লেখালেখি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ায় তোমাকে নিয়ে বেশি কোথাও আমার যাওয়া হয়নি। একদিন ভাবলাম শহর দেখাবো। শহর বরফে ছাওয়া। শহরে কী একটা শীতের উৎসব হচ্ছে, ওতে তোমাকে নিয়ে গেলাম ঠাণ্ডার মধ্যে। এর মধ্যে তোমাকে বরফে হাঁটার জুতো, আর গরম ওভারকোট কিনে দিয়েছি, পুরু পশমের একটা রাশান টুপিওএসব পেয়ে তুমিও সেই আগের মতোই শুরু করলে, আমাকে পরতে হবে আগে। তুমি কোনও নতুন পোশাক কেন যে পরতে অস্বস্তি বোধ করতে! নতুন কিছু পরার মতো মূল্যবান নিজেকে কখনও তোমার মনে হয়নি! শহরের স্কানসেন নামের জায়গাটায় মেলা বসেছে, পিচ্ছিল বরফে হাঁটতে তোমার অসুবিধে হচ্ছে, সুয়েনসনকে বলেছিলাম ও যেন তোমাকে হাঁটতে সাহায্য করে। সাহায্য করতে নিলেই তুমি পিছলে পড়লে। তারপরও তোমাকে বরফে হাঁটালাম। আমি যে বরফে হাঁটতে শিখেছি, তা দেখাতেই কী তোমাকে ওই অতক্ষণ ওখানে রেখেছিলাম! দূর থেকে চিড়িয়াখানার কিছু প্রাণী দেখলে তুমি। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা হরিণ, বড় হরিণের মতো মুস, ষাঁড়ের মতো প্রাণী, খুব বেশি কিছু দেখনি, কিন্তু যা দেখেছো, তাতেই তুমি খুশি। কী অল্পতে খুশি হতে তুমি মা! তোমাকে কত অল্পতে খুশি করা যেত। ভালোবাসি এই বাক্যটি কোনওদিন তোমার জন্য কেউই উচ্চারণ করিনি। করলে তুমি কী করতে, তা আমি অনুমান করতেও পারি না। নিজের দেশটাই তোমার দেখা হয়নি, দেশের কোনও চিড়িয়াখানাতেই তুমি যাওনি কখনও, বিদেশের চিড়িয়াখানার দুটো সাদামাটা প্রাণী দেখে তুমি খুশিতে বাচ্চা মেয়ের মতো হাসলে। অবশ্য তোমার সব আনন্দ নষ্ট করে দিয়েছিলাম আমি, স্কানসেন থেকে বাড়ি ফেরারপথে যখন তোমার আঙুলের ওপর গাড়ির শক্ত ইস্পাতের দরজা প্রবল বেগে ছুঁড়ে দিয়েছিলাম। অবশ্য না জেনেই দিয়েছিলাম মা। আমি জানতাম না তুমি যে গাড়ি থেকে নামতে গেলে বা গাড়িতে উঠতে গেলে গাড়ির সামনে কোথাও ধরে নামো বা ওঠো। কঁকিয়ে উঠলে ব্যথায়। আরও হয়তো কঁকাতে, আমি তোমাকে ব্যথা দিয়েছি এই ভেবে আমি যদি কষ্ট পাই, তাই তাকাওনি। বাড়ি ফিরে মাখন তোলার একটি ছোট কাঠের চামচ আর দড়ি দিয়ে তোমার ওই থেতলে যাওয়া আঙুলটা সোজা করে বেঁধে দিয়েছিলাম। হাড় ভেঙে গিয়ে থাকলে আঙুলের নড়াচড়া বন্ধ রাখতে হয়। পরদিন এক্সরে করিয়ে আনলাম। আমার ওইটুকু শুশ্রূষা পেয়ে তোমার সমস্ত যন্ত্রণা দূর হয়ে গিয়েছিলো। এক তোড়া সুখ এসে বেদনার ভারি বোঝাকে তুলোর চেয়েও হালকা করে দিয়েছিলো। পারো কী করে, মা? আমার যদি ওরকম হতো তোমার কোনও ভুলের জন্য, আমি তোমার দিকে ছুঁড়ে দিতাম যত গালি আমি জানি, যত নিন্দা জানি, সব। তোমাকে এমন দোষী করতাম, যেন সারাজীবন তোমাকে কেঁদে কাটাতে হয়।
