আমার শুধু সম্বল ভালোবাসা। মানুষের জন্য ভালোবাসা। ভালোবেসে চেয়েছি মানুষ দীপ্ত হোক, দৃপ্ত হোক। মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক তোক শ্রদ্ধার স্নেহের। ঘৃণা উবে যাক। যেভাবে ঘৃণা করে মানুষ আমার শব্দ বাক্য উড়িয়ে দিতে চায়, তেমন চেয়েছি মানুষকে ভালোবেসে বেসে মানুষের ভেতরের ঘৃণাকে উড়িয়ে দিতে। সম্ভবত অবিশ্বাস, ঘৃণা, নিষ্ঠুরতা, নিষ্পেষণ, নিপীড়ন এসব না থাকলে জগৎ চলবে না। জগৎকে চলতে দিতে হবে, নিজের যাত্রাভঙ্গ করেও। আমি তো অতি ক্ষুদ্র তুচ্ছ এক প্রাণী। এমন এক প্রাণীকে জগৎ থেকে নিশ্চিহ্ন করে দিলে জগতের কিছু যাবে আসবে না। সেটা জানি। ভেবেছিলাম বাংলার বুঝি যাবে আসবে। বাংলা বুঝি ঘুরে দাঁড়াবে। যে বাংলাকে এত ভালোবাসি, সেই বাংলাও মুখ ঘুরিয়ে নিল।
ওপার বাংলা থেকে নির্বাসনদন্ড পেয়ে পৃথিবীর পথে পথে অনাথের মতো ঘুরেছি অনেক বছর। যেই না এপার বাংলায় ঠাঁই পেলাম, দীর্ঘ বছরের অপেক্ষার ক্লান্তি ঝেড়ে শান্তিতে স্বস্তিতে আমার জন্ম জন্ম চেনা বাংলায় জীবন শুরু করলাম, যতদিন বেঁচে থাকি বাংলার নদীমাঠক্ষেতে ঘুরে, বাংলার রোদেজলে ভিজে, বাংলার রূপরসগন্ধে লীন হব। যে বাংলায় পৌঁছোবো বলে হাজার বছর ধরে অমসৃণ পথে হেঁটে হেঁটে নিজেকে রক্তাক্ত করেছি, সেই বাংলা মুখ ঘুরিয়ে নিল। এ কথা আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে যে বাংলায় আমার ঠাই নেই। বাংলার মেয়ের, যার বাহিরে অন্তরে কেবলই বাংলা, বাংলা ভাষা বাংলা সংস্কৃতি যার প্রাণ, তার ঠাই নেই বাংলায়।
এই দেশের অতিথি আমি, আমার সংযত হয়ে কথা বলতে হবে। আমি কারও অনুভূতিতে আঘাত দিতে এ দেশে আসিনি। সম্ভবত আমি আঘাত পেতে এসেছি। নিজের দেশে আঘাত পেয়েছি, অন্য যে সব দেশে বাস করেছি, আঘাত পেতে পেতে শেষ সম্বল এই ভারতবর্ষে এসেছি আঘাত পেতেই। তারপরও আপনারা আমার অপরাধ নেবেন না, আমি চারদিকে শুনছি যে, এখানে যে রাজনীতি চলে, সে রাজনীতির নাম নাকি ভোটের রাজনীতি, শুনছি যে এদেশে সেকুলার হওয়া মানে নাকি মুসলিম মৌলবাদীর পক্ষ নেওয়া। আমার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে না এসব। আমি শুনতে চাই না এসব। তারপরও চারদিকে তাই দেখছি, পড়ছি, শুনছি। মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে নাকচোখমুখ বন্ধ করে বসে থাকি। ধীরে ধীরে মৃত্যু যেভাবে আমার দুঃসহ একাকীত্বের নির্বাসনে এসে ঘাপটি মেরে বসে থাকে, তার সঙ্গে বরং প্রাণের কথা বলি। প্রাণের কথা বলার আমার তো নেই কেউ আর।
আমি বাংলাকে হারিয়েছি। যে বাংলাকে আঁকড়ে ধরে আমি বাঁচতে চেয়েছিলাম, যে বাংলার মাটি কামড়ে আমি পড়েছিলাম, সেই বাংলা থেকে আমাকে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া, মায়ের কোল থেকে শিশুকে ছিনিয়ে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়ার মতো। আমি আমার মাকে, যে মা আমাকে জন্ম দিয়েছিল, হারিয়েছি। নিজের মাকে যেদিন হারিয়েছিলাম, সেদিনের কষ্টের চেয়ে আজকের কষ্ট তো কিছু কম নয়। আমার মা খুব চাইতেন যেন একদিন দেশের মেয়ে দেশে ফিরি। দেশে ফিরতে আমি পারিনি। কলকাতায় পাকাঁপাকিভাবে বসবাস শুরু করার পর মাকে মনে মনে বলেছিলাম, ”মা তুমি দুঃখ কোরো না, নিজের দেশেই ফিরেছি, এপার ওপার অত কী বিচার করতে আছে।
