এত ধর্ম বিশ্বাস, এত ধর্ম পালন, এত উপোষ, এত সংস্কার, এত লাল সুতো আমি আর কোনো দেশে দেখিনি। বাংলাদেশেও দেখিনি। ভারতকে যখন পশ্চিমের দেশ বলে ধর্মের দেশ, আমি আপত্তি করতাম, সেইসব পুরোনো নাস্তিকদের কথা, লোকায়ত দর্শনের কথা আওড়াতাম। কোথায় সেসব, চিহ্নমাত্র নেই। নাস্তিকের সংখ্যা সত্যি বলতে কী, হাতে গোনা। কুসংস্কারে, জ্যোতিষীতে, ধর্মান্ধতায় ঠাসা এ দেশ। সেনানিবাসে একটি মন্দির আছে, সারাদিন সারারাত মন্দিরটিতে গান বাজে। যত মানুষ বাস করে এই সেনানিবাসে, সেনা বা অ-সেনা এক আমি ছাড়া, সবাই আস্তিক। গা ছমছম করে ভাবলে।
সেনানিবাসের গেটের কাছে ছোট একটা ঘর আছে, ওই ঘরের বাইরে বড় করে লেখা আছে –‘এক বার খেলে তুমি যোগী, দুইবার খেলে তুমি ভোগী, তিনবার খেলে তুমি লোভী, আর চারবার খেলে তোমার এক পা অলরেডি কবরে। কী ভুল এসব তথ্য। আমি হাঁহয়ে থাকি। এই ভগবানের দেশকে শোধরানোর কোনো উপায় আমার নেই।
আমার তাদের সঙ্গে কথা বলতে হয়, সেই নারী পুরুষের সঙ্গে যারা ভয়ংকর পুরুষতান্ত্রিক, ধর্ম আর কুসংস্কারে ঠাসা। মানুষগুলোর সঙ্গে প্রতিদিন আমাকে বাক্য বিনিময় করতে হয়। এরাই আমার সঙ্গী। আমার পছন্দের সঙ্গী নির্বাচন করার কোনো অধিকার আমার নেই।
৩ মার্চ
বন্ধু অনেক হারিয়েছি এর মধ্যে। কেউ কেউ আমার সঙ্গে বন্ধুত্ব রাখাকে রাজনৈতিক ভাবে ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করেছে। আবার বন্ধু দু’একজন জুটেছে, নতুন বন্ধু। কিন্তু কদিন কোন বন্ধুত্ব টেকে তা কে বলবে! কেয়া নামের এক মেয়ে পাটনা থেকে প্রতি রাতে ফোন করে, দীর্ঘক্ষণ কথা বলে। পাগলের মতো আমার বই পড়ে, ভালোবাসে। সুমিত চক্রবর্তী খবর নেন নিয়মিত। কেমন আছি জানতে ফোন করেন আরও-কিছু-নাম-ভুলে-গেছি-স্ত্রী-পুরুষ। দীপ্তেশ নামের এক সাংবাদিক, সেও খবর নেয়। ওকেই দিতে বলেছিলাম বাঙালি কোনও কার্ডিওলোজিস্টের নাম দিয়েও ছিল। সেই ডাঃ তরুণ বাগচির সঙ্গে কথাও হয়েছিলো ক’দিন। হঠাৎ একদিন তিনি আমার সঙ্গে ফোনে কথা বলা বন্ধ করে দিলেন, কোনওদিন আর ফোন ওঠাননি। প্রভুকে বলেছিলাম, ডাক্তার তরুণ বাগচির সঙ্গে দেখা করতে চাই। নাকচ হয়ে যায় আমার প্রস্তাব। প্রভু বলেছেন, ওই সরকারি ডাক্তারের সঙ্গেই শলা পরামর্শ করতে হবে। অন্য কোনও ডাক্তার চলবে না। দীপ্তেশকেও ফোনে পাওয়া যায় না। হঠাৎ করে। একদিন ধরে জিজ্ঞেস করলাম, ব্যাপারটা কী, এড়িয়ে চলছে নাকি। দীপ্তেশ চুপ থেকে কিছুক্ষণ, বললো, আর বলবেন না, ভয়ংকর অবস্থা চলছে, আমাকে খুঁজতে তো পুলিশ এসেছিলো অফিসে, আমি কে, কী করি, নাড়ি নক্ষত্র।
–কেন?
–ডাক্তারের নাম আপনাকে দিয়েছি বলে।
–ডাক্তার বাগচি?
–হ্যাঁ।
–ডাক্তার তো ফোন ধরছেন না। কয়েকদিন ধরে করেই যাচ্ছি।
–উনি আর কথা বলবেন না। ভীষণ ভয় পেয়েছেন। ওর চেম্বারেও পুলিশ গিয়ে থ্রেট করে এসেছে।
–ডাক্তারবাবু আর কথা বলবেন না? আশ্চর্য। এসব কি সত্যি বলছো তুমি? আমার বিশ্বাস হচ্ছে না পুলিশ গিয়ে কোনো ইনোসেন্ট ডাক্তারকে থ্রেট করবে ফোনে আমার সঙ্গে কথা বলেছে বলে! আনবিলিভবল।
–আমি আমার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট সব পাল্টে ফেলেছি।
–কেন?
–সরকারি নজর আমার ওপর। ভয়ংকর অবস্থা।
–এত ভয় পেও না দীপ্তেশ।
এইমসএর যে ডাক্তার আমাকে দেখেছেন, ডাক্তার বেহাল, একদিন দীপ্তেশ বললো, তার নিজের ডাক্তার। ডাক্তার বেহালের মোবাইল নম্বর চেয়েছিলাম দীপ্তেশের কাছে। সরাসরি কথা বলতে। রক্তচাপএর অদ্ভুত ওঠানামা নিয়ে একটু আলোচনা করতে। যেহেতু তিনি হাসপাতালে রেখে আমার রক্তচাপ স্থির করে দেননি, তাই তাঁর সঙ্গে জরুরি অবস্থায় কথা বলা জরুরি। ডাক্তার বেহালের নম্বর অনেক চেয়েও প্রভুর কাছ থেকে পাইনি। প্রভু আমার কাছে প্রশ্ন শুনে ডাক্তার বেহালকে জানাতেন, তার থেকে উত্তর প্রভু আমাকে জানাতেন ডাক্তার বেহাল কী বলেছেন। ডাক্তার বেহালের ডিপার্টমেন্টে ঘোট ঘোট যে ডাক্তার আছেন, তাদের সঙ্গেও সরাসরি কথা বলতে আমাকে প্রভু দেননি। কোনও প্রশ্ন থাকলে যেন অফিসারদের বলি, অফিসাররা ওই ডাক্তারদের কাছ থেকে জেনে আমাকে বলবে। আমি যদি নিজে ডাক্তার না হতাম, এই ব্যবস্থাটা আমাকে পীড়া দিত না। দিয়েছে কারণ একজন ডাক্তারের সঙ্গে সরাসরি ডাক্তারি ভাষায় কথা না বলে বলতে হচ্ছে একজন অ-ডাক্তারের মাধ্যমে। দীপ্তেশ ডাক্তার বেহালের নম্বর আমাকে দিতে পারেনি, কারণ ডাক্তার বেহাল বলেছেন না দিতে। বলেছেন, চাকরিটা তিনি খোয়াতে চান না। আশ্চর্য, আমি তাঁর রোগী, তিনি চান না আমার সঙ্গে কথা বলতে?
দীপ্তেশ অনেকক্ষণ চুপ থেকে বললো, না।
দীপ্তেশের কথাগুলো আজগুবি শোনায়। পুলিশ, ওর অফিস, ডাক্তারের চেম্বার, ফোন নম্বর –সব কিছু দীপ্তেশ কি বানিয়ে বলছে! বানিয়ে কেন বলবে, কী স্বার্থ তার! সে কি আর চাইছে না আমার সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে! একজন সাংবাদিক, যে আমার লেখা খুব পছন্দ করে, যে করেই হোক চাইবে আমার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রাখতে, ভাঙতে চাইবে কেন? তাহলে কি তাকে কেউ বলেছে যেন সব বন্ধ করে দেয়, সব যোগাযোগ! কে বলবে, সরকার। সরকারেরই বা স্বার্থ কী! আমি বুঝে পাই না এসবের কিছু।
১০ মার্চ
কলকাতা থেকে তপন রায় চৌধুরী এলেন। এ নিয়ে দুবার আসা। যখন দেখা করলেন, ভ’র পক্ষে সওয়াল করেননি অত। দ্বিতীয়বার এই কারণেই এসেছেন আমাকে কয়েকঘণ্টা ধরে বোঝাতে, যেন আমি দেশ ছাড়ি। অনেকক্ষণ কেবল ভ’রই প্রশংসা করলেন। ভ হচ্ছেন মহামানুষ। উনি কেন ছোটখাটো পুরস্কার পাবেন। উনার ভারতরত্ন পাওয়া উচিত।