পর পর অনেক কিছু ঘটতে থাকে। প্যারিসে আমাকে দেওয়া হচ্ছে সিমোন দ্য বুভোয়ার পুরস্কার। পুরস্কার নেবোপররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মানবাধিকার মন্ত্রীর হাত থেকে। তখন একের পর এক ফরাসি সাংবাদিকদের সাক্ষাৎকার দিতে হচ্ছে। এখানে এমনই হয়, একটা বই বের হলো, তো বই-প্রকাশক টিভিরেডিওদৈনিকসাপ্তাহিকে লেখকের সাক্ষাৎকার নেওয়ার ব্যবস্থা করেন। সবার বেলায় এমন ঘটে না। যার কিছুনাম ডাক আছে, প্রচার মাধ্যম তার প্রতিই আগ্রহ দেখায়। প্রকাশক তড়িঘড়ি করে একটা বই করেছে, বইটির ফরাসি নামের বাংলা অনুবাদ করলে দাঁড়ায় ‘আমার কারাগার থেকে। তড়িঘড়িই বলবো। সেই আমি দিল্লিতে গৃহবন্দি অবস্থায় থাকাকালীন প্রকাশক তাড়া দিলেন, ‘কিছু লেখো, অথবা ওখানে বসে যা লিখেছো, তাই দাও। আমি বলেছি, লেখার মধ্যে কিছু কবিতা, আর টুকরো টুকরো কিছু ভাবনার কথা। বললেন, ”যা লিখেছে পাঠিয়ে দাও, আমি বই করবো’। আমি অনেকবার বলেছি, ‘বই হওয়ার মতো কিছু লিখিনি। আত্মজীবনী আমি তো লিখছিই। লেখা শেষ হলে নিশ্চয়ই তোমাকে পাঠাবো’। আবারও বললেন, ”যা লিখেছে তাই নিয়েই ছোটমতো একটা বই করবো, ঠিক বই নয়, সংকলন মতো। আমি খুব ভালো করে জানি, কিছু কবিতা আর দুটো মনের কথা দিয়ে আস্ত একটা বই বের করলে পাঠক ঠকানো হবে, আর কিছু নয়। এমনিতে ধুমধাম করে ফতোয়া ফতোয়া আওয়াজ দিয়ে লজ্জা বের করার পর পাঠক নিশ্চয়ই আকাশ থেকে পড়েছে, এই বইয়ের জন্য ফতোয়া জারি হওয়ার কারণ কেউ কিছু খুঁজে পায়নি। যে বই, বা আমার যেসব লেখার কারণে সত্যিকার ফতোয়া জারি হয়েছিল, সেসব হয় ছাপানোই হয়নি, নয়তো ছাপানো হলেও ফতোয়া ফতোয়া বলে কোনও লম্ফঝম্ফও হয়নি। নতুন বইটিই সবার হাতে হাতে, সাক্ষাৎকার দিতে হচ্ছে সবখানে। সকাল থেকে রাত অবদি ব্যস্ত। লমন্দ এ পুরো পাতা সাক্ষাৎকার। কানাডা থেকে চলে এসেছেন মাইক বাক স্বাধীনতার ওপর তথ্যচিত্র বানাচ্ছেন, এমপায়ার অব দ্য ওয়ার্ড, ধারাবর্ণনা করছেন হিস্টরি অব রিডিংএর লেখক আলবার্তো ম্যাংগুয়েল। ওখানে আমার কথা ও কাহিনী থাকছে। সাত সকালে রেডিওতে ছোটো, দশটা থেকে সাংবাদিক আসতে শুরু হয়। রাত্তিরে টিভি থেকে ফেরা। ঘটা করে পুরস্কার অনুষ্ঠান হয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। সিমোন দ্য বোভোয়া পুরস্কার আমাকে দিয়েই শুরু হল ফ্রান্সে। কেবল আমি নই, আমার সঙ্গে আছে আয়ান হিরসি আলি। দু’জনে এই পুরস্কারটা পেয়েছি। তবে ও আগেই নিয়ে গেছে ওর ভাগ, আমার ভাগটা নিতে হল পরে।