মাকে বলা হয়নি আর, মুখ ফুটে আমি বলতে পারিনি, যে, আমার এখন উদ্বাস্তু জীবন। বলতে পারিনি, মা বলে যার মাটিতে মাথা রেখেছিলাম, ঘাড়ধাক্কা দিয়ে সে আমাকে বের করে দিয়েছে। বললে আমার নিরীহ মা-টি বড় কষ্ট পাবেন। তাই মাকেও বলি না, মনে মনেও বলি না। বরং নিজেকেই এখন বোঝাবার চেষ্টা করছি এই বলে যে, অপরাধ নিশ্চয়ই আমি করেছি, অপরাধ না করলে কেন আমার এমন কঠিন নির্বাসনদন্ড হবে! সত্য বলাটাই কি অপরাধ নয় এই অসত্যের যুগে? কিন্তু সত্য তো আরও মানুষ বলছে, তাদের তো এত দুর্ভোগ পোহাতে হয় না? আমাকে হয় কেন এত পোহাতে? আমি মেয়ে বলেই সম্ভবত। মেয়েদের আক্রমণ করার মতো সহজ কাজ আর কী আছে।
আমি জানি মানুষ আমাকে নির্বাসনদন্ড দেয়নি। যদি জনগণের মত নেওয়া হত, জানি অধিকাংশই চাইতেন আমি বাংলায় বাস করি। কিন্তু গণমানুষের মতে কি আর গণতন্ত্র চলে। গণতন্ত্র চালায় শাসকেরা, শাসকের সুবিধে যেভাবে হয়, সেভাবে। আমি সামান্য মানুষ। নিজের মতো করে বাস করি, নিজের বিশ্বাসের কথা নিজের মতো করে লিখি। কারও অনিষ্ট করি না। কাউকে ঠকাই না। মিথ্যে বলি না। কোনও অসততা আজ অবদি করিনি। আমার মতো সাধারণ লেখক, যে রাজনীতির সাতেপাঁচে নেই, রাজনীতি যে বোঝে না, তার ওপর যে রাজনৈতিক অত্যাচার হল, তাকে যেভাবে খুঁটি করা হল রাজনীতির, তাতে সত্যিই কোনও দলের কোনও ভোটের লাভ হবে কিনা জানি না, তবে আমার ক্ষতি হল ভীষণ। মৌলবাদী শক্তি, যে শক্তির বিরুদ্ধে আমি অনেককাল লড়ছি, তাকে অনেক বেশি শক্তিমান করা হল।
এই আমার প্রিয় ভারত, যে ভারতে বসে আমি মানবতন্ত্র, মানবাধিকার আর নারীর অধিকারের কথা বলছি, সেই ভারতে আমি যখন আমার বিশ্বাস এবং আদর্শের কারণে আক্রান্ত হই, তখন কোনও রাজনৈতিক শক্তি আমার পক্ষে একটি শব্দ উচ্চারণ করে না, কোনও অরাজনৈতিক দল, কোনও নারীবাদী সংস্থা, কোনও বড় মানবাধিকার সংগঠন আমার পাশে দাঁড়ায় না, আমার ওপর আক্রমণের নিন্দা করে না। এই ভারতবর্ষকে আমি চিনি না। তবে এ ঠিক, মানুষ এককভাবে বিচ্ছিন্নভাবে প্রতিবাদ করছেন, লেখক সাংবাদিক বুদ্ধিজীবীরা লিখছেন, আমার লেখা পড়ে বা না পড়ে, কী লিখি না লিখি না জেনেই মত প্রকাশের পক্ষেই মত প্রকাশ করছেন। কিন্তু যখনই মানুষ সংগঠিত, তখনই মুখে কুলুপ। ভারতবর্ষের নতুন এই চেহারা দেখে আমি আতঙ্কিত। এটা কি আসলে নতুন চেহারা, নাকি এই চেহারাটাই ভারতবর্ষের আসল। আমি সেই বালিকাবয়স থেকে ভারতবর্ষকে মহান বলেই ভেবেছি। আমার সেই স্বপ্নের ভারতবর্ষ, দৃঢ়, দীপ্ত এবং দৃপ্ত, স্বপ্নের সেই ভারতবর্ষকে কোনও একদিন দেখবো এবং গৌরব করবো বলেই হয়তো আরও বেশি করে বেঁচে থাকতে চাই। আততায়ীকে বলতে চাই অপেক্ষা করতে। সেদিন আমি নিজেই আমার আততায়ীকে আমন্ত্রণ জানাবো, মরতে কোনও দ্বিধা হবে না, যেদিন দেখবো অন্যায়ের এবং অন্ধত্বের বিরুদ্ধে রুখে উঠতে জানে ভারতবর্ষ। আমি আর ক’দিন বেঁচে থাকবো, ভারতবর্ষকে তো বেঁচে থাকতে হবে হাজার বছর।