বেশ কিছুক্ষণ পর চা এলো। প্রভুকে বলছি, আমাকে এই অসুস্থ অবস্থায় আর যেন কোনও কারাগারে রাখা না হয়, আমাকে যেন অতি অবশ্যই কলকাতায়, আমার বাড়ি পাঠানো হয়। কলকাতায় থাকলে তো আমি এভাবে মরতে বসতাম না। এই নির্বাসনে আমার থাকা মানে আমার রক্তচাপ বাড়তে থাকা, আমার হৃদযন্ত্রের ক্ষতি হতে থাকা। ভ’বাবু এলেন মিনিট পনেরোর মধ্যেই। প্রভুর মুখে একগাল হাসি। সারাক্ষণই আজ তিনি খুশি খুশি। এত খুশির কারণ কী! কোনও ভালো কিছু কি ঘটতে যাচ্ছে! আমার জানার সাধ্য নেই। সম্ভবত প্রভু জানেন যে আজ ভ’বাবু আমাকে কলকাতায় পাঠানোর ব্যবস্থা পাকা করবেন। অথবা প্রভুর খুশির কারণ ভ’বাবুর প্রিয় পাত্র হয়ে উঠেছেন তিনি, তাঁর উপদেশ বা পরামর্শ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন। অত্যন্ত নিষ্ঠ, কর্মঠ, বিশ্বস্ত। আমি ক্লান্ত। অসুস্থ। আশা আমাকে আলোকিত করে বটে, তবে এ বড় ফ্যাকাসে আলো। আমার রক্তচাপ এখনও স্বাভাবিক নয়। এখনও শরীরে টের পাই ওষুধের বিষক্রিয়া, এখনও টের পাই রক্তচাপ আকাশে উঠছে, আবার পাতালে নামছে। প্রভু কখনও কিছুই পরিষ্কার করে আমাকে বলেন না। সম্ভবত এমনই নির্দেশ তাকে দেওয়া হয়েছে। প্রভুকে অনেক সময় একটি পুতুলের মতো মনে হয়। চাবি দেওয়া পুতুল। যা বলেন তিনি, সবই শিখিয়ে দেওয়া কথা। এই খুশি খুশি মুখটাও কি শিখিয়ে দেওয়া! কে জানে!
অন্য একটি ঘরে ভ’বাবু এবং একজন অচেনা ভদ্রলোক। ভ’বাবু দাঁড়িয়ে হাতজোড় করে নমস্কার করছেন। আমিও নমস্কার জানিয়ে মুখোমুখি বসলাম। এই মানুষটি কী ভাবছেন, আমার সম্পর্কে তাঁর কী চিন্তাভাবনা, কী পরিকল্পনা তার আমি কিছুই জানি না। কিন্তু এই মানুষটির কাছ থেকে স্নেহ, সমর্থন সব আমি পেয়েছি। এই মানুষটিই তো আমার সবচেয়ে শুভাকাঙ্ক্ষী। তাঁর বাড়িতে কত গেছি, কত ফোনে কথা হয়েছে। সব প্রতিকূলতার মধ্যে তিনিই তো আমার ভারত-বাসের অনুমতিকে বাড়িয়ে চলেছেন। নিশ্চয়ই আমাকে কলকাতার বাড়িতে ফেরাতে খুব চেষ্টা করছেন।
খুব কাছের মানুষের কাছে যেভাবে অভিযোগ করে মানুষ, সেভাবেই অভিযোগ করলাম এত যে ডাক্তার দেখাতে চেয়েছি, তারপরও প্রভু দেরি করেছেন ডাক্তার দেখাতে। প্রায় দু’মাস পর ডাক্তারের ব্যবস্থা করলেন বটে, প্রথম তো হাতুড়ে ডাক্তার, তারপর একজন হাসপাতালের ডাক্তার, ওঁর ওষুধ খেয়েই শরীর খারাপ হল। হাসপাতালে তো মরতেই বসেছিলাম, জীবন বাঁচানোর ওষুধ দিয়ে বাঁচিয়েছে।
প্রভু বসাই ছিলেন অদূরে। ভেবেছিলাম প্রভুকে এবার ভ’বাবু কিছু ধমক দেবেন। কাজে ফাঁকি দিলে যেভাবে ধমক দেওয়া হয় অধস্তনদের। বলবেন তাঁর কারণেই আমার জীবন ঝুঁকিপূর্ণ হয়েছিল। কিন্তু আশ্চর্য কোনও কটুক্তি নয়, কিছু নয়। ভ’বাবু আমার শরীর এবং মৃত্যুর দুয়ার থেকে আমার ফিরে আসা, এখনও রক্তচাপের স্থিতাবস্থায় না আসা, এখনও যে কোনও সময় দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়ার আশংকা, এসবের তোয়াক্কা না করে বললেন, আপনার সঙ্গে আমি এই কারণে কথা বলতে এসেছি যে, আপনি তো এ দেশের সম্মানিত অতিথি, আপনি নিশ্চয়ই, যেহেতু আমরা কথা দিয়েছি যে, এ দেশের আতিথ্য আপনি পাবেন, আপনি ভিসা পাবেন, নিশ্চয়ই পাবেন। আপনার ভিসার মেয়াদ আমরা সামনের ফেব্রুয়ারিতে বাড়াবো। নিশ্চয়ই বাড়াবো। তাই আপনি যদি এ সময় ফ্রান্সে যে পুরস্কারটা আপনি পেয়েছেন, সেটা আনতে যান, খুব ভালো হয়। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টকে আমি বলেছি, এরকম তো নিয়ম নেই যে ফ্রান্সের পুরস্কার ভারতে দেওয়া যাবে। যে দেশ পুরস্কার দেয়, সেই দেশে অথবা যে দেশের মানুষকে পুরস্কার দেওয়া হয়, সেই দেশে পুরস্কার দিতে হয়।
আমি বলে উঠি, ‘কিন্তু পুরস্কার তো …..’
