এরপর নিজেই কলকাতায় ডাক্তারদের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করে ওষুধ কী খাবো, তা জেনে নিই। রক্তচাপ একশ ষাট-একশ সত্তর/একশ-একশ দশ এরকম থাকছে। এনালাপ্রিল পাঁচ মিলিগ্রাম আর হাইড্রোক্লোরোথায়াজাইড সাড়ে বারো মিলিগ্রাম দিলেন কলকাতার ডাক্তার। সকালে ওষুধ খেয়েও নিলাম একদিন। যেদিন খেলাম ওষুধ, সেদিন প্রভু ফোনে বেশ উৎফুল্ল কণ্ঠে জানালেন, বিরাট হাসপাতালের বিরাট কার্ডিওলজিস্ট আনা হচ্ছে। বাহ, চমৎকার! তৃতীয় জায়গায় সন্ধে বেলা আমাকে নিয়ে যাওয়া হল। এবারের ডাক্তারকে ডাক্তার বলে মনে হল। ডাক্তার রক্তচাপ মাপলেন। ওষুধ লিখে দিলেন। রক্তচাপের জন্য আড়াই মিলিগ্রাম এনালাপ্রিল খাচ্ছিলাম। আমাকে লিখে দেওয়া হল তিন ওষুধের কমবিনেশন ড্রাগ। ঘরে ফিরে লিখে দেওয়া নতুন ওষুধগুলোর মধ্য থেকে একটা অ্যামলোডিপিন, ক্যালসিয়াম চ্যানেল ব্লকার খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার শরীর শিথিল হয়ে আসে। শরীর কুলকুল করে ঘামতে থাকে। সারা শরীর অবশ হয়ে যাচ্ছে, টের পাচ্ছি। কখনও শরীরে এমন অনুভূতি হয়নি। আমি বুঝতে পারছি আমি হারিয়ে যাচ্ছি, তলিয়ে যাচ্ছি। তখনও শরীরে সামান্য যেটুকু শক্তি ছিল, সেটুকু প্রয়োগ করে ফোন করলাম আকাশকে। অফিসার আকাশ। আকাশ এলো বটে, তবে আর আকাশের সঙ্গে কথা বলতে পারছি না আমি। আমাকে নিয়ে যাওয়া হল স্ট্রেচারে করে হাসপাতালে। স্ট্রেচার এই ক্যান্টনমেন্টেরই সম্ভবত। হাসপাতালের দরজায় দাঁড়িয়ে ছিলেন প্রভু। ডাক্তার ছিলেন। ভর্তি করা হল সিসিইউতে। করোনারি কেয়ার উইনিটে। কথা বলতে চাইলাম, তবে কথা স্বাভাবিক নয়। একটি শব্দ বলতে দীর্ঘক্ষণ সময় নিচ্ছি। সিসিইউতে মনিটরে দেখা হচ্ছে রক্তচাপ, হৃদস্পন্দন। দেখা হচ্ছে ইসিজি। ডাক্তার খুব চেষ্টা করছেন জানতে আমার গা চুলকোচ্ছে কি না, গায়ের কোথাও অ্যালার্জির রিয়েকশান দেখা দিয়েছে কি না। না, দেখা দেয়নি। সম্ভবত অ্যামলোডিপিনের প্রতিক্রিয়া, বললাম ডাক্তারকে। অথবা সারাদিনে তিন তিনটে ওষুধ খাওয়া, এটা অতিরিক্ত ওষুধের কারণে হয়ে থাকতে পারে। রাত দুটোর দিকে মরতে বসেছিলাম। আবার গা ঘামতে শুরু করলো। আবার শরীর অবশ হতে শুরু করলো। পালকের মতো হালকা হতে শুরু করলো। মনিটরে দেখি রক্তচাপ কমতে কমতে প্রায় শূন্যতে নেমে যাচ্ছে। ডাক্তারকে ডাকছি, যেন আমাকে বাঁচান। অল্প বয়সী ডাক্তার। স্যালাইনএর গতি সম্পূর্ণ বাড়িয়ে দিল। একের পর এক স্টেরয়েড চলতে লাগলো। জীবন বাঁচানোর ওষুধ। আমি পৃথিবীর কাছে বিদায় নিয়ে নিচ্ছি তখন। বিদায় অবকাশ, বিদায় ময়মনসিংহ, বিদায় বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, বিদায় পৃথিবী, বন্ধুরা, গুণীজনগণ, অনুরাগীগণ। বিদায় জানাচ্ছি, স্টেরয়েড চলছে হৃদপিন্ডকে ফেরানোর জন্য। স্যালাইন চলছে পুরোদমে। দু’ঘণ্টা পর ধীরে ধীরে ফিরতে থাকি মাটির পৃথিবীতে। মৃত্যুর সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ পর্ব সারা হল। আঙুল স্পর্শ করাই হয়েছে শুধু, নিবিড় আলিঙ্গনটিই বাকি।
পরদিন বড় ডাক্তার সব দেখেশুনে বললেন, ওষুধের ‘পয়জনাস রিয়েকশ্যান’ হয়েছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কেন, তিন তিনটে ওষুধে, নাকি অ্যামলোডিপিনে? ডাক্তার বললেন, ঠিক বলা যাচ্ছে না। তবে অ্যামলোডিপিনে হলে ওই ওষুধ আপনি আর কখনও খেতে পারবেন না। সেদিন আমি প্রভুকে বার বার বললাম, আমি ভ’বাবুর সঙ্গে কথা বলতে চাই। প্রভু একসময় বললেন, তিনি জানিয়ে দিয়েছেন আমার অনুরোধ। এবার আমি প্রশ্ন করলাম, যে মানুষ রক্তচাপ কমাতে একটি আড়াই মিলিগ্রামের ওষুধ খাচ্ছিল, তাকে রক্তচাপ কমানোর তিন রকম ওষুধের কম্বিনেশন কি কেউ দেয়? কোনো ডাক্তার দিতে পারে? ডাক্তার বললেন,সাধারণত এমন হয় না। যদি ভুল হয়েই থাকে, হয়েই গেছে, পুরনো কথা ভেবে লাভ কী? আপনাকে সুস্থ হয়ে উঠতে হবে, আপাতত সেটাই ভাবা হোক না কেন! টেনশন ফ্রি থাকার চেষ্টা করুন।
রোববার সেদিন। প্রভু আমাকে দেখতে এলেন। কিন্তু ভ’বাবুর সঙ্গে ফোনে কথা বলতে দিলেন না। বললেন, ওঁর সঙ্গে কথা হয়েছে, উনি বলেছেন পরে