আজ কলকাতায় আমাকে ফিরিয়ে আনার দাবিতে অনশন শুরু হয়েছে কিছু মানুষের। বয়স্ক কিছু মানুষ, পঁয়ষট্টি থেকে আশি পঁচাশি বছর বয়স, বেহালার রাস্তায় মঞ্চ বানিয়ে অনশনে বসেছেন। সারাদিন ধরে চলছে বক্তৃতা। একুশ বাইশ তেইশ এই তিনদিন চলবে অনশন অনুষ্ঠান। সুনন্দ সান্যাল, অম্লান দত্ত, এবং আরও অনেকে ছিলেন। মন ভালো হয়ে যায় খবর শুনলে।
আজ সকালে এনামুল কবীরের সঙ্গে ফোনে কথা বলে খুব অবাক হই। তিনি আমাকে ভারত ছাড়ার উপদেশ দিচ্ছেন। যে মানুষ এত কাছের মানুষ, সবসময় সমর্থন করে এসেছেন আমার ভাবনা চিন্তা, ধর্মমুক্ত মানববাদী মঞ্চে’র যিনি সাধারণ সম্পাদক, তিনি এমন হঠাৎ পাল্টে গেলেন! উত্তেজিত কণ্ঠে তিনি যা জানালেন, বুদ্ধদের ভট্টাচার্যকে তিনি চিঠি লিখেছিলেন, তাঁর সাহিত্য পত্রিকা ‘নবমানব’ও পাঠিয়েছিলেন। চিঠি পেয়ে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য নিজে এনামুলকে দুটো চিঠি লিখেছেন। ফোন নম্বর পাঠিয়েছেন দ্বিতীয় চিঠিতে। ফোনে কথা হয়েছে দুজনের।
‘ভাই এনামুল পরিস্থিতি খুব জটিল ..’ এই বলে ফোনে কথা শুরু করেছেন বুদ্ধবাবু। এরপর কী বলেছেন তা আর এনামুল কবীর না বললেও অনুমান করা যায়। কারণ এনামুলের আচরণেই তা স্পষ্ট হয়। তিনি বলতে থাকেন, এই দেশ আমাকে এত হেনস্থা করছে, কেন এই দেশের মুখে লাথি মেরে আমি চলে যাচ্ছি না! এনামুলের মুখে আমার দেশ ছাড়ার কথা? হ্যাঁ তাঁর যুক্তি, আমাকে বুদ্ধবাবু কখনই চাননা কলকাতায় ফিরিয়ে আনতে। তিনি চান আমি চলে যাই! আমার চলে যাওয়াই উচিত। এনামুলকে বললাম, খুঁটিয়ে দেখলে সব দেশেরই ত্রুটি বিচ্যুতি ধরা পড়বে, এর সমাধান লাথি মেরে চলে যাওয়া নয়। তাহলে সব দেশ থেকেই অমন চলে যেতে হয়।
তপন রায় চৌধুরীও ক্ষমতার সামনে নীতি আদর্শ বিলিয়ে দিয়েছিলেন। এনামুলও। একজনকে ভ’বাবু কাজে লাগিয়েছেন। আরেকজনকে বুদ্ধবাবু।
চরম হতাশার মধ্যেও এই অনশনের সংবাদ আমাকে একটুখানি প্রাণ দেয়। রাজনীতিবিদ, সরকার, মৌলবাদী, অজ্ঞ, অশিক্ষিত, চোর, বদমাশ, বলেই, বলবেই মত প্রকাশের অধিকারের বিরুদ্ধে। ওরা বলে আসছে যুগ যুগ ধরে। কিন্তু যুগ যুগ ধরে সত্যের পক্ষে, স্বাধীনতার পক্ষে বলে আসছেন শিল্পী সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবী। যেদিন এই শিল্পী সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবী গলা মেলাতে শুরু করবে সরকারের সঙ্গে, মৌলবাদীদের সঙ্গে সেদিন বুঝতে হবে, সমাজে পচন ধরেছে। আমি বাংলার সমাজের এই পচন দেখে উদ্বিগ্ন। এই চরম উদ্বিগ্নতার মধ্যেও অনশনের সংবাদ আমাকে একটুখানি শান্তি দেয়।
.
