তিক্ত বিরক্ত স্বরে বললেন, তোমার চলে যাওয়া উচিত। কেন তুমি এ দেশ ছাড়ছে? ইওরোপ বা আমেরিকায় বসে নিশ্চন্তে নিজের লেখালেখি করো। আর তা ছাড়া..
–তা ছাড়া কী?
–এদেশে তোমার থ্রেট আছে।
–কী করে জানেন যে থ্রেট আছে?
–রাজ্যপাল বলেছেন যে থ্রেট আছে। আমি বলেছি, থ্রেট তো আছেই। থ্রেট নিয়েই তো পনেরো কুড়ি বছর বেঁচে আছি। থ্রেট পৃথিবীর কোথায় নেই? মুসলিম মৌলবাদীরা পৃথিবীর কোন জায়গায় নেই বলুন তো! কাজ হাসিল করতে ওরা কোথায় বা না যেতে পারে?
আমি কোথায় যাবো, কোন দেশে আমাকে যেতে বলা হচ্ছে। যে কোনো দেশে। এ দেশ থেকে বেরোই, সেটাই আসল কথা। এর পর আমি মরি বা বাঁচি তাতে কারওর কিছু যায় আসে না। না, কারওর না।
তপন রায় চৌধুরী বললেন, সিপিএম ক্যাডাররা পছন্দ না হলে গায়েব করে দেয় লোকদের।
–মানে?
–মানে মেরে ফেলে। ইঙ্গিত দিলেন, শুধু মৌলবাদী নয়, ক্যাডাররাও আমাকে মেরে ফেলতে পারে।
কয়েক ঘণ্টা কথোপকথনের পরও যখন তিনি দেখলেন, আমি আমার সিদ্ধান্তে অটল, আমি দেশ ছাড়বো না, কারণ দেশ ছাড়ার পক্ষে যত যুক্তিই তিনি দেখাচ্ছেন, আমি মানছি না, তখন তিনি ক্রুদ্ধ স্বরেই কথা বললেন আমার সঙ্গে। তাঁকে আর চেনা যায় না তখন। মনে হয় না আমার তিনি দীর্ঘকালের চেনা। আমাকে স্নেহ করেন তিনি। ভালোবাসেন তিনি।
মানুষ দেখলে আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে কতটুকু তার মুখ আর কতটা মুখোশ!
বিকেলে গাড়ি দাঁড়িয়েছিল তার জন্য। সোজা তিনি বিমান বন্দরে যাবেন কিন্তু আগে কেন বললেন, যে ভ’বাবুর সঙ্গে দেখা করে তারপর যাবেন বিমান বন্দরে! তা তো নিশ্চয়ই তিনি করছেন না। কেন বললেন, দুদিন আগে এসেছেন দিল্লিতে। তার সঙ্গে তো
কোনো লাগেজ ব্যাগেজ নেই। ভুল করে বলেও ফেলেছিলেন যে আজ প্লেনে বসে পত্রিকা পড়েছেন তিনি, কলকাতার পত্রিকা। কলকাতা থেকেই তাহলে সেদিন সকালেই তিনি রওনা হয়েছেন। দেশের একজন বিশাল ব্যক্তি আরেক বিশাল ব্যক্তির কাছ থেকে রাজনৈতিক ক্রান্তিকালে সাহায্য চেয়েছেন। একটা আদেশ নির্দেশ না মানা মেয়েকে আদেশ মানতে বাধ্য করতে।
আমার চারপাশের মানুষগুলোকে আমি চিনতে পারি না।
১১ মার্চ
এই সনাতন সেনগুপ্তই একদিন মদনজিৎ সিংকে লেখা আমার একটি চিঠির কপি আমাকে দেখিয়ে কী ভীষণ দুর্ব্যবহারই না করেছিলেন। বলেছিলেন, এইসব কী ছড়াচ্ছেন আপনি সারা পৃথিবীতে? যে সরকার আপনাকে নিরাপত্তা দিচ্ছে, সেই সরকারের বিরুদ্ধে বলে বেড়াচ্ছেন? আপনি জানেন কী অন্যায় আপনি করছেন, কী শাস্তি আপনার হতে পারে? এইসব বন্ধ করুন। আমি বলেছিলাম, সরকারের বিরুদ্ধে আমি কোনও কথা লিখিনি। আমি শুধু আমার অবস্থার কথা লিখেছি। সনাতন সেনগুপ্ত চেঁচিয়েই যাচ্ছিলেন। একটা সময় তাকে মনে হচ্ছিল মেশিন বুঝি। ঘাড়ের কাছে কোথাও সুইচ আছে অন/অফ করার। কেউ সুইচটাকে অন করে দিয়েছে। একই বাক্য, শব্দ বারবার আওড়াচ্ছিলেন।
মন্ত্রণালয়ে আমি লিখিত অনুরোধ করেছিলাম, বিশেষ করে ফেব্রুয়ারিতে রেসিডেন্স পারমিটের মেয়াদ বাড়ানোর পর, যে, আমাকে কিছুটা অন্তত স্বাধীনতা দেওয়া হোক, এই দিল্লিতেই নিজের মতো করে থাকার অধিকার, যতদিন কলকাতায় ফিরে যেতে না পারছি। দেহরক্ষী যদি থাকে থাকবে, কলকাতায় যেমন ছিল। আমি কোথায় যাবো না যাবো, কার সঙ্গে দেখা করবো না করবো, আমার সিদ্ধান্ত। এর উত্তর সনাতন সেনগুপ্ত আমাকে জানিয়েছিলেন, গম্ভীর গলায় একদিন স্ট্যাটাস কুও।
–মানে?