ভ’বাবু কঠিন স্বরে আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলেন, ‘আমার কথা শুনুন।‘
আমি চুপ হয়ে যাই। তিনি বলতে থাকেন, আপনি তো ভারতের নাগরিক নন, সে কারণে এ দেশে তো পুরস্কার দেওয়া যাবে না। আপনাকে হয় বাংলাদেশ যেতে হবে, নয়তো ফ্রান্সে যেতে হবে পুরস্কার নিতে। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট আপনাকে ফ্রান্সেই আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। ওখানে আপনার যাওয়ার সব ব্যবস্থাও করে দেওয়া হবে। আমরাই করে দেব। কোনও অসুবিধে নেই। আপনি পুরস্কার নিতে যান।
আমি ক্ষীণ কণ্ঠে বলি, ভ’বাবুর দিকে বড় সরল চোখে তাকিয়ে, ‘যে পুরস্কারটা আমি পেয়েছি সেটার অনুষ্ঠান গত নয়ই জানুয়ারি প্যারিসে হয়ে গেছে। ওখানে আমার প্রকাশক পুরস্কার গ্রহণও করেছেন। সার্টিফিকেটটা তাঁর কাছে আছে, ওটা আমার কলকাতার ঠিকানায় পাঠিয়ে দিতে বলেছি।
‘হুম’। ভ’বাবু গম্ভীর হয়ে বললেন, আপনি যদি ফ্রান্সে কিছুদিনের জন্য যান, ভালো হয়। আমি মন্ত্রী হিসেবে বলছি, আপনার কোনও অসুবিধে হবে না বিদেশে থাকার। এখান থেকে সব ব্যবস্থা করেই আমরা পাঠাবো। কোথায় থাকবেন ফ্রান্সে, তার কথা ভাবতে হবে। না আপনার। ফ্রান্স থেকে যদি আপনি অন্য কোনও দেশে বেড়াতে যেতে চান, সেই ব্যবস্থা আমরা করে দেব। টাকা পয়সার ব্যাপারে আপনি কোনও চিন্তা করবেন না। সব ভারত সরকার করবে।
ভ’বাবুর দিকে তাকালাম। তিনি আমার দিকে নয়, অন্য দিকে তাকিয়ে আমার উদ্দেশে কথা বলে যাচ্ছেন। তার পাশের লোকটি লিখে নিচ্ছেন খাতায় কথাবার্তা, প্রভুও খাতা বের করে লিখছেন। আমরা যা কথা বলছি, তা আমাদের দুদিকে দু’জন বসে লিখে যাচ্ছেন। আশ্চর্য, এ কেমন এক সরকারি দেখা হওয়া! ভ’বাবুর গায়ে সুট, মাথায় উলের টুপি। তাঁকে এই পোশাকে কোনওদিন দেখিনি আগে। যতবার তার সঙ্গে দেখা হয়েছে, তাঁকে ধুতি পাঞ্জাবিতেই দেখেছি। সেই হাসি মুখের আন্তরিক মানুষটি কোথায়! এই মুখে সেই মুখটি খুঁজি। নেই। তিনি বিরতিহীন বলে যাচ্ছেন আপনার কলকাতা যাওয়ার ব্যাপারে এ সময় তো নিশ্চিত করে কিছু বলা যাচ্ছে না। ওরা আবার হৈ চৈ শুরু করতে পারে, ভিসা বাড়ানোর আগে আগে। সতেরো তারিখে আপনার ভিসার এক্সটেনশন হবে, যোলো তারিখেই একটা হৈচৈ করবে ওরা। তখন ওদের বলা যাবে যে ‘উনি দেশে নেই। উনাকে আনার ব্যাপারে পরে বিবেচনা করা হবে। পরিস্থিতি শান্ত হলে নিশ্চয়ই আপনি ফিরে আসতে পারবেন। আপনার যদি মনে হয় আপনি আর আসতে পারবেন না এ দেশে, তাহলে তো ভুল মনে হওয়া। নিশ্চয়ই পারবেন। আমি তো তপন রায় চৌধুরীকে বলেই দিয়েছি। উনি তো খুব স্নেহ করেন আপনাকে। আপনার বয়সী উনার মেয়েও আছে। খুব মেয়ের মতো স্নেহ করেন। তাকে বলেছিলাম আপনাকে বলার জন্য। আপনি ইচ্ছে করলে তাঁর বাড়িতে, অক্সফোর্ডে তার বাড়িতেও থাকতে পারেন। কোনও দুশ্চিন্তা করার কিছু নেই আপনার। কবে যাবেন, তা যে এক্ষুনি ঠিক করতে হবে আপনার, তা তো নয়। আপনি দু’একদিন সময় নিন। দু’একদিন পর জানালেও চলবে।