২২ ফেব্রুয়ারি
ফরাসি প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দেখা করতে দেওয়া হল না। কিন্তু যেই না বলেছি সুইডেনের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে দেখা করবো, অমনি আয়োজন। রাষ্ট্রদূত আমাকে দুপুরের খাবারের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। দূতাবাসে যেতে আমি রাজি হইনি। রাজি হইনি কারণ সুইডিশ দূতাবাসে ঢুকে গেলে আমি আইনত সুইডেনের সীমানায়, ভারতের বাইরে। প্রভু আমাকে দূতাবাসে পৌঁছে দিয়ে আমাকে সেখান ফেরত আনতে নাও পারেন। রাষ্ট্রদূত লার্স ওলোফ লিন্ডগ্রেনই ঠিক করলেন তাজ হোটেলের চেম্বার্স রুমে দেখা হবে,দুপুরের খাবার ওখানেই। প্রভু খুশিতে আটখানা। চেম্বার্স রুমে একেবারে একটা সুইট সাজিয়ে ওখানে খাবার টেবিল বসিয়ে দিলেন। রাজকীয় আয়োজন। কেন! এর একটিই কারণ, যেন চলে যাই। যেন ভারত ছাড়ি। যেন চলে যাই –অণুক্ষণই চেষ্টা চলছে এর। রাষ্ট্রদূতকে কি উৎকোচ দেওয়া হচ্ছে, আমাকে যেন বুঝিয়ে সুঝিয়ে সুইডেন পাঠিয়ে দেন! তা নয়তো প্রভুর বা প্রভুর প্রভুর কী দায় পড়েছে সুইডেনের রাষ্ট্রদূতের নেমন্তন্নকে নিজের ঘাড়ে নিয়ে এটিকে এমন উৎসবে রূপ দেওয়ার। দূতাবাসের অফিসারদেরও নেমন্তন্ন করা হয়েছিল। খাওয়া হল, গল্প হল। কিন্তু অ্যামবাসাডার আমাকে ভারত ছেড়ে সুইডেন যাওয়ার ব্যাপারে কোনও উপদেশ দেননি। সেইফ হাউজে বা নিরাপদ বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার সময় আমি বুঝি যে প্রভু উন্মুখ হয়ে আছেন আমি সুইডেনে চলে যাবো এরকম কিছু শোনার জন্য। অনেকক্ষণ যখন কোনো কিছু বলিনি এ নিয়ে, কী কথা হয়েছে, যেচে জানতে চেয়েছেন।
প্র–কী কথা হল?
ত–কেমন আছি। কী করছি।
প্র–কী বললেন?
ত–বললাম, যেমন আছি, যেমন অনুভব করছি, সব।
প্র–সব বললেন?
ত–হ্যাঁ। আমি তো কিছু লুকিয়ে রাখি না।
প্র–ভালো নেই আপনি, বললেন?
ত–বললাম সব আছে, শুধু যেখানে খুশি সেখানে যাওয়ার স্বাধীনতা নেই।
প্র–কী বললেন উনি?
ত–শুনলেন। কিছু বললেন না।
প্র–উনাকে তো বেশ চমৎকার ভদ্রলোক বলে মনে হল।
ত–হ্যাঁ। আপাদমস্তক আধুনিক মানুষ। আচ্ছা, আপনারা খেয়েছেন তো?
প্র–যা খেয়েছি। উনি আর কী বললেন?
ত–কী ব্যাপারে?
প্র–আপনার ব্যাপারে।
ত–আমার ব্যাপারে মনে তো হয় উনি ভালো জানেন। কী ঘটেছে কলকাতায়, কেন ঘটেছে, কী ঘটেছিলো বাংলাদেশে, কেন ঘটেছিলো, সব উনি বেশ ভালো বোঝেন।
প্র–আর দিল্লিতে যা ঘটছে?
ত–এ নিয়ে তো কথাই হল। উনার আর বলার কী আছে। উনি তো এ দেশের লোক নন।
প্র–তা জানি। কিন্তু আপনি তত উনার দেশের লোক।
ত–হা কাগজে কলমে। আমাকে কি দেখতে শুনতে সুইডিশ মনে হয়, না কি ভারতীয় মনে হয়, বলুন তো!
প্র–এই যে আপনি এখন সেইফ হাউজে আছেন, কোনও ফ্রিডম নেই। কলকাতাতেও আপনার যাওয়া হবে না। ভারতের রাজনীতির আপনি শিকার, এ নিয়ে কোনও কথা হয়নি?