সিসিলিয়াই উপসালা হাসপাতালের ডাক্তারকে বলে দেয় আমার শরীরের সব পরীক্ষা করতে। চোখ, হৃদপিণ্ড, রক্তচাপ সব। সব দেখে ডাক্তার বললেন, কোথাও কোনও অসুবিধে নেই। সব ঠিক আছে। রক্তচাপের ওষুধ বরং কমিয়ে দিলেন।
সুয়েনসনের বাড়িতে আমার কাপড়চোপড় কমপিউটার জিনিসপত্র। কলকাতায় সংসার করছিলাম বটে, কিন্তু সুইডেন থেকে এত বছরের ব্যবহার করা সবকিছু সরানো হয়নি। সুইডেন থেকে সরেছিলাম, জিনিসপত্র অনেক রয়ে গেছে। সুটকেসে তেইশ কিলো করে কত আর কী নেওয়া যায়। সুয়েনসনের বাড়ি ভর্তি এখনও আমারই জিনিসপত্র। এভাবে উপসালা শহরের হোটেলে থাকার কোনো মানে হয় না। দ্বিতীয় রাতে সুয়েনসন দিয়ে যায় বটে ইন্টারনেট ব্যবহারের ডিভাইস, কিন্তু তৃতীয় রাতেই সুয়েনসনের সঙ্গে রওনা হই তার উপলাস ভিয়েসবির বাড়িতে। আমার স্টাডি ঠিক সেভাবেই আছে, যেভাবে শেষবার রেখে গিয়েছিলাম। পপকর্ন মাটিতে যেভাবে যে জায়গায় পড়েছিলো, এখনও সেখানেই আছে। চায়ের কাপ যে কটা ছিল টেবিলে, যেভাবে ছিল, সেভাবেই আছে, শুধু কাপের অবশিষ্ট চা শুকিয়ে চিহ্ন রেখে গেছে। পুরো বাড়ি পরিষ্কার করলেও সুয়েনসন কোনোদিন আমার ও ঘরটা পরিষ্কার করবে না। যদি হাজার বছর আমি না আসি, হাজার বছর এ ঘর এভাবেই থাকবে। অথচ আমি যখন ঘর দোর সাফ করি, তার স্টাডি বাদ দিয়ে সাফ করিনি কোনোদিন। পুরুষের চরিত্রে ভয়ংকর এক হিংসে কিলবিল করে। বাড়িটিতে বহু বছর থাকার কারণে বাড়িটি খুব চেনা, নিজের বাড়ি বলেই মনে হয়। নিশ্চিন্তে নির্ভাবনায় স্টাডিতে কাটাতে থাকি দিন রাত, আগে যেমন কাটাতাম।
ওদিকে উপসালার স্কলারশিপ দেওয়ার খবর ঘোষণা হয়ে গেছে। সুইডেন ছাড়িয়ে এ খবর ছড়িয়ে গেছে অন্য দেশে। সুয়েনসনের ব্যবহার দিন দুই হয়তো ভালো থাকে, এরপর যে কে সেই। আমাকে সঙ্গ দিতে থাকে মাইব্রিট। একদিন ও আমাকে টেনে নিয়ে যায় উপসালায়, স্কলারশিপের বাড়িখানা দেখতে। একজনের বাস করার জন্য খুব মন্দ নয়, তবে সে বাস অবশ্যই দীর্ঘ দিনের জন্য নয়। ক্ষণিকের অতিথি হতে চাই না আর। অনেক হয়েছি, এ দেশ ও দেশ অনেক তো হল। আমি ক্লান্ত। কোথাও বাকি জীবনের জন্য কাটাতে পারি, যেন সব ছেড়ে ছুঁড়ে আবার কোথাও ছুটতে না হয়। বাড়িটি উপসালা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছেই। জায়গা সুন্দর। দু’পা এগোলেই অরণ্য-মত কিছু। কিন্তু ভেতরে হেথা নয়, হেথা নয়, অন্য কোথা! সিসিলিয়া বলছে, উপসালা বিশ্ববিদ্যালয় আমাকে ফেলোশিপ দেবে, স্কলারশিপটি গ্রহণ করার জন্য নানা কায়দায় আমাকে উৎসাহ দেওয়া হয়। তারপরও আমার ‘হেথা নয়, হেথা নয়’ কাটে না। সুইডেনেই যদি থাকতে হয়, তবে এই বাড়িই বা কেন, সুয়েনসনের বাড়িতেই থাকতে পারি, অথবা সুয়েনসনের বাড়িতে যদি ভালো না লাগে, নিজের জন্য কোনো বাড়ি ভাড়া নিতে পারি, যে বাড়ি ছ’মাস বা এক বছর পর ছেড়ে দিতে হবে না। সিসিলিয়া জোঁকের মতো লেগে থাকে আমার গায়ে। তাঁর বাড়িতে নেমন্তন্ন করলো শুধু আমাকে নয়, আমার বন্ধু বান্ধবকেও। প্রথম মনে হয়েছিল, চমৎকার মেয়ে। কর্মঠ, বুদ্ধিমতী, আন্তরিক। তাই হতো, যদি না আমাকে প্রেস কনফারেন্সের জন্য অমন চেপে না ধরতো। নিজে, পেন ক্লাবের সদস্যদের দিয়ে, এমনকী তার সেক্রেটারিকে