সরকারের হেফাজতে কেমন থাকা যায়, তা হেফাজতে যতদিন না থাকার অভিজ্ঞতা হয়, ততদিন বোঝা যাবে না, বোঝানোও যাবে না। সরকার যখন তোমাকে হেফাজতে রাখে দেশের সীমান্ত পার করার জন্য, তখন সেই হেফাজতটি খুব ভয়ংকর হয়। প্রতি মুহূর্তে বুলডোজার চলতে থাকে মনের ওপর। মনকে ভেঙে গুঁড়ো করে দেওয়ার সব আয়োজন রাষ্ট্রযন্ত্রের হাতের মুঠোয়।
এখন আমি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি, আমাকে তাড়ানোর জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে অনেকে। আমাকে ভীষণ আতংকের মধ্যে রাখার ভীষণই চেষ্টা চলছে। রেসিডেন্স পারমিট এর মেয়াদ বাড়ানোর আগেই যেন দেশ ছাড়ি, তার জন্য চাপ দেওয়া হচ্ছিল। ফরাসি প্রেসিডেন্ট সারকোজি এলেন এ দেশে, আসার আগে সারকোজির দল থেকে সিমোন দ্য বোভোয়া পুরস্কারটি আমার হাতে দেওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করেছেন। যেই না ইচ্ছে প্রকাশ, অমনি জানিয়ে দেওয়া হল, অসম্ভব, ওকে ভারতের মাটিতে তো পুরস্কার দিতে পারবে না। যে দেশের মানুষ পুরস্কার পাচ্ছে, এবং যারা দিচ্ছে পুরস্কার, তাদের দেশে পুরস্কার অনুষ্ঠান করো। হয় বাংলাদেশে যাও, নয়তো ফ্রান্সে যাও। ফরাসি সরকার মাথা পেতে মেনে নিলেন ভারতের প্রস্তাব। আমাকে ফ্রান্সে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানালেন। আমন্ত্রণ জানানোর আগে একবার ফরাসি দেশের মতো বিরাট দেশের সরকার এইটুকু বুঝতে পারলেন না যে, নিরাপত্তার যে কারণটা দেখানো হচ্ছে, তা মিথ্যে। হয়তো বুঝতে পেরেছেন, কিন্তু আমার পক্ষে লড়ার চেয়ে জরুরি ভারতের মতো বিরাট দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক রক্ষা করা। আমার বিবৃতি দিতে হল, যে, পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠান প্যারিসে হয়ে গেছে অনেক আগেই, ৯ জানুয়ারি, প্যারিসে। আমার ফরাসি প্রকাশক সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে আমার পুরস্কার গ্রহণ করেছেন। আমার বক্তৃতাও পড়ে দিয়েছেন। পুরস্কারের মানপত্রটি আমার প্রকাশকের কাছ থেকে আনার জন্য আমার ভারত থেকে প্যারিসে যাওয়ার কোনও প্রয়োজন নেই। আমার প্রকাশক দিব্যি কুরিয়ার করে দিতে পারেন সেটি আমার কলকাতার ঠিকানায়। আমাকে তাড়ানোর জন্য সত্যিই মরিয়া হয়ে উঠেছে সরকার।
১৪ মার্চ
