ে ছাই করে কবর দিয়ে দিয়েছি, নিজের চোখে দেখে গেছে। আরবদেশে উমরাহ করতে গিয়ে আমার জন্য হাতের চুড়ি আর আল্লাহু লেখা লকেট সহ সোনার চেইন কিনেছিলে, সবপরিয়ে গেছে আমাকে। ছোটদা বলেছিল আমার পাঠানো টাকা জমিয়ে নাকি তুমি ওই গয়না কিনেছো। আমার ফিক্সড ডিপোজিট থেকে যে ইন্টারেস্ট চলে যেত ইয়াসমিনের ব্যাংকে, ও আমেরিকা চলে যাওয়ার আগে ওই টাকাটা তোমার নামে একটা অ্যাকাউন্ট খুলে ওখানে সরাসরি যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। তিন মাসে ছ হাজার টাকা। ও কোনও টাকা হলো! তোমার হাত খরচের টাকা। আর ও টাকাই তুমি জমিয়ে আমার জন্য সোনার গয়না কিনলে। একটি টাকাও তুমি নিজের জন্য খরচ করোনি মা। সুইডেনের বাড়িতেও অনেকটা দাসীর মতো কাজ করতে। যাওয়ার আগে আমার আলমারি গুছিয়ে দিলে নিজের হাতে। কে জানতো যে তোমার যা কিছু ছিল, যা কিছু এনেছিলে সব রেখে যাচ্ছো তুমি। তুমি জিনিসপত্রের জন্য এসেছে, জিনিসপত্র কেনা হয়ে গেছে, এখন চলে যেতে চাইছো এসব বলে কম কাঁদিয়েছি তোমাকে। যেদিন বলেছি, সেদিন গিয়ে আকুল হয়ে কেঁদেছে। আমি ওপরতলা থেকে তোমার কান্নার শব্দ পাচ্ছিলাম। কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলে জিনিসপত্রের জন্য তুমি আসোনি। তুমি শুধু ফোনে ছোটদাকে জিজ্ঞেস করেছিলে কবে ছোটদা আসবে, কবে তোমাকে দেশে ফেরত নিয়ে যাবে। আর ওই শুনে আমার মাথায় রক্ত চড়লো। তখনই তোমাকে ওসব বলেছিলাম। লোভী ভেবেছিলাম তোমাকে। লোভী বলেওছিলাম তোমাকে। তোমার মতো মানুষকে। জগতের সবচেয়ে নির্লোভ, সবচেয়ে নিঃস্বার্থ মানুষকে নির্দ্বিধায় দোষী করেছিলাম। কী ভীষণ কষ্ট তুমি পেয়েছিলে মনে, আমি এখন অনুমান করার চেষ্টা করি। তোমার জায়গায় আমি হলে আমার মতো পাষণ্ড মেয়ের বুদবুদেঅহংকারে, কুৎসিত আত্মাভিমানে কষে লাথি মেরে চলে যেতাম। ও মেয়ের মুখ কোনওদিন দেখার প্রয়োজন আমি বোধ করতাম না। ছোটদাকে জিজ্ঞেস করেছিলে কবে ছোটদা তোমাকে নিতে আসবে, কারণ অসুখ নিয়ে খুব আশংকা হচ্ছিল তোমার। এখন আমি বুঝি, অসুখটা যে ভয়ংকর কোনও অসুখ তা তুমি ঠিক ঠিক বুঝতে পেরেছিলে। অসুখটা যে আমার বা আমার বাবার বা আমার দাদার ভাষায় কিছুই না, তা নয়। কিছুই।