এরপর আবার আমন্ত্রণ প্যারিসে। এবার প্যারিস সিটি কাউন্সিল আমাকে সম্মানীয় নাগরিক করবে। সিটি হলে বা টাউন হলে বা হোটেল দ্য ভিলে নেওয়া হল আমাকে। মেয়র উপহার দিলেন দামি, কথা বললেন চমৎকার, তোমাকে শুধু নামকাওয়াস্তে নাগরিকত্ব দেওয়া হচ্ছে না, সত্যি সত্যিই নাগরিক হিসেবে তুমি প্যারিসে থাকো, তাই আমরা চাইছি। মেয়র যখন আমাকে প্যারিসের নাগরিক কেন করা উচিত এক এক করে সিটি কাউন্সিলের অ্যাসেম্বলিতে বলছিলেন, বলা শেষ হলে, ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক দলের একশ আশি জন সদস্যই দাঁড়িয়ে হাততালি দিয়ে মেয়রের প্রস্তাব সমর্থন করলেন। দেখা করতে বেলজিয়াম থেকে আইরিন চলে এলো। স্টিভ মারা যাওয়ার পর আইরিন অনেকটাই বদলে গেছে। ছোঁক ছোঁকটা বেড়েছে। মাথা ঠিক রাখার মুঠো মুঠো ওষুধ আগেও যেমন খেতো, এখনও খাচ্ছে। তবে এখন যেন পরিমাণটা আরও বেশি। বেলজিয়ামের গেন্ট শহরে থাকছে,যার বাড়িতে থাকছে, তার দুর্নাম করেই যাচ্ছে তো করেই যাচ্ছে। ও জায়গা তার পোযাচ্ছে না, টাকা পয়সার অভাব, বয়স বিচ্ছিরি রকম বেড়ে গেছে, স্টিভের রেকর্ডগুলো এখনও বিক্রি করতে পারছে না, ইত্যাদি। কী জানি কেন, আইরিনের নিরন্তর অভিযোগ একসময় বিরক্তিকর হয়ে দাঁড়ায়। স্টিভের অসুস্থতার সময় স্টিভের বন্ধুদের সঙ্গে এমনকী আমার সঙ্গেও কী অসভ্যের মতো ব্যবহার করতো, সেসব মনে পড়ে। যে মানুষটা মারা যাচ্ছে, তাকে চোখের দেখাও দেখতে দেয়নি শেষদিকে। স্টিভকে নিজের সম্পত্তি ঠাউরেছিলো। স্টিভের অসুখ হওয়াটা আইরিনের এত অসহ্য লাগতো যে অসুস্থ স্টিভের সঙ্গেও ভালো ব্যবহার করতো না। সেই ভয়াবহ প্রতাপশালী আইরিন এখন শিশুর মতো হয়ে গেছে। মেয়র ডিনার পার্টি দিচ্ছেন আমার সম্মানে, গোঁ ধরেছে সেখানে যাবে। আমি আপত্তি করিনি। আইরিনের জন্য আবার মায়াও হয়। আমার নাগরিকত্ব পাওয়া ও আমার পাশে থেকে দেখতে পেলো বলে খুশিতে লাফায়। আইরিনকে আমি অনেকবার ক্ষমা করেছি, জানে ও। অনেকবার নিজের ভুল সে স্বীকার করেছে। আইরিনের দুঃসময়ে পাশে আমি দাঁড়িয়েছি অনেক। অনেককাল ওকে জানি। মায়া হয় যখন ওষুধ খেয়ে ওকে সামাজিক হতে হয়, মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হয়, আত্মহত্যা করার আগ্রহ দূর করতে হয়। আবারও প্যারিসে আমন্ত্রণ, যারা ফরাসি সরকারের মানবাধিকার পুরস্কার পেয়েছে, তাদের সবাইকে নিয়ে উৎসব হচ্ছে। সেই উৎসবে সামিল হলাম। এক ডিনারে ক্যাথারিন দনোভকে দেখে সে যে কী ভালো লাগে! একসময়ের ডাকসাইটে ফরাসি অভিনেত্রী। সত্যি বলতে কী, সিনেমাজগতে ক্যাথারিনকেই আমার সবচেয়ে রূপসী বলে মনে হয়। সেই সত্তর/আশির দশকের চলচ্চিত্রগুলো এখনও মুগ্ধ হয়ে দেখি! এদিকে আবার আরেক আমন্ত্রণ, আমাকে বোর্ড মেম্বার হতে হবে ‘ফাউণ্ডেশন ফর উইমেন’-এর। বিরাট এক বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান পিপিআর শুরু করছে সারা পৃথিবীর মেয়েদের সাহায্য করার জন্য এই ফাউণ্ডেশন। ফাউণ্ডেশনে থাকবে স্টেলা ম্যাককার্টনি, ওয়ারিশ দুরি, এবং আরও কয়েকজন। বড় বড় সব লোক। বিশেষ করে এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকার নির্যাতিত নিপীড়িত মেয়েদের অবস্থার উন্নতি করার জন্য কাজ করবো সবাই। প্রচণ্ড উৎসাহ পাই এ কাজে।