কোথায় আছি? এই প্রশ্নের উত্তর, আমার বিশ্বাস, কেউ বিশ্বাস করবে না যে, আমি জানি না। না বিশ্বাস করলেও এটা ঠিক যে, আমি জানি না। আমি কেমন আছি-র উত্তরও আমার কাছে ওই একই, জানি না। মাঝে মাঝে টের পাই না নিজের অস্তিত্ব। বেঁচে আছি নাকি মরে আছি, বুঝি না। আমার ভেতরের আমিটিকে এখন আমি আর স্পর্শ করতে পারি না। একটা অনুভূতিহীন জড়বস্তুর মতো, একটা প্রায় মৃত মানুষের মতো পড়ে থাকি। সারাদিন একটা ঘরে। সারারাত একটা ঘরে। মৃত্যু এসে প্রায়ই খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে। কাঁধে হাত রাখে। হ্যাঁ এইরকম ভাবে আজকাল আমি বেঁচে আছি। এর শুরু হঠাৎ সেদিন, কলকাতা থেকে আমাকে উৎখাতের পর নয়, দীর্ঘদিন ধরে, একটু একটু করে আমাকে পান করানো হচ্ছে বিষ, ভেতরে আলগোছে জলজ্যান্ত মৃত্যুকে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আমার ভেতরের আমিটিকে, সাহসী, প্রত্যয়ী, আপোসহীন, দুরন্ত, দুর্বিনীত আমিটিকে মেরে ফেলার ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। আমি টের পাচ্ছি, কিন্তু সমস্ত শক্তি দিয়েও আমি ক্ষমতার বিরুদ্ধে যুদ্ধে যেতে পারি না। আমি নিজে লোকবলহীন একটি কণ্ঠস্বর শুধু। আমার পাশে যারাদাঁড়ায়, অন্ধকার ঘনিয়ে এলে তাদের মুখ আর দেখা যায় না।
নিজেকে জিজ্ঞেস করছি, কী অপরাধ আমি করেছি? কেন আজ আমি এখানে, যেখানে আমি। এটা কি কোনও জীবন হল? আমি চৌকাঠ ডিঙোতে পারবো না, এবং কেউই আমার নাগাল পাবে না! কী অপরাধ আমি করেছি যে আমাকে লোকচক্ষুর আড়ালে জীবন কাটাতে হচ্ছে, থাকতে হচ্ছে অন্তরীণ! কী অপরাধের শাস্তি আমাকে দিচ্ছে এই সমাজ, এই দেশ, এই জগৎ! নিজের মনের কথা লিখেছিলাম, নিজের বিশ্বাসের কথা লিখেছিলাম কাগজে। কাগজেই লিখেছিলাম, কারও গায়ে পাথর ছুঁড়ে কিছু বলিনি, কারও মুন্ডু কেটেও কিছু কোনওদিন লিখিনি। কিন্তু তারপরও আমি অপরাধী। আমার নিজের মত অনেকের মতের চেয়ে ভিন্ন ছিল বলে আমাকে শাস্তি পেতে হচ্ছে। একটা যুগ ছিল, রাজার অবাধ্য হলে শূলে চড়ানো হত। দেশসুদ্ধ লোক দেখতো, শূলে চড়া মানুষটির কষ্ট। আমাকেও তো অনেকটা নতুন যুগের শূলে চড়ানো হল। দেশসুদ্ধ লোক কি দেখছে না আমার যন্ত্রণা? যেখছে না কী ভয়াবহ যন্ত্রণা হলে, নিজের ভেতরে নিজের মৃত্যু কতটা হলে, আশাভঙ্গ আর হতাশা কতটা চরম হলে, কতটা ভয়ংকর হলে নিজের বিশ্বাসের কথা মানুষ ফিরিয়ে নেয়, নিতে পারে! কতটা অপমানিত হলে, কতটা ব্রাত্য হলে, কতটা পিষ্ট হলে, কতটা রক্তাক্ত হলে আমি বলতে পেরেছি, আমার ওই বাক্যগুলো তোমরা বাদ দিয়ে দাও, বাদ দিয়ে যদি তোমাদের আরাম হয় হোক, বাদ না দিলে তোমরা কেউই আমাকে বাঁচতে দেবে না জানি, তোমাদের রাজনীতি, তোমাদের ধর্ম, তোমাদের হিংস্রতা, তোমাদের বীভৎসতা নারকীয় উল্লাসে আমার রক্ত পান করবে, করতেই থাকবে যতক্ষণ না শেষ বিন্দু রক্ত আমার শেষ হয়। উড়িয়ে দাও ওই নিষিদ্ধ শব্দগুলো, উড়িয়ে দাও থোকা থোকা সত্য। শব্দ তো নিতান্তই নিরীহ। সত্য তো নিরস্ত্র। মসি চিরকালই হেরে গেছে অসির কাছে। চারদিকে অসির আস্ফালন। আমার মতো সামান্য মানুষ তাবড় তাবড় শক্তির বিরুদ্ধে কী করে পেরে উঠবো! আমি তো অসত্য জানি না।