‘সে কালে মধ্যরাতে কলকাতা শাসন করতে চার জন যুবক। সে ছিল কবিতার কাল, কল্পনার সাম্রাজ্য। যুগ বদলেছে। এখন, মধ্যরাতে নয়, দিনে দুপুরে, কবির কল্পনায় নয়, আমজনতার চাক্ষুষ বাস্তবে, কলকাতা শাসন করেন দু’ডজন বুদ্ধিজীবী। না, কেবল কলকাতা নয়, তামাম পশ্চিমবঙ্গ। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যর পশ্চিমবঙ্গ। নাট্যকার, অনুবাদক, সংস্কৃতিমনস্ক, নন্দনপ্রেমী আমাদের মুখ্যমন্ত্রী তসলিমা নাসরিনের আত্মজীবনীর তৃতীয় পর্ব ‘দ্বিখণ্ডিত’র ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন। কেন এই নিষেধাজ্ঞা? এ বইয়ের কিছু অংশ নাকি সাম্প্রদায়িক অশান্তি সৃষ্টি করতে পারে, তাই। বইটির কয়েক হাজার কপিইতিমধ্যেই ক্রেতার হাতে পৌঁছে গেছে। তসলিমার অন্য সব লেখার মতোই এই লেখা নিয়েও তর্কবিতর্ক, বাদপ্রতিবাদ হয়েছে, এমনকী মামলা-মোকদ্দমাও। কিন্তু কোথাও সাম্প্রদায়িক অশান্তির কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি। সেটা এই সমাজের বড় হয়ে ওঠার লক্ষণ। মস্ত সুলক্ষণ। তা হলে পশ্চিমবঙ্গের উন্নততর বামফ্রন্ট সরকারের গণতন্ত্র-অন্ত-প্রাণ কর্তারা এমন দমননীতি জারি করলেন কেন? পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, ২৫ জনের মত নিয়েছি। তাদের পড়িয়েছি। তার পরেই এই সিদ্ধান্ত। অর্থাৎ, ওই কতিপয় বুদ্ধিজীবীর সুপারিশ অনুসারেই এত বড় একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে তিন দশকের প্রবীণ বামফ্রন্ট সরকার। লেখকের স্বাধীনতা, নিজের কথা নিজের মতো করে লেখার স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া হয়েছে তাঁদের সুপরামর্শে। সত্য সেলুকাস। পরাধীন ভারতে ব্রিটিশ সরকার হামেশাই বইপত্র নিষিদ্ধ করতো, কিন্তু তার দায়িত্ব নিতো নিজেরাই। জরুরি অবস্থার কালো দিনগুলোতেও এমন অনেক নিষেধ জারি হয়েছে, কিন্তু সে জন্য ইন্দিরা গান্ধী বা সিদ্ধার্থশংকর রায়কে বুদ্ধিজীবীদের দোহাই পাড়তে শোনা যায়নি। উন্নততর বামফ্রন্টের মুখ্যমন্ত্রী এ এক নতুন মডেল চালু করলেন বটে। সেই মডেলের সার কথাটি হল, হুকুম জারি করবো, কিন্তু তার দায় নেব না। অবশ্য নেবেনই বা কোন দুঃখে? হাত বাড়ালেই যদি এক ঝাঁক গণ্যমান্য স্বনামধন্যের হাত মিলে যায়, যারা মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে (মাপ করবেন, অনুরোধে) রাত জেগে তসলিমা নাসরিনের আত্মজীবনী পড়ে ফেলে চটপট সুপারিশ জানিয়ে দিতে প্রস্তুত, তবে তো প্রশাসনের পৌষমাস–সংস্কৃতির ঘাড়ে বন্দুক রেখে সংস্কৃতি শাসনের এমন সুযোগ রাজপুরুষরা ছাড়বেন কেন? বিশেষত, সেই রাজপুরুষদের যদি আবার সংস্কৃতির নন্দনকাননে বিহারের বাসনা থাকে?
কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী এবং তার পরামর্শদাতারা কী ভেবে দেখেছেন, তাদের এই যৌথ উদ্যোগের তাড়নায় দেশে ও বিদেশে এই রাজ্যের গণতান্ত্রিকতার মর্যাদা কোন ধুলোয় লুটোলো? গোটা দুনিয়া জেনে গেল, পশ্চিমবঙ্গে একটি স্তালিন-রাজ জারি রয়েছে, যেখানে রাষ্ট্র শক্তি সম্পূর্ণ খেয়ালখুশি মতো আপনার কণ্ঠরোধ করতে পারে এবং সেই চণ্ডনীতিতে সাহিত্য, শিল্প সংস্কৃতির জগৎ থেকে নামজাদা কিছু নাগরিকের সমর্থন যোগাড় করে নিতে পারে। এ যদি সাংস্কৃতিক ফ্যাসিবাদের লক্ষণ না হয়, তবে সাংস্কৃতিক ফ্যাসিবাদ কাকে বলে, মাননীয় বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য মহাশয় বলে দেবেন কি? কে জানে হয়তো বা তসলিমা নাসরিনের বই নিষিদ্ধ করা এবং করানোর জন্য এই উদগ্র তৎপরতার পিছনে আসলে অন্য কারণ আছে। যে মেয়ে নিজের জীবনের বৃত্তান্ত লিখতে গিয়ে ক্রমাগত আরও অনেকের জীবনের বৃত্তান্ত জনসমক্ষে মেলে ধরে, তাকে আত্মপ্রকাশের অধিকার দেওয়াটা বোধহয় এ বার অতিমাত্রায় বিপজ্জনক হয়ে উঠছে। তা না হলে, পঁচিশ জন বুদ্ধিজীবী বললেন, তাই বই নিষিদ্ধ করলাম –এমন হাস্যকর নাবালকোচিত কৈফিয়ৎ, আস্তে কন, ঘুড়ায় হাসব।
বাংলার, দুই বাংলার সবচেয়ে বড় মনীষী শিবনারায়ণ রায় লিখেছেন ‘.. এ কথা নিশ্চয় করে বলতে পারি সমকালীন দুই বাংলা মিলিয়ে মেরি ওলস্টনক্রাফটের যোগ্যতমা উত্তরসাধিকা হচ্ছেন স্বদেশ থেকে নির্বাসিতা তসলিমা নাসরিন। দ্বিখণ্ডিত’ নামে তসলিমা নাসরিনের আত্মজীবনীর যে তৃতীয় খণ্ডটি প্রথমে বাংলাদেশে এবং সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের দ্বারা নিষিদ্ধ হয়েছে, আমার বিবেচনায় সেটি একটি অসামান্য গ্রন্থ। মাতৃগর্ভে আমাদের চেহারা নানা রূপের ভিতর দিয়ে মনুষ্য রূপ ধারণ করে। কিন্তু জন্মের পর থেকেই নানাভাবে চেষ্টা চলে শিশুকে সমাজ-স্বীকৃত একটি ধাঁচে গড়ে তুলবার। বিভিন্ন সমাজে, বিভিন্ন যুগে ধাঁচটির অদলবদল ঘটে, কিন্তু উদ্দেশ্যের অদলবদল ঘটে না। সেই উদ্দেশ্যটি হল সমষ্টিস্বীকৃত একটি ধাঁচের মধ্যে ফেলে ব্যক্তির স্বকীয় স্বাধীন বিকাশের সম্ভাবনাকে বিলুপ্ত করা। সমাজে যারা ক্ষমতার দখলদার তারা ধর্ম, ঐতিহ্য, শাস্ত্র, লোকাঁচার ইত্যাদির নামে এই ধাঁচে ফেলবার প্রক্রিয়াটি চালু করে। কিন্তু প্রতি শিশুর মধ্যে নিহিত থাকে নিজস্ব