আমি একা হয়ে যাচ্ছি। বাইরে যে আন্দোলন প্রতিবাদ হচ্ছিল, সব স্তিমিত হয়ে গেছে। যে যার জীবন নিয়ে ব্যস্ত। এই এত বড় পৃথিবী, আমি এই পৃথিবীর সন্তান। একটু পছন্দের জায়গায় যে কটা বছর বেঁচে থাকবো নিজের মতো করে, মানুষের সেবা করে, মানুষের উপকার করে, সে অধিকার নেই আমার।
ওদিক থেকে পশ্চিম থেকে আমাকে ডাকা হচ্ছে। আমি যাচ্ছি না। ওসব দেশে বাস করার কথা ভাবলে আমার গায়ে জ্বর চলে আসে। ওদিকে গণতন্ত্র, ওদিকে বাক স্বাধীনতা, ওদিকে মুক্তবুদ্ধি, মানবাধিকার, ওদিকে সুস্থতা, সমতা, ওদিকে নিশ্চিতি, নিরাপত্তা, ওদিকে যুক্তিবাদ, ওদিকে জীবন। এদিকে দারিদ্র, এদিকে দূষণ, দুঃশাসন, এদিকে সন্ত্রাস, নিরাপত্তাহীনতা, পরাধীনতা, এদিকে নির্যাতন, এদিকে ধর্মান্ধতা, জড়বুদ্ধি। এদিকে বৈষম্য, এদিকে আতংক, অনিশ্চয়তা, মৃত্যু।
আমি কোনদিকে যাবো? জগৎ বলছে ওদিকে যাও, বাঁচো। ওদিকে সহমর্মিতা, স্বর্ণপদক, এদিকে অবজ্ঞা, এদিকে অপমান।
আমি এদিকটাকেই বেছে নিয়েছিলাম। কিন্তু এদিকের রাজনীতির কাছে আমার স্বপ্ন পরাজিত হল।
১৩ মার্চ
অনেকদিন হল। সাত মাস। চার মাস গৃহবন্দি ছিলাম কলকাতায়। তিন মাস এই দিল্লিতে। যখন কলকাতা থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল, নভেম্বরের ২২ তারিখে, গিয়ে পড়লাম জয়পুরে, আর জয়পুর থেকে তাড়ানো হল ২৩ নভেম্বরে। যে অচ্ছুৎকে কোনও রাজ্য আর নিচ্ছে না, তাকে কেন্দ্র নিল। ভেবেছিলাম ভালোবেসে নিয়েছে বুঝি। ভ যখন ফোনে বলেছিলেন কাপড়চোপড় কিনে দেবে, বই টই নিয়ে নিন, কী রকম যেন পিতার কণ্ঠস্বর বলে মনে হয়েছিল। কিন্তু কাপড়চোপড়, বইপত্রেরই বা দরকার কেন, বুঝে পাইনি। সোজা কলকাতায় পাঠিয়ে দেবেন, তা নয়তো, ঝামেলা করছেন কেন। ঝামেলা কেন করেছিলেন, তখন না বুঝলেও এখন বুঝি। রাজনীতিকদের রাজনীতি বুঝতে বুঝতে আমার প্রায় তিনমাস সময় নিল। সম্ভবত তুলনায় কমই সময় নিয়েছে আমার অপরিপক মস্তিষ্ক। অবশ্য আমার মস্তিষ্ক যে সব কিছু ধরতে পেরেছে তা নয়, অন্যের মস্তিষ্ক যেসব রাজনীতি বোঝে ভালো, তারা আমার ঢের আগে ধরেছে। তারা সোজা বলেছে, তোমাকে এভাবে রাখা হয়েছে, যেন তুমি, অতিষ্ঠ হয়ে একদিন দেশ ছেড়ে চলে যাও।
সুয়েনস এলো সুইডেন থেকে, ওকে আমার সঙ্গে থাকতে দিল না, দেখাও খুব একটা করতে দেয়নি। তারপরও ওর সঙ্গে দেখা করতে দেবার পেছনে হয়তো উদ্দেশ্য ছিল। সুয়েনসন নিশ্চয়ই আমার প্রেমিক, আমার এই হাল দেখে, নিশ্চয়ই বলবে এ দেশ ছাড়তে। উদ্দেশ্য সফল হয়নি, সুয়েনসন আমাকে বরং উল্টো বুঝিয়েছে। দ্বিতীয় যে বন্ধুকে দেখা করতে দিয়েছিল, সে অশেষ সান্যাল। অশেষ কলকাতা