তোমার বিশ্বাস, তোমার কোনও একটা অসুখ হয়েছে। অসুখটা, তুমি ভাবতে খুব বড় কোনও অসুখ। তোমার এই অসুখের চিকিৎসার জন্য তুমি দ্বারে দ্বারে ঘুরেছে। কেউ তোমার অসুখ সারায়নি। তোমার অসুখ নিয়ে ভাবার কারও কোনও সময় ছিল না। বাবাকে বলেছে, দাদাকে বলেছো, বাবা আর দাদা তোমার অসুখ নিয়ে বিদ্রম্প করেছে। তুমি কি ভেবেছিলে আমিই হবো তোমার সহায়? হ্যাঁ ভেবেছিলে। তোমার শেষ ভরসা ছিলাম আমি। কিন্তু আমিও তো তোমার অসুখ নিয়ে ভাবিনি। অসুখের কথা শুনতে চাইনি। শুনতে চাওয়ার, ভাবার আমার সময় ছিল কি? ছিল না। তোমার জন্য সময় খরচ করে আমার অভ্যেস নেই। তুমি এসেছো বিদেশে আমাকে দেখতে। আমার জন্য রান্না করবে, আমাকে মুখে তুলে খাওয়াবে, আমার বাসন মাজবে, আমাকে চা করে দেবে, আমার কাপড় চোপড় গুছিয়ে দেবে, আমার বিছানা পরিষ্কার করে দেবে, যেমন করতে দেশে। দেশ থেকে বিদেশ এসেছি, তাই বলে মানুষটা তো বদলে যাইনি। স্বভাব চরিত্র যাবে কোথায়! হেসে উড়িয়ে দিয়েছি তোমার ওই ন্যাকামো। অসুখ আবার কী! ডায়বেটিস হয়েছে। ডায়বেটিসের জন্য ইনসুলিন নিচ্ছো, ব্যস। এখন খাওয়া কন্ট্রোল করো। ছোট গ্রামমতো জায়গাটির ছোটখাটো একটি ডাক্তারখানায় নিয়ে তোমার রক্তের চিনি মাপিয়ে এনেছি। ইনসুলিনেও কমছে না চিনি। তোমাকে সব অখাদ্য খাওয়ানোর আয়োজন করলাম। লিক নামের অখাদ্য তোমাকে খেতে হবে। আমিই কি কোনওদিন খেয়েছি লিক? গা গুলিয়ে উঠতো তোমার, তারপরও অখাদ্য গিলতে বাধ্য হতে। ভাবতে তোমার অসুখ বুঝি সেরে যাবে। আমি তোমার ডায়বেটিস নিয়ে চিন্তিত, কিন্তু তোমার ও নিয়ে অত ভাবনা নেই। আমাকে দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি দেওয়ার চিন্তা তোমার। তাই একরকম না খেয়ে, অল্প খেয়ে, অচেনা অখাদ্য খেয়ে আমাকে দুশ্চিন্তা থেকে রেহাই দিতে। তোমার চিনির মাত্রাটা স্বাভাবিক করার সংকল্প আমার, তাতেই ভেবে নিয়েছি তোমার অসুখের চিকিৎসা হবে। নিজের মেয়ের ডাক্তার হওয়ার সুফলটাও তুমি হাতে নাতে পেয়ে যাবে। কিন্তু মা, ডাক্তার হওয়ার পেছনে এই যে দীর্ঘ বছর ব্যয় করেছি, আর এই দীর্ঘ বছরে তুমি যে দিনরাত স্বপ্ন দেখে গেছো, মেয়ে ডাক্তার হচ্ছে, কোনও অসুখ বিসুখে মেয়ে
তোমাকে ভুগতে দেবে না, যে স্বপ্ন নিয়ে তুমি আমাকে পাঁচ বছর ডাক্তারি পড়ার সময় যত্ন করেছো, ডাক্তারি করার আটটা বছর সময় শুধু যত্নই করোনি, আশা নিয়ে আকুল চোখে তাকিয়ে থেকেছো আমার দিকে, কী লাভ হলো? কোনওদিন আমি তো তোমার ওই পাইলস নামক অসুখটিকে অসুখ বলে মনে করিনি। কোনওদিন বলিনি, চল তোমাকে একদিন হাসপাতালে নিয়ে যাবো বা কোনও ডাক্তার দেখাবো। আমিও আমার বাবার মতো তোমাকে বলে দিয়েছি, ওই পাইলস টাইলসের কোনও চিকিৎসা নেই। তুমি কি হতাশ হতে মা? নিশ্চয়ই হতে। অথবা নিজেকে বোঝাতে যে মেয়ে তো আর মিথ্যে বলছে না, বোধহয় চিকিৎসা নেই, বোধহয় এই অবিরাম রক্তস্রোতের মধ্যে ভেসে ভেসেই জীবন কাটাতে হবে, বোধহয় এ সমস্যা কোনও গুরুতর কোনও সমস্যা নয়। নিশ্চয়ই নয়, তা না হলে নিজের মেয়েই তো চিকিৎসা করাতো। স্বামী না হয় ভালোবাসে না, স্বামী না হয় ফিরে তাকায় না। কিন্তু নাড়িছেঁড়া ধন ব্যস্ততার জন্য হয়তো মার কাছে দুদণ্ড বসার, দুকথা শোনার সময় পায় না, তাই বলে কি চিকিৎসা করবে না, যদি পাইলসের ঘটনাটি স্বাস্থ্যের কোনও সত্যিকার সমস্যাই করতে! যতই রক্তপাত হোহাক, এ কোনও সমস্যা নয় –আমার এই বাণী তোমাকে স্বস্তি দিয়েছিল। হ্যাঁ, ডাক্তার-কন্যা থেকে পাওয়া আশ্বাস। এর চেয়ে বড় আর কী থাকতে পারে একজন মা’র জীবনে। আর কার ওপরই বা তুমি এত ভরসা করতে পারো!