১৫ মার্চ
চোখ দেখানো হয়েছে। ডাক্তার বলেছেন, রেটিনোপাথি। তাহলে কি চোখ নষ্ট হওয়ার পথে! পথে, তবে যদি রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়, ও আর এগোবে না। দীর্ঘকাল রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে না থাকলে এই-ই হয়। কিন্তু এই অজ্ঞাতবাসে, এই অস্থির অনিশ্চয়তায় আমি রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবো না। আমাকে কোনও ডাক্তারের সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে দেওয়া হয় না। অন্তত যে বাঙালি বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের সঙ্গে ফোনে কথা বলতাম দিল্লিতে, সেই ডাক্তারও ভয়ে বন্ধ করে দিয়েছেন কথা বলা। একটা ভয়ংকর ভুতুড়ে পরিবেশ চারদিকে। যেন আমি পৃথিবী নামের গ্রহের অনেক অনেক দূরে অন্য কোনও গ্রহে। যেন আমাকে বন্দি করা হয়েছে, আমি ঠিক এই গ্রহের কারও মতো নই বলে আমাকে মহা বিপজ্জনক কিছু একটা ভাবা হচ্ছে। এই বাড়িতে নিরন্তর মানসিক চাপে আমার রক্তচাপ কোনওদিন নিয়ন্ত্রণে থাকবে বলে আমার বিশ্বাস হয় না।
একটি সিদ্ধান্ত নিই। কেন এই সিদ্ধান্তটি আমি নিচ্ছি, তা দ্রুত একটি কাগজে আমি এক দুই তিন নম্বর দিয়ে লিখে ফেলি। যে কথাই টগবগ করে ফুটছে, লিখি। লিখি, যেন আজ আমার মৃত্যু হলেও মানুষ, পৃথিবীর যে ক’জন মানুষই আমাকে লেখক হিসেবে শ্রদ্ধা করেছে, ভালোবেসেছে, তারা জানতে পায়। যেন কিছুই অজানা থেকে না যায়।
এই মৃত্যু কুঠুরি থেকে আমাকে বেরোতে হবে। আমি আগে একে ‘অত্যাচারের কক্ষ বলতাম। ধীরে ধীরে বুঝতে পেরেছি, এ আসলে মৃত্যু কুঠুরি। ডাক্তাররা যেখানে ভেবেছিলেন এবং বলেছিলেন রক্তচাপ স্বাভাবিক করার জন্য হাসপাতালে আরও দীর্ঘদিন থাকা অত্যন্ত জরুরি, আমাকে থাকতে দেওয়া হয়নি, হাসপাতালের কার্ডিয়াক কেয়ার ইউনিট থেকে উঠিয়ে নিয়ে আসা হয়েছে সুস্থ না হওয়া রোগী। আমি কখন হাসপাতাল ত্যাগ করবো, সেই সিদ্ধান্ত ডাক্তার নেন না, প্রভু নেন। ডাক্তার যেদিন বললেন আরও হয়তো এক বাদু’সপ্তাহ থাকতে হতে পারে হাসপাতালে, তার পরদিনই আমাকে হাসপাতাল ত্যাগ করতে হয়েছে। পত্রিকায় আমার হাসপাতালে থাকার খবর ছাপা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতাল থেকে তুলে নিয়ে আসা হয়েছে। মোবাইল ফোন আমার কাছ থেকে নিয়ে নেন প্রভু।