দিয়েও আমাকে প্রেস কনফারেন্সে রাজি করাতে মরিয়া হয়ে উঠলো। আমি প্রথম থেকেই বলেছি, আমি কোনো প্রেসের সঙ্গে কথা বলবো না। আমি দুনিয়াকে জানাতে চাই না আমি কোথায় আছি। কারণ স্কলারশিপটা আমাকে দেওয়া হয়েছে, এ খবর রাষ্ট্র করা মানে সবাইকে ঢাড়া পিটিয়ে একরকম জানিয়ে দেওয়া হল এই আমার ঠিকানা। সরকারি এই স্কলারশিপের বাড়িটা কোথায়, কারও দুমিনিট লাগবে না বের করতে। আমি এত ঝুঁকি নিতে পারবো না জীবনের। কিন্তু কে শোনে আমার কথা, সিসিলিয়া বারবারই বলতে লাগলো, না জানালে উপসালার স্কলারশিপ যে আমাকে দিয়ে উদ্বোধন হল, তা লোকে জানবে না। দেশের জন্য, এমনকী উপসালার জন্য এ বড় খবর যে, উপসালা শহর এখন থেকে পৃথিবীর নির্যাতিত লেখক শিল্পীদের পাশে দাঁড়াবে, বাক স্বাধীনতার পক্ষে লড়াই করবে। একদিন দুপুরে তাঁর বাড়িতেই আমাকে কিছুতেই যখন প্রেস কনফারেন্সে রাজি করাতে পারলো না, হাল ছেড়ে দিয়ে চলে গেল মিটিং আছে বলে। সেই মিটিংটা যে তার সেই প্রেস কনফারেন্সে যাওয়া ছিল, তা বুঝলাম পরদিন, যেদিন সারা পৃথিবীর কাগজে দেখলাম ছাপা হয়েছে, সিসিলিয়া ভিকস্ট্রম-এর উদ্যোগে উপসালা শহরে আমাকে স্কলারশিপ দেওয়া হচ্ছে, ইত্যাদি ইত্যাদি। নামের কী আশ্চর্য মোহ! ক্ষমতার জন্য সে কী ভীষণ পিপাসা! যত ভালো কাজে নাম বাড়বে, তত তার সিঁড়ি মসৃণ হবে ওপরে ওঠার। মনে মনে বলি, গুডবাই উপসালা, গুডবাই সিসিলিয়া।
চলে যাই ফ্রান্সের দক্ষিণে, মদনজিৎ সিং ডাকছেন আমায়। মদনজিৎ সিংএর বাড়িটি সত্যি বলতে কী সত্যিকার সাগরসৈকতে। সামনে নীল ভূমধ্যসাগর, পেছনে পাহাড়। এক টিলায় তার প্রাসাদ। ঘর থেকেই দেখা যায় আদিগন্ত নীলজল আর শোনা যায় পাড়ের ঢেউ ভাঙার শব্দ। সমুদ্রে সাদা সাদা নৌকো ভাসছে, পাখিরা উড়ছে, খোলা নীল আকাশ। যত না মুগ্ধ হই প্রকৃতির সৌন্দর্যে, তার চেয়ে বেশি মুগ্ধ হই মদনজিৎ সিংকে দেখে। সাতাশি বছর বয়স, আদ্যোপান্ত নাস্তিক। আশি বছর বয়সে দু’শ মিলিয়ন ডলার পেয়েছিলেন, অকাতরে ঢেলে দিয়েছেন দক্ষিণ এশিয়ার সেবায়। দক্ষিণ এশিয়ার ছেলে মেয়েদের বৃত্তি দেওয়া হবে কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে বিনে পয়সায় পড়ার জন্য। যেন দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন ধর্ম বর্ণ ভাষা সংস্কৃতির ছাত্র ছাত্রীরা একসঙ্গে পড়তে গিয়ে নিজেদের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে তুলতে পারে। মদনজিৎ সিং স্বপ্নবান মানুষ। ঠিক যে স্বপ্ন আমি দেখি, একই স্বপ্ন তিনি দেখেন। এত আন্তরিক মানবিক মানুষ তিনি, এমন মানুষের সংখ্যা পৃথিবীতে যদি বেশি হতে আরো, পৃথিবী সুন্দর হতো আরও। তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী সহ যাকে যাকে চেনেন, সবাইকে চিঠি পাঠিয়েছিলেন আমাকে বন্দিত্ব থেকে মুক্ত করে ভালোয় ভালোয় কলকাতা পাঠাতে। মৌলবাদীর কাছে হেরে যাওয়া ভারতের মতো দেশকে মানায় না। উপদেশ দিয়ে তিনি অনেককে চিঠি লেখেন। জানি না ক’জন মানেন তার উপদেশ। একসময় ভারতের রাষ্ট্রদূত ছিলেন। প্রচুর বই লিখেছেন, ছবি এঁকেছেন। এখনো লিখে চলেছেন বই। এই বয়সেও। তার সব কথা আমি মুগ্ধ হয়ে শুনি। অর্থহীন নয় তাঁর একটি বাক্যও।