রক্তচাপ যতবারই পরীক্ষা করছি, ততবারই অদ্ভুত সব রক্তচাপ দেখতে পাচ্ছি। আর যাকেই বিশ্বাস করা যায়, এই চাপকে করা যায় না। অন্য যে কোনো লোক কবেই মরে যেতো এই চাপে। আমি কী করে বেঁচে থাকি জানি না। রক্তচাপ দাবিয়ে রাখার ব্যবস্থা হয় বটে, তবে বছর পার হওয়ার পর যে ভয়ংকর সংবাদটি আমাকে নিউইয়র্কের রক্তচাপ বিশেষজ্ঞরা দিয়েছেন, তা হল, আমার রক্তচাপের চরিত্র এখন এমনই দাঁড়িয়ে গেছে, সে কখনও কোনো ওষুধে বশ মানবে না, সে তার নিজের খুশি মতো, যখন ইচ্ছে আকাশে উঠবে, যখন ইচ্ছে পাতালে ঝাঁপ দেবে। এমন রক্তচাপ নিয়েই আমাকে বাঁচতে হবে, যতদিন বাঁচি। নৃত্য যদি রক্ত একবার শিখে যায়, সে নৃত্য তার থামে না কিছুতেই। আমার রক্ত নৃত্য শিখেছে নিরাপদ বাড়ির চাপে আর তিন তিনটে ভুল ওষুধে।
পৃথিবীতে দুটো বাড়িকেই আমি বাড়ি বলে মনে করি, অথবা আমার বাড়ি বলে ভাবতে পারি। এক ঢাকায় শান্তিনগরের বাড়ি। দুই কলকাতার বাড়ি। যদিও কলকাতার বাড়িটি ভাড়া বাড়ি, কিন্তু বাড়িটির ভাড়া আমি দিয়েছি, অন্য কেউ নয়। আমার সব প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সব ওখানেই। আর ওই দুটো বাড়িতেই আমার প্রবেশ নিষেধ। আমি শুধু ঢাকা বা কলকাতা শহরের আমার বাড়িতে নয়, যে দেশে ওই শহরগুলো, সেই দেশগুলোতেও যেতে পারবো না, আমি নিষিদ্ধ। পশ্চিমের দেশে আমার নির্বাসন জীবন শুরু হয়। এই নির্বাসন সারা জীবনের, নাকি ক্ষণিকের, কিছুই আমার জানা নেই। অনিশ্চয়তার কাঁধে ভর দিয়ে আমাকে হাঁটতে হয়। কতদূর হাঁটতে পারবো, তাও আমার জানা নেই। দেশে দেশে ঘুরি ফিরি।
ভারত সরকার বিজনেস ক্লাস টিকিট দিয়েছে সুইডেনে যাওয়ার। ওয়ান ওয়ে টিকিট। পশ্চিমবঙ্গ থেকে রাজস্থান যাওয়ার টিকিট দিয়েছিল পশ্চিমবঙ্গ সরকার। ওই টিকিটও ছিল ওয়ান ওয়ে টিকিট। কলকাতা টু জয়পুর। ভারত সরকার থেকেও দেওয়া হল, দিল্লি টুস্টকহোম। তবে ভারত সরকার থেকে বিদেয়টা অনেকটা ঘটা করেই হয়েছে। অনেকটা বাড়ির অতিথিকে পোলাও মাংস খাইয়ে বিদেয় জানানোর মতো। অথবা অনেকটা ফাঁসির আসামীকে যেমন ফাঁসির আগে যা চাওয়া হয়, তাই দেওয়া হয়, তেমন। যাওয়ার দিন বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে দেওয়া হবে, এ কথা শুনে কলকাতা থেকে বন্ধুরা এসেছিল দেখা করতে। রীতিমত পাঁচ তারা হোটেলে ওদের সঙ্গে দেখা করানোর ব্যবস্থা হল। গভীর রাতে ফ্লাইট। ডিনার করো বন্ধুদের সঙ্গে। যত ইচ্ছে খাও। দুতিন ঘণ্টার জন্য বরাদ্দ হল তাজ হোটেলের একটা সুইট। যে রাতে আমার ভারত ছাড়তে হবে, সে রাতে সেই তাজ হোটেলেই ডিনার করতে হবে কলকাতার বন্ধুদের সঙ্গে। রুম সার্ভিসকে যা খুশি তাই অর্ডার করতে পারি। কেবল তাই নয়, ওই বন্ধুদের সবাইকে হোটেলে রাখা, খাওয়ানো, সবই দেওয়া হল সরকার থেকে। সবই হচ্ছে আমার ভারত ছাড়ার উপহার। প্রভু নিজেই এসব করলেন। আমি আবদার করিনি কিছুর। বরং বলেছি এত খরচ করার দরকার নেই। ওরা নিজেরা এসেছে, নিজেরাই নিজেদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করে নেবে। কিন্তু কে শোনে আমার কথা! অনেকটা মিশন সাকসেসফুল হওয়ার মহোৎসবের মতো লাগছিল সবকিছু। তবে জানি না সরকারের কে কী ভেবেছিলেন, আমি কিন্তু শরীর সুস্থ করার উদ্দেশেই যাচ্ছিলাম। রক্তচাপে কোনো অসুবিধে না দেখলে আমি হাজার বছর থেকে যেতে পারতাম। হ্যাঁ ওই বন্দি অবস্থাতেই। অন্যায় না করে শাস্তি পেতে থাকলে পালিয়ে না গিয়ে বরং ওই শাস্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা আর বাক স্বাধীনতার পক্ষে লড়াই করা, সে জীবন ভর লড়াই করতে হলেও করার পক্ষপাতী আমি। মাঝে মাঝে আমার ইচ্ছেগুলো খুব পুরোনো শোনায়, যে আদর্শের কথা বলি তা এখন অচল, মানুষ ঠিক বোঝে না কী বলছি, যেন সেই চল্লিশ বা পঞ্চাশ দশকের কোনো অশরীরী কেউ এসে কিছু বলছে। গোলগোল চোখ করে লোকে তাকায়। অনেকে ভাবে, আমার নিশ্চয়ই আসলে কোনো অসৎ উদ্দেশ্য আছে, না হলে নিজের কথা না ভেবে অন্যের কথা ভাবছি কেন, নিশ্চয়ই কোনো ফায়দা। লোটার উদ্দেশে অন্যের জন্য দরদ দেখাচ্ছি, তলে তলে অন্য প্ল্যান।
আমি তখন ভীষণ ক্লান্ত। এ আমার এক ধরনের হেরে যাওয়াও বটে। ভারত কখনও ছাড়বো, এ আমি কোনোদিন ভাবিনি। কিন্তু আগে তো বাঁচতে হবে। তারপর তো কোন দেশে যাপন করবোজীবন, সেই প্রশ্ন। ভারত আর বাংলাদেশ বাদ দিলে বাকি দুনিয়া আমার কাছে এক, সবই বিদেশ। সুইডেনে যাওয়ার উদ্দেশ্য, ও দেশে আমার চিকিৎসার সুবিধে। ও দেশের যারা নাগরিক, বা যারা বাস করে ওদেশে, সবাই পায় রাষ্ট্রের স্বাস্থ্যসেবা। নিজের পকেটের টাকা খরচ করে ইওরোপ আমেরিকায় চিকিৎসা করা! ও সত্যিকার রাজা বাদশা ছাড়া আর কেউ পারবে না। সুইডেনে নেমেই দেখি সুইডিশ পেন ক্লাবের মারিয়া, মাইব্রিট, আর সিসিলিয়াভিকম, সুইডেনের সংসদ সদস্য, আমাকে নেবার জন্য এসেছে। আমার থাকার ব্যবস্থাও করে রেখেছে। সংস্কৃতি দপ্তর থেকে আমাকে একটা গ্রান্ট বা স্কলারশিপ দেওয়া হয়েছে। উপসালা শহরে একটা অ্যাপার্টমেন্ট দেওয়া হবে আমাকে। সুয়েনসন এসেছিলো বিমান বন্দরে। কিন্তু ওর বাড়িতে যেতে গেলে বাধা আসে। কী রকম সব সাজানো মনে হয় সব। সিসিলিয়া তার গাড়িতে করে উপসালা নিয়ে গেল। জানা নেই শোনা নেই, অথচ ব্যবহার করছে যেন আমি তার কতকালের আপন। আমার জন্য তার উপচে ওঠা আবেগ আমাকে বড় বিব্রত করে। উপসালা শহরের এক হোটেলে রাখা হল আমাকে, সঙ্গে মাইব্রিট রইলো। এত দিন পর আমার মানসিক অবস্থাও বোধহয় অদ্ভুত হয়ে গেছে। পুলিশ আমকে ঘিরে রাখছে না, কিন্তু আমার খবরাখবর রাখছে। এ জানার পরও পুলিশ বেষ্টিত না হয়ে রাস্তায় বেরোতে ভয় পাচ্ছিলাম। এ কলকাতা নয়, দিল্লি নয়, এ উপসালা, তারপরও। দীর্ঘদিন ভারতে আমাকে কুঁকড়ে থাকতে হয়েছে ভয়ে, এই বুঝি কেউ মেরে ফেলতে আসছে। মৌলবাদী আজকাল পৃথিবীর সব জায়গায়। দিন দিন এমন হচ্ছে, কোনো দেশ বা শহর নেই যেখানে ওদের চিহ্ন নেই। সুইডিশ এক শিল্পী কুকুরের ছবিতে মোহাম্মদের মুখ বসিয়ে দেওয়ার পর তার ওপরও হামলা হয়েছে। তাকেই এখন লুকিয়ে থাকতে হচ্ছে। আমি আর মাইব্রিট দুজন বেরোলাম রাতে বাইরে খেতে। খেতে তো যেতেই হবে। আমার হাঁটার মধ্যে আমি লক্ষ করি আড়ষ্টতা। এদিক ওদিক তাকাই, কেউ আবার চিনে ফিলছে না তো আমাকে! যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই রাত হয়। অনেকটা সেরকম। সুইডিশ লোকেরা আমাকে সম্ভাষণ জানাচ্ছে। কেউ দৌড়ে এসে ফুলও দিল। কী কারণ হঠাৎ আমাকে এভাবে চেনার! গা ছমছম করে।