একটি অস্মিতা অর্জনের সামর্থ্য। তবে সেই অর্জনের জন্য লাগে ইচ্ছাশক্তি ও প্রয়াস, যুক্তিশীলতা এবং সততা, একনিষ্ঠ সাধনা ও অনুশীলন। এখনও পর্যন্ত দেখা যায় অধিকাংশ মানুষ সমাজ স্বীকৃত ছাঁচেই গড়ে ওঠে। কিন্তু কেউ কেউ তাঁদের প্রাজাতিক সামর্থ্যকে নিজের চেষ্টায় শত বাধাবিপত্তির সঙ্গে লড়াই করেই ক্রমে বাস্তবায়িত করেন তাঁদের স্বোপার্জিত অস্মিতা তাঁদের জীবনযাত্রায়, চিন্তায়, কার্যকলাপে ভাবনায়, এবং রচনায় প্রকাশিত হয়। এইভাবেই আমরা পাই সক্রেটিস থেকে বিদ্যাসাগর, জ্যোদানো ব্রুনো থেকে মানবেন্দ্রনাথ রায়। কিন্তু কীভাবে তারা নিজেদের এই অনন্যতন্ত্র, অস্মিতা গড়ে তুলেছিলেন তার বিবরণ কচিৎ মেলে। এ ক্ষেত্রে ফরাসি দার্শনিক সিমোন দ্য বোভায়ার-এর মতো তসলিমা নাসরিনকেও ব্যতিক্রমী মনে করি। খণ্ডে খণ্ডে প্রকাশিত তাঁর আত্মজীবনীর, এবং বিশেষ করে দ্বিখণ্ডিত’ নামে তাঁর তৃতীয় খণ্ডটির সবচাইতে বড় মূল্য এবং আকর্ষণ এটির ভিতর দিয়ে আমরা অনেকটা জানতে পারি কীভাবে বহু বাধাবিপত্তি, আঘাত, অপমান আর ব্যর্থতার ভিতর দিয়ে মুসলমান মধ্যবিত্ত ঘরের একটি সাধারণ মেয়ে তাঁর আত্মশক্তি আবিষ্কার করেন, অপ্রতিম তসলিমা নাসরিন হয়ে ওঠেন। প্রথম দুটি খণ্ডে যে ভূমিকা রচিত হয়েছিল তৃতীয় খণ্ডে তা পরিণতি পায়। এই গ্রন্থের যেমন ঐতিহাসিক তেমনি সাহিত্যিক মূল্য প্রচুর। দুই বাংলার সরকারি নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও এই বই অনেকে পড়বেন, এর ঢাকঢাক গুড়গুড়হীন স্পষ্টতা অনেকের অপছন্দ হবে। আবার অনেকেই এ বই থেকে আত্মরূপান্তরের প্রেরণা পাবেন। পশ্চিমবঙ্গে এখন যেসব বই জনপ্রিয় তাদের বেশির ভাগই অবক্ষয় এবং আপজাত্যের কাহিনী, অথবা লঘু রম্যরচনা। তসলিমার কষ্টের অন্ত নেই, কিন্তু তিনি পারিপার্শ্বিক চাপের কাছে হার মানেননি, নারী এবং পুরুষ উভয়েরই ভিতরে মনুষ্যত্বের উজ্জীবনে তার প্রয়াস আজও ক্লান্তিহীন।… তসলিমা তাঁর আত্মজীবনীর প্রথম দুটি খণ্ডে তাঁর বাল্যকাল এবং বয়ঃপ্রাপ্তির বিচিত্র অভিজ্ঞতার কথা লিখেছিলেন। কিছুই রেখেঢেকে লেখেননি। ফলে দুই বাংলার শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সমাজের অধিকাংশ স্ত্রী-পুরুষ–যাঁরা সমস্ত অপ্রিয় সত্যকে ধামাচাপা দিয়ে রাখাকেই সভ্যতার আবশ্যিক শর্ত বিবেচনা করেন –স্বভাবতই খুব বিচলিত হয়েছিলেন। ..