থেকে আমার কিছু জিনিস সুটকেসে করে নিয়ে এসেছিল, তাই অশেষকে দেওয়া হয়েছে দেখা করতে। সুটকেসের ঘটনা না থাকলে দেখা করতে দেওয়া হত না। আর্জি জানিয়ে রাখতে হয়েছিল অনেক আগে। সুয়েনসনের বেলায় তো লিখিত চিঠি পাঠাতে হয়েছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। ভ’কে ফোনেও বলেছিলাম যে আমার এক বিদেশি বন্ধু আসছে, আমার কাছে থাকবে কদিন। উনি নাম লিখে নিলেন বন্ধুর। কিন্তু ওকে আমার কাছে আসার অনুমতি দেওয়া হয়নি। এই দু’জন ছাড়া আর যাদের সঙ্গে দেখা করানো হয়েছে, তা তাদের লোক। এম এ বেবি। সিপিএমের লোক। তপন রায় চৌধুরী। ভ’ বাবু পাঠিয়েছেন। আমাকে দেশ ছাড়ার জন্য বোঝাতে। দু দুবার এসেছেন তপন রায় চৌধুরী। প্রথমবার যখন এলেন, তখন মনে হয়েছিল বুঝি ভালোবেসে এসেছেন। তিনি যে ভ’বাবুর পাঠানো দূত, তা দ্বিতীয়বার আসার পর বুঝেছি। খুব আহত হয়েছি। এত ভালোবাসি, শ্রদ্ধা করি, আর তিনি কিনা আমাকে বলতে এসেছেন, যেন দেশ ছাড়ি। বাক স্বাধীনতা নিয়ে, নির্যাতিত লেখকের অধিকার নিয়ে নিজে লেখক হয়েও, বুদ্ধিজীবী হয়েও ভাবলেন না কিছু! কিছু কিছু জিনিস যে কী অসম্ভব। বিশ্বাস হতে চায় না। ওদিকে এনামুল কবীর নামের এক দীর্ঘদিনের বন্ধুও দেখি ব্যবহার অন্যরকম করছেন। পুরো পাল্টে গেছেন। তাঁকে বুদ্ধবাবু বলেছেন আমাকে বোঝাতে, যেন চলে যাই এ দেশ ছেড়ে। যে ক’জন ছিলেন সঙ্গে, যাঁদের থাকার কথা ছিল পাশে, তাঁরাও ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছেন।
এই তিন মাস ধরে এক অজ্ঞাতবাসে আমাকে রাখা হয়েছে। আমার ইচ্ছে অনুযায়ী আমাকে এক পা কোথাও বেরোতে দেওয়া হয় না। আমাকে কারও সঙ্গে দেখা করতে দেওয়া হয় না। কী কারণ এর? একটিই কারণ, আমাকে শাস্তি দেওয়া। আমাকে কষ্ট দেওয়া। আমাকে বোঝানো যে তোমাকে আমরা চাইনা। মানুষ কী করে বাঁচবে সমাজ ছাড়া। কী করে বাঁচবে বন্ধু ছাড়া। কী করে স্বাধীনতাহীনতায়, কতদিন! একদিন না একদিন আমি তো অতিষ্ঠ হবই। একদিন তো আমি বলবোই আমি আর পারছি না। আমাকে তালাবন্ধ করে রাখতে কারও তো কোনও অসুবিধে হচ্ছে না, হবেও না। হবে আমার। আমি তো মানুষ। কোনও অপরাধ না করে কতদিন এই কঠোর কঠিন শাস্তি মাথা পেতে নেব আমি! আমাকে এভাবে বছরের পর বছর রেখে দিতে সরকারের কোনও অসুবিধে নেই। বাইরে দু’একটা লোক প্রতিবাদ করবে। কিন্তু কতদিনই বা প্রতিবাদ করবে! লেখালেখি এর মধ্যেই অনেক কমে গেছে। টেলিভিশনের শিরোনাম থেকে খসে গেছে বিষয়টি। এখন আলোচনা অন্য কিছু নিয়ে হচ্ছে। তসলিমা কোথায় আছে কেউ জানে না। কোথাও হয়তো আছে। সরকারের হেফাজতে খুব কি আর খারাপ থাকবে?