এই অজ্ঞাতবাসে আমার জন্য কোনও ডাক্তার আসতে পারবে না, আমিও এখান। থেকে কোনও ডাক্তারের কাছে যেতে পারবো না। আবার কোনও ডাক্তারের সঙ্গে ফোনেও কথা বলতে পারবো না। অনেকবার চেয়েছি ডাক্তারদের ফোন নম্বর। বড় ছোট কোনও ডাক্তারের ফোন নম্বর আমাকে দেওয়া হয়নি। হাসপাতালে থাকা অবস্থায় ডাক্তারদের ফোন নম্বর যখন চেয়েছিলাম জরুরি হলে ফোন করবো বলে, বলেছেন, আমাকে ফোন নম্বর দেওয়ার ব্যাপারে নিষেধ আছে। যা কিছুই আমি জানতে চাই আমার স্বাস্থ্যের ব্যাপারে, জানাতে হবে সরকারি অফিসারদের, তাঁরা ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করে আমার প্রশ্নোত্তর জানাবেন। ডাক্তার বলেছিলেন, দুশ্চিন্তা হচ্ছে আমার রক্তচাপ বাড়ার মূল কারণ। আমি যেন দুশ্চিন্তা মুক্ত থাকি। এখানে, এই অবস্থায়, এই বাড়িতে, দুশ্চিন্তামুক্ত থাকার আমার কোনও উপায় নেই।
রক্তচাপ অনিয়ন্ত্রিত থাকার কারণে ধীরে ধীরে হৃদপিণ্ডের দেয়াল শক্ত হয়ে উঠছে, চোখেও অসুখ দেখা দিচ্ছে। এরপর একদিন দুম করে হৃদপিণ্ড, চোখ, কিডনি সব নষ্ট হয়ে যাবে। আমি মরে পড়ে থাকবো নিরাপদ বাড়িটিতে। এই অজ্ঞাতবাসের আগে আমার রক্তচাপ সবসময় নিয়ন্ত্রণে ছিল। আমার শরীরের ভেতরের কোনও কিছুতে কোনও রক্তচাপ জনিত অসুবিধে দেখা দেয়নি। চোখের ডাক্তারের কাছ থেকে ফিরে আমি জানিয়ে দিই, আমার সিদ্ধান্তটি, আমি ভারত ছাড়বো। প্রভুকে অনুরোধ করেছি, ভারত ছাড়ার আগে আমাকে একদিনের জন্য হলেও কলকাতা যেতে হবে, একদিনের জন্য না দিলেও অন্তত কয়েক ঘণ্টা থাকার অনুমতি দিন, আমাকে আমার জরুরি জিনিসপত্র ইত্যাদি নিয়ে আসার জন্য। এবং একা পড়ে থাকা বাড়িটির দায়িত্বও তো কাউকে দিতে হবে। প্রভু রাজি হননি। প্রভুর দোষ নয়, প্রভু বলেছেন তিনি জানিয়েছিলেন ওপরে, ওপরওয়ালারা রাজি নন।
১৭ মার্চ
অত বড় সরকারের সঙ্গে পিরবো কী করে আমি! আমি ক্ষুদ্র তুচ্ছ মানুষ। তারপরও মনে হয়, ঠেকিয়ে তো ছিলাম সাড়ে সাত মাস! যুদ্ধ তো করেছি সাড়ে সাত মাস! শুধু মৃত্যু চাইনি বলে বেরিয়ে যাচ্ছি। বেঁচে থাকলে দেখা হবে। দেখা তো হবেই ভারতবর্ষ। যতই তুমি আমাকে দলে পিষে মারো না কেন! যতই তুমি আমাকে নিশ্চিহ্ন করো না কেন! যতই তুমি আমাকে নিঃশেষ করো না কেন? ভালোবাসি তোমাকে ভারতবর্ষ।
১০. ‘হেথা নয়, হেথা নয়, অন্য কোথা অন্য কোন্ খানে!’
শেষ অবধি ভারত আমাকে ত্যাগ করতেই হল। সিদ্ধান্তটি আমি নিজেই নিই। নিতে হয়। এ ছাড়া, সত্যি বলতে কী, আমার উপায় ছিল না। আমার রক্তচাপ উদ্বাহু নৃত্য করে যাচ্ছে। মুহূর্তে কমছে, মুহূর্তে বাড়ছে। দুশ্চিন্তার ওপরও কিছু আর নির্ভর করছে না। রক্তচাপ কমানোর ওষুধ, আর যার রক্তচাপই কমাক, আমার রক্তচাপ কমাতে পারছে না। কিডনি আর চোখ পরীক্ষা করার পরামর্শ দিয়েছিলেন ডাক্তার। চোখের ডাক্তারের কাছে আমাকে নিয়ে যাওয়া হল। পরীক্ষা করে ডাক্তার বলে দিলেন, রেটিনোপ্যাথি ধরেছে চোখে। তার মানে চোখ আমার নষ্ট হওয়ার পথে।