জানতে লিখছি, জানতে না যে যা বলোনি, তাও লিখেছি আমি। একদিন কোথাও বোধহয় গিয়েছি বাড়িতে তোমাকে একলা ফেলে। ফিরে দেখি তুমি খুব মন খারাপ করে বসে আছে। কমপিউটার থেকে লেখার কিছু প্রিন্ট আউট বের করেছিলাম, ওগুলো টেবিলের ওপরই ছিলো। হয়তো তুমি আমার লেখার ঘরটা গুছোতে গিয়ে দুএকটা কাগজপড়ে ফেলেছো, তোমার নিন্দা তো পাতায় পাতায় ছিল। ফজলি খালা সম্পর্কে যা লেখা হয়েছে, তা পড়ে খুব মন খারাপ হয়ে গিয়েছিলো তোমার। তুমি বাড়ি থেকে রান্না করা খাবার বা বাড়ির ফলমূল লুকিয়ে নিয়ে যেতে পীরবাড়িতে, নিজের ভালো ভালো শাড়ি দিয়ে দিতে ফজলিখালাকে, ফজলিখালা আর তার মেয়েরা সেগুলো কেটে ওড়না বানিয়ে পরতো। তোমাকে হয়তো ভালোবাসিনি মা, কিন্তু চাইনি তুমি ওসব পড়ো, চাইনি তুমি কষ্ট পাও। তোমার মন খারাপ দেখে, সত্যি বলছি, আমারও মন খারাপ হয়েছে। ছোটবেলায় সেই যে বিশ্বাস জন্মেছিলো তুমি বোধহয় সব ঢেলে দিচ্ছো পীরবাড়িতে, সেই বিশ্বাসের কথাই আমি লিখেছি। বিশ্বাসটা জন্মাতে বাবাই বোধহয় সাহায্য করেছিলো, আর তোমার ঘন ঘন পীরবাড়ি যাওয়াকে বাড়ির কেউই তো আমরা ভালো চোখে দেখিনি। তোমার মন যেন খারাপ না হয়, বাড়ির জিনিসপত্র লুকিয়ে, পালিয়ে বিয়ে করে ছোটদা যে নতুন সংসার গড়েছিলো, ওই সংসারে দিয়েছে, তা আমার লেখার আরেকটা অংশ থেকে জোরে জোরেপড়ে শুনিয়েও দিই। এ থেকে অবশ্য কিছু প্রমাণ হয়নি যে, ফজলিখালাকে দাওনি। তোমাকে বোকা বানাতে চেয়েছিলাম। তুমি শুধু একটা অনুরোধই আমাকে করেছিলে, ফজলিখালার নামটা যেনপাল্টেদিই। তুমি বুঝেছিলে, ঘটনাপাল্টবো না। কোনওদিন ফজলিখালা যদি পড়ে বইটা, কষ্ট পাবে। ফজলিখালাকে তুমি কষ্ট দিতে চাওনি। তোমার নিজের কষ্ট হয় হোক। তোমার কথা রেখেছিলাম মা, ফজলিখালার নামটা পাল্টে দিয়েছিলাম। কিন্তু প্রথম সংস্করণেই। দ্বিতীয় সংস্করণ থেকে ফজলিখালা ফজলিখালা নামেই রয়ে গেছে। নাম পালে কি মানুষ পাল্টে যায়!
