ত–জানেন উনি এসব।
প্র–কিছু উপদেশ দেননি?
ত–উপদেশ দেবেন কেন? আমি কি ছোট বাচ্চা নাকি? আমি কি নিজে বুঝি না কী করতে হবে?
প্র–তারপরও অভিজ্ঞ মানুষের উপদেশ খুব মূল্যবান।
ত–উনি মনে করেননি আমার কোনও উপদেশের প্রয়োজন আছে।
অনেকক্ষণ চুপ করে ছিলেন প্রভু। নিরাপদ বাড়ির কাছাকাছি এসে প্রশ্ন করলেন, অ্যামবাসাডার আপনাকে সুইডেন যাওয়ার কথা কিছু বলেননি?
ত–কোথায় যাওয়ার কথা?
প্র–সুইডেনে।
ত–না তো!
প্র–কিছুই বলেননি? বলেননি যে এখানে কোনও স্বাধীনতা ছাড়া কী করে বাঁচবেন আপনি, লেখালেখির ক্ষতি হচ্ছে। আপনার টেনশন হচ্ছে। শরীর খারাপ হচ্ছে। মনের ওপর চাপ পড়ছে ভীষণ। তারচেয়ে সুইডেনে চলে যান?
ত–নাহ, এরকম কিছু বলেননি।
প্র–কিছুই না?
ত–না।
প্র–কেন বলেননি?
ত-বলেননি কারণ উনি জানেন, আমি ইচ্ছে করলেই সুইডেনে যেতে পারি, কিন্তু ও দেশে আমি যেতে চাই না। আমি ভারতে থাকতে চাই।
.
২৩ ফেব্রুয়ারি
আমি, যেখানে ইচ্ছে, আজ প্রভু আমাকে জানিয়ে দিলেন, যেতে পারি, তবে নিজের নিরাপত্তার ব্যবস্থা নিজেকেই করে নিতে হবে। তুমুল রক্তচাপ বেড়ে গেল। আমি অসুস্থ হয়ে পড়ছি। আমি মরে যাচ্ছি একটু একটু করে। বাঁচার জন্য চেষ্টা করবো, নাকি এভাবেই মরে পড়ে থাকবো।
২৪ ফ্রেব্রুয়ারি
আমার মনে হচ্ছে না, এ দেশে আর আমার পক্ষে থাকা সম্ভব হবে।
২৬ ফেব্রুয়ারি
সকালে খবর পেলাম শিবনারায়ণ রায় মারা গেছেন। আনন্দবাজারে আমার সম্পর্কে লিখতে চেয়েছিলেন ‘নারীর কোনও দেশ নেই’ বইটি সম্পর্কে, আনন্দবাজার কোনও আগ্রহ দেখায়নি। লেখাটা শেষ হয়েছিল কি, না কি অসমাপ্ত রেখেই চলে গেলেন।
অন্নদাশংকর রায় নেই। নিখিল সরকার নেই। শিবনারায়ণ রায় নেই। যারা সবচেয়ে বড় বন্ধু ছিলেন আমার, নেই। আছে কে আমার জন্য, কলকাতায়? অনিল দত্ত একদিন চলে যাবেন। সত্যিকার বন্ধু বলে কেউ থাকবে না আমার। একা।
খুব উঁচু মানুষ শিবনারায়ণ রায়। একটা মানুষ ছিলেন আমার পাশে। আমার যে কোনো দুঃসময়ে তিনি পাশে ছিলেন। পৃথিবীর যে প্রান্তেই ছিলাম, ছিলেন। নির্ভীক লড়াকু মানুষটি। প্রশাসন আমার পাশে নেই, প্রতিষ্ঠান পাশে নেই, পরোয়া করেননি, তিনি ছিলেন। এত উঁচু মানুষ ছিলেন তিনি, তাঁর নাগাল পাওয়া, তাঁর বিদগ্ধ চোখদুটোয় তাকানো সহজ ছিল না কারও। এই সেদিনও আমার এই ঘোর দুঃসহবাসে টুকরো টুকরো হয়ে আমার আর আমার স্বপ্নগুলোর ভেঙে পড়ায় এতটুকু কাতর না হয়ে বলেছিলেন, লেখো, যেখানে যেভাবেই থাকো, যে ভাবে যে পরিস্থিতিতেই লিখে যাও। তোমার জীবন হলো তোমার কলম। শিথিল হয়ে আসা কলম আমি আবার শক্ত মুঠোয় ধরেছি, মানুষটি ছিলেন পাশে, আগুনের মতো ছিলেন। গোটা পৃথিবীও যখন ত্যাগ করে সরে যায়, তখনও জানি, একজনও যদি কেউ সঙ্গে থাকেন, তিনি তিনি। উঁচু মানুষেরা হারিয়ে যাচ্ছেন একা একা। নির্ভীক নিঃস্বার্থের সংখ্যা ক্রমে ক্রমে কমে কমে শূন্য হচ্ছে। এই ভীতু আর স্বার্থান্ধ আর ক্ষুদ্রদের পৃথিবীতে বড় একা হয়ে যাচ্ছি। তাদের চিৎকারে দাপটে বধির হচ্ছি। তাদের রক্তচক্ষু দেখে দেখে বোবা।