–মানে যেমন আছেন, তেমন থাকতে হবে।
–কোনও পরিবর্তন নেই?
–না।
–কতদিন এভাবে?
–অনির্দিষ্টকালের জন্য।
একটা জিনিস আমার মনে হয়, সচিবরা মন্ত্রীদের আদেশ পালন করেন বটে, তবে মন্ত্রীদের সব কাজকেই তারা পছন্দ করেন না। করলে সনাতন সেনগুপ্ত বলতেন না, যে, যা-ই হোক, যা কিছুই ঘটুক, যা কিছুই বলি আপনাকে, সচিব সনাতন সেনগুপ্ত হয়ে নয়, আজ মানুষ সনাতন সেনগুপ্ত আপনাকে বলছি, আপনাকে আমি শ্রদ্ধা করি। আপনাকে নিয়ে গর্ব হয় আমার। আপনার সততা আর সাহসের সামনে, আপনার ব্যক্তিত্বের সামনে ক’জন দাঁড়াতে পারবে? আপনি আমার স্যালুট নিন।
১২ মার্চ
নানাভাবে কায়দা করে এটা অন্তত বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে যে, এ দেশে থাকতে হলে এভাবেই বন্দি জীবন আমাকে যাপন করতে হবে। এরকমই বন্দি, আমি কোথাও বেরোতে পারবো না, কেউ আমার সঙ্গে দেখা করতে পারবে না। আমার কোনো সামাজিক জীবন থাকবে না। আমাকে একটা ঘরে পুরোপুরি বন্দি থাকতে হবে। যদি ডাক্তার দেখানোর খুব প্রয়োজন পড়ে, সেটার ব্যবস্থা সরকার করবে। এবং এই জীবন পছন্দ না হলে, বলে দিয়েছেন, নিজের নিরাপত্তার ব্যবস্থা নিজেকেই করে নিতে হবে।
আমাকে নাকি যে জায়গাটায় আমি আছি, তার থেকে সরানো হবে। সরিয়ে কোথায় নিয়ে যাওয়া হবে, তা বলা হয়নি। কোনো গুহায়। বা কোনো নির্জন পাহাড়ে। আমার ফোন নেট কেড়ে নেওয়া হবে কি? হতে পারে। আমি এখন সরকারের হেফাজতে অথবা হাতের মুঠোয়। আমাকে নিয়ে তারা যা খুশি করতে পারেন। কিন্তু কতদিন এইভাবে আমি বাঁচতে পারবো। মানুষ কি এইভাবে পারে! কেউ পারে! রাজনীতিকরা হয়তো পারেন। আমি রাজনীতির সাতেপাঁচে নেই, দেশের ক্ষমতা নিয়ে আমি দুশ্চিন্তা করছি না কোনও। স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন করেছি জীবন ভর, আজ আমার জীবনটিকে নিয়ন্ত্রণ করার কোনও স্বাধীনতা আমার নেই। আজ দীর্ঘ সাতমাস যাবৎ সরকার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। বুঝি, টের পাই, অনুভব করি, যে, দেশটিতে বাস করা শেষ অবদি আমার আর সম্ভব হবে না। কেন আমি অপেক্ষা করছি কোনোদিন ক্ষমতাবানদের শুভবুদ্ধির উদয় হবে বলে? শুভবুদ্ধির উদয় হওয়ার সম্ভাবনা থাকলে আঁচ করা যায়। কিছুই তো আঁচ করতে পারি না। আমাকে এভাবে একটা ঘরের মধ্যে ফেলে রাখতে, এভাবে শেকলে বেঁধে রাখতে কারও তো কোনো অসুবিধে নেই। অসুবিধে আমার। আমার অসুবিধে যেন হয়, তা অনেকে মনে প্রাণে চাইছে। বাইরের মানুষ নানারকম ভেবে নিচ্ছে। ভেবে নিচ্ছে যে হয়তো নিরাপত্তার জন্য এভাবেই ঘরবন্দি করতে হয়। কজন মানুষের মনে প্রশ্নের উদয় হয়, কার সময় আছে প্রশ্ন। করার? যদি সময় থাকেই, ক’জনের সাহস আছে চ্যালেঞ্জ করার।