০২. তোমার সম্পর্কেও এমন কথা
তোমার সম্পর্কেও এমন কথা লিখেছি যে জানি না পড়লে কতটুকু কষ্ট পেতে। লিখেছি আমানউদ্দৌলার সঙ্গে তুমি বিছানায় ঘন হয়ে বসে সন্ধেবেলায় কথা বলতে। আমি খুব অপছন্দ করতাম ওই লোকটার সঙ্গে তোমার অমন গল্প করা। তোমাকে আমার ঘেন্না হত বাবা ছাড়া অন্য কোনও পুরুষের সঙ্গে ফিসফিস করে কথা বললে। সে তোমার দেবর, তাতে কী! দেবরের সঙ্গে অত মাখামাখির কী দরকার। সম্ভবত আমানউদ্দৌলার সঙ্গে তোমার কোনও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল না, তোমরা শুধু সুখ দুঃখের কথাই বলতে। সুযোগ কোথায় ছিল সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হওয়ার। কিন্তু মা, আজ আমি ভাবি, তোমাকে যদি আমানউদ্দৌলা কখনও কোনওদিন শরীরে আনন্দ দিয়ে থাকে, মনে তোমার খুশি দিয়ে থাকে, তবে সাত বছর বয়সী আমাকে একদিন ন্যাংটো করে ঘোরতর যে অপরাধ সে করেছিলো, তার সেই অমার্জনীয় অমানুষিক অপরাধও, তার সেই দানবিক দুষ্কর্মও আমি ক্ষমা দেব। আজ যে বোধ আমার, সে বোধ যদি তখন থাকতো, তবে আমি আলগোছে তোমার ঘরের ওই খোলা দরজা, কেউ যেন না দেখে, না বোঝে, বন্ধ করে দিতাম, যেন তুমি আমানউদ্দৌলার কাছে যা চাও, তা নির্বিঘ্নে পেতে পারো। যেন তোমার অতৃপ্ত শরীর তৃপ্ত হয়। আমানউদ্দৌলা কী স্বার্থে তোমার কাছে আসতো জানি না। লোকটা খারাপ, কিন্তু খারাপ লোকও তো কাউকে কাউকে ভালো লাগা দিতেপারে, কাউকে কাউকে ভালোবাসতে পারে। এই সান্ত্বনা পেতে চাই ভেবে, সে তোমাকে অন্তত কিছুদিনের জন্য হলেও সুখী করেছিলো। তবে এই আশংকাও আমার খুব, তোমাকে সে আঘাত ছাড়া আর কিছুই করেনি। হতে পারে তোমরা নিজেদের সুখ দুঃখের কথাই খানিকটা বন্ধুর মতো পরস্পরকে বলতে। দেবরদের সঙ্গে ভাবী বৌদির সম্পর্ক তো বন্ধুত্বেরই হয় সাধারণত। যারা আমরা দূর থেকে দেখতাম তোমাদের বন্ধুত্ব, ভেবে নিতাম এর মধ্যে নোংরামো আছে। অনাত্মীয় নারী পুরুষের সম্পর্ক মানেই নিষিদ্ধ যৌনতা, এমনই ধারণা পেয়ে এসেছি। যৌনগন্ধহীন বন্ধুত্ব যে তাদের মধ্যেও হতে পারে, এই শিক্ষা দেওয়ার কেউ ছিল না কোথাও।
তুমি আমার সেবা করতে, আর আমি নিশ্চিন্তে নির্ভাবনায় লিখতাম আমার আত্মজীবনীর প্রথম বই। ঠিক দেশের মতো জীবন যাপন শুরু হল বিদেশে। আমার জীবনের শুরু থেকে তুমি তো ওভাবেই সেবা করে গেছ, যখন ইস্কুলে, যখন কলেজে, এমনকী যখন চাকরি করি। খাওয়াতে, পরাতে, যত্ন করতে, আদর করতে, ভালোবাসতে। সব উদ্বেগ, সব উচাটন তোমার ওপর চাপিয়ে আনন্দ করে গেছি। ইস্কুল কলেজ ভালো ভাবে পাশ হল, চাকরি হল, সাহিত্যের লেখাপড়া শুরু হল, নাম হল। পেছনে যে আমাকে আমার বড় হওয়ায় নীরবে নিঃশব্দে নিরন্তর সাহায্য করে গেছে, সেতুমি। বাবার আদেশ উপদেশগুলোই চোখে পড়ে, কিন্তু তোমার পরিশ্রম কী সহজেই ভুলে যেতে পারি! টাকাটাকে সবচেয়ে বড় করে দেখি, ভালোবাসাকে দেখি না। বাবা টাকা দিত বলে বাবাকেই ঈশ্বর বলে মনে করতাম। তুমি যে নিঃস্বার্থ ভালোবাসা দিতে, সেটা কেন চোখে পড়েনি আমাদের কারওরই? যে আমি ভালোবাসাকে এত মূল্য দিই, রাস্তার বখাটে ছেলেদের তেরচা চোখের তাকানোকেও ভালোবাসা মনে করেছি, হৃদয় উপুড় করে দেওয়া তোমার ভালোবাসাকেও ভালোবাসা বলে মনে করিনি। অথবা মনে করলেও অর্থের মতো কঠিন পদার্থের সামনে ভালোবাসার মতো বায়বীয় পদার্থের আদৌ যে কোনও ওজন নেই, একে অসত্য ভাবার কোনও কারণ দেখিনি।