উঁচু মানুষটি নেই। শীতার্ত অন্ধকার গ্রাস করে নিচ্ছে আমার নিঃসঙ্গ জগৎ।
২৮ ফেব্রুয়ারি
দৈনিক স্টেটসম্যানে কবিতা ছাপা হচ্ছে আমার। প্রতিদিন। প্রতিদিন ফোন আসে, কবিতা পড়ে সকলেই উচ্ছ্বসিত। বসে থাকে পরদিনের কবিতার জন্য। শমীক বন্দোপাধ্যায়, ইংরেজি সাহিত্যের পণ্ডিত, একদিন নিজেই অনুবাদ করে ফেললেন কবিতা। ভীষণ উত্তেজিত। বললেন, ইংরেজি অনুবাদের সংকলনই প্রকাশ করে ফেলবেন তিনি। কবিতায় নিরাপদ বাড়িতে আমার দৈনন্দিন জীবনের কথা বলি। বন্দি অথচ ঠিক বন্দিও নই।
লোকে বলতে পারে, কারাগারের চেয়ে অনেক ভালো আছি। বা মানুষ আরও দুর্ভোগ পোহায় জীবনে। ঠিক। কিন্তু এই দুর্ভোগ অন্য দুর্ভোগের চেয়ে কম বলে এই কম-দুর্ভোগকে মেনে নিতে হবে কেন! আমার একটি পদক্ষেপেও বাধা দিতে চাইলে আমি রুখে উঠবো। যাদের একশটি পদক্ষেপ রোধ করা হয়, তাদের চেয়ে ভালো আছি, কারণ আমার মাত্র কুড়িটি পদক্ষেপ রোধ করা হচ্ছে, এই ভেবে সুখ পাওয়ার মানুষ আমি নই। আমার একটি পদক্ষেপও রোধ তোমরা করো না। কারণ যে কারণে রোধ করছো তা ভয়ংকর ভুল একটি কারণ। আমি কথা বলেছি, আমি লিখেছি, তা কারও পছন্দ নয় বলে আমার সামনে কেন বাধা হয়ে দাঁড়াবে। যাদের পছন্দ হচ্ছে না বলে আমাকে মার দিতে চাইছে, তাদের গিয়ে একটু স্বাধীনতার সংজ্ঞাটা শিখিয়ে এসো। কোনও কোনও মাথা খারাপ লোক স্বাধীনতার সংজ্ঞা জানবে না বলে, অথবা জানলেও মানবে না বলে তার দায় আমাকে নিতে হবে কেন! সরকারে যারা আছো, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যারা আছো, প্রচার মাধ্যমে আরা আছো, তারা দায়িত্ব নাও মানুষকে শিক্ষিত করার, দিনভর শেখাতে থাকো, ইহাকে স্বাধীনতা বলে, উহাকে গণতন্ত্র বলে, ইহাকে অধিকার বলে, উহাকে মত প্রকাশ বলে।
০৯.৪ ডায়রির পাতা (মার্চ)
২ মার্চ
আমি অবাক হয়ে যাই মানুষের ধর্মবিশ্বাস দেখে। মঙ্গলবার এরা মাছ মাংস খাবে না। হনুমানজির পুজো আছে। প্রত্যেকে পুজো করে। প্রত্যেকে ধর্ম বিশ্বাসী। সবারই হাতে লাল সুতো বাঁধা। শুধু ধর্মে নয়, যত রকম কুসংস্কার আছে, সবকিছুতে বিশ্বাসী। একজন ডাক্তার পেলাম না, যে ডাক্তার ধর্মের কথা বলে না। প্রতিটি ডাক্তারই, ছোট বা বড়, ভগবান যে আমার শরীরটা বানিয়েছেন, ভগবান যে অসুখ দিয়েছেন এবং ভগবানই যে অসুখটা সারাবেন তা বেশ জোর দিয়েই বললেন। আমি থ হয়ে বসে থাকি। শিক্ষিত অশিক্ষিত, নারী পুরুষ, গরিব ধনী নির্বিশেষে এই দেশে প্রায় সবাই ধর্মবিশ্বাসী।