মা, আমি কি ইচ্ছে করলেইপারতাম না তোমাকে বড় কোনও ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে? পারতাম। তুমি যখন বলেছিলে, তোমার একটা অসুখ আছে, আমি কি পারতাম না মন দিয়ে তোমার অসুখের উপসর্গগুলো শুনতে এবং বুঝতে? আমাকে যখন বলেছো তোমার একটা অসুখ আছে, হেসে উড়িয়ে দিয়েছি, জানতে চাইনি কী অসুখ। তুমি দেখিয়েছো তলপেটের বাঁদিকটায় তোমার ব্যথা। বলেছি, ও কিছুনা। বলেছি ‘ও সম্ভবত তোমার কনস্টিপেশনের কারণে হয়েছে। ফাইবার খাও ঠিক হয়ে যাবে। তোমার তো কোষ্ঠ কাঠিন্য নেই। তবে কিসের ব্যথা! হবে কিছুর। কিছুর না কিছুর তো হবেই। বলে দিলাম ওই জায়গাটায় পুরোনো মল জমে আছে, মল জমে তোমার অন্ত্রের দেওয়ালকে ছিঁড়ে ফেলেছে তাই ব্যথা। কিছু জমে থাকলে ব্যথা মাঝে মাঝে হবেই, ও কিছুনা। শুনে তুমি ঠিক বিশ্বাস করতে পারছিলে না হয়তো। কারণ মল নিষ্ক্রান্ত হওয়ার পরও দেখেছো ব্যথার কোনও কমে যাওয়া নেই। আমি এখনও বুঝি না এত দীর্ঘ বছর ডাক্তারি বিদ্যের মধ্যে ডুবে থেকে ব্যথা হওয়ার কারণ বলতে গিয়ে আমি কেন ভুল করি! এই যদি আমার ডাক্তারি বিদ্যের নমুনা, তবে আমার ডাক্তার পরিচয়টি তো জন্মের মতো মুছে ফেলা উচিত, এবং এই ভয়ংকর নির্বুদ্ধিতার শাস্তিও আমার পাওয়া উচিত। কে আমাকে শাস্তি দেবে! আমাকে তো শাস্তি দেওয়ার কেউ নেই। আমি নিজে মহামানব হয়ে বসে আছি। মা, নিজেকে, আমি ডাক্তার বলতে চাই না আর। বলতে আমার লজ্জা হয় এখন। আমি শতধিক দিই আমার ডাক্তারি জ্ঞানকে। শতধিক দিই আমার ডাক্তার পরিচয়কে।
তোমার কষ্ট হচ্ছিল কিন্তু অভিযোগ করলে আমি বিরক্ত হতে পারি, আমার আরাম আয়েশে ব্যাঘাত ঘটতে পারে, তাই তুমি অভিযোগ করোনি মা। তলপেটের বাঁ দিকে প্রচণ্ড যন্ত্রণা নিয়ে তুমি হাঁটতে, সিঁড়ি বেয়ে প্রতিদিন বারবারই উঠতে নামতে। তোমাকে তো নিচের তলায় দিয়েছিলাম থাকতে, সিঁড়ি বেয়ে ওপরে না উঠলে আমার নাগাল কী করে পাবে! ওপরে উঠতেই হতো তোমাকে, কষ্ট পেতেই হতো। তোমার বাথরুম নিচে, তোমার ঘর নিচে, নিচেও তোমাকে নামতে হত, না চাইলেও। তুমি মা। তুমি আমাকে প্রায় চার বছর পর দেখলে, তুমি ছুটে এসেছো বিদেশ বিভুইয়ে আমাকে দেখবে বলে, আমাকে যে করে তোক দেশে ফেরত নেবে বলে, তুমি মা, তুমি গোটা চার বছর প্রতিদিন কেঁদেছো আমার জন্য, প্রতিরাত কেঁদেছো। তুমি মা। তোমাকে আমি একটা বড় ডাক্তার দেখাইনি। তুমি নিজ মুখে বলেছো তোমার একটা বড় অসুখ আছে, তারপরও না। কারণ তোমাকে আমি বিশ্বাস করিনি। তোমাকে আমি মিথ্যে ডাক্তারি দিয়ে আমার ভুল আমার অজ্ঞতা আমার মুখ দিয়ে শান্ত করেছি। ওপরেশান্ত ছিলে, আমাকে বিরক্ত করোনি। ভেতরে যন্ত্রণাপুষে ওপরে হেসেছো। আমি তো এখন বুঝি। আমি ছিলাম একটা অপদার্থ হীনম্মন্য ভীতু ভীরু অমানুষের সঙ্গে। বড় ডাক্তার দেখাতে চাইলে ওই অমানুষের কাছ থেকে কোনও রকম সাহায্য পাওয়ার কোনও সম্ভাবনা ছিলো না। সাহায্য বলতে তো ওটুকুই। বিশেষজ্ঞের নাম ঠিকানা টেলিফোন ডিরেক্টরি থেকে বের করা। ওদের ফোন করে, ওরা ইংরেজি না জানলে সুইডিশ ভাষায় কথা বলে দেখা করার একটা তারিখ নেওয়া। এই তো! সুয়েনসন সাহায্য না করলেও অন্য কোনও সুইডিশ বন্ধুকে ডাকতে পারতাম এটুকুকরে দেওয়ার জন্য। আমি সুইডিশ ভাষা জানি না। আমার নিজের কোনও গাড়ি নেই। ডাক্তারের কাছে যাওয়ার নিয়ম টিয়ম শিখিনি। কারও না কারও ওপর নির্ভর করতেই হয় আমাকে। কিন্তু মা, এগুলোকে অতিক্রম কি
আমি করতে পারতাম না! মাইব্রিটকে কেন ডাকিনি? ও তো আমার অনেকদিনের বন্ধু। কেন আমি সুইডেনের সরকার বা সুইডেনের লেখক গোষ্ঠীর সঙ্গে যোগাযোগ করে বলিনি, খুব তো আমাকে বিশাল খবর করে এনেছিলে এ দেশে, তোমরা এখন কোথায়, আমারমার জন্য ডাক্তারের ব্যবস্থা করো। মেডিসিন সাঁ ফ্রন্টিয়ার্সের অনুষ্ঠানেও তো আমাকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছিল। ডাক্তারদের সংগঠন। অ্যানডার্স নামে একটা ডাক্তারের সঙ্গেও তো পরিচয় ছিল। ফোন করে তাকে একবারপাইনি। খবর রাখারপরও সে ফোন করেনি আমাকে, তাতেই অভিমান করেছিলাম, তাকেও তো সবঅভিমান ভুলে আবার ফোন করতে পারতাম! তুমি যখন দানদিরুদ হাসপাতালে, তখন তো দেখেওছিলাম তাকে ওখানে, বলিওনি, বরং পাশ কাটিয়ে গিয়েছি। আমাকে দেখতে পেলে হয়তো কথা বলতো। জানি গাড়ি চালিয়ে এখানে ওখানে নেওয়া ছাড়া সুয়েনসনের দ্বারা ভিন্ন কিছু করার মানসিক ক্ষমতা তার নেই। আমি চেষ্টা করলে পারতাম মা, আজ বুঝি যে পারতাম। কিন্তু চেষ্টাটাই তো করিনি। নিজের মার জন্য সামান্য এটুকু চেষ্টা তো যে কেউ করতো, দেশি বিদেশি যে কেউ। কেবল আমিই করিনি। চেষ্টা তো দূরের কথা, তোমার ধর্মবিশ্বাস নিয়ে সারাক্ষণ কটাক্ষ করতাম। মা তুমি কেন নামাজ পড়ো, কেন আল্লাহ বিশ্বাস করো? আল্লাহ বলে কিছু নেই কোথাও। ধরো, এত যে নামাজ রোজা করলে, গিয়ে যদি দেখ হাশরের ময়দান নেই, আখেরাত নেই, কোনও পুলসেরাত নেই? তুমি বলতে, না থাকলে তো নেইই। কিন্তু যদি থাকে? যদি থাকে, এই আশংকায় তুমি ধর্মকর্ম করো, যদি না থাকে কোনও পরকাল, তবে যে বৃথা হবে এই সময় নষ্ট, এর উত্তরে তুমি চুপ করে থাকতে। মৃদু হাসতে। না মা, বড় হওয়ার পর তুমি শুধু বলেছে, তওবা করে যেন নামাজ শুরু করি। তুমি এবার আমাকে আর নামাজ শুরু করতে বলোনি। শুধু বলেছো দেশে যেন ফিরি, যদি বলতে হয় যদি ঘোষণা দিতে হয় যে আমি আর ইসলাম বিরোধী কিছু লিখবো না, যেন সেই ঘোষণা দিয়ে হলেও, দেশের মেয়ে দেশে ফিরি। কিছু লিখবো না, এই ঘোষণা দিতে আমি নারাজ, আমি ভুল করেছি, এরকম কথাও বলবো না, তবে কী করে ফিরবো দেশে। তুমি মা কত কাউকে নিজে থেকে ফোন করেছো, তুমি বোরখা পরা মেয়ে, চিরকাল অন্দরমহলে কাটানো, পরপুরুষকে কোনওদিন নিজের মুখ না দেখানো মা তুমি শামসুর রাহমানের ফোন নম্বর যোগাড় করে তাঁকে ফোন করেছিলে, যেন, তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বলেন আমাকে দেশে ফিরিয়ে নিতে। বলেছিলে তোমাকে রূঢ় কণ্ঠে শামসুর রাহমান বলেছিলেন, আমি বললে কে বলেছেউনি ফিরিয়ে আনবেন! না আপনারা তো কাছে কাছেই থাকেন, তাই আপনারা বললে তো কাজ হবে। তোমার এই কথায় তিনি জবাব দিয়েছিলেন, কে বলেছে আমি কাছে কাছে থাকি! ’ শামসুর রাহমান ফোন রেখে দিলে তুমি কেঁদেছিলে। আর যাদেরই পাও, যাকেই পাও, তাদেরই, তাকেই হাতে পায়ে ধরেছো যেন আমাকে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। মা, এত ভালোবাসতে আমাকে তুমি! তুমি আমাকে ঘটনাগুলো বলার পরও আমি বুঝিনি তুমি যে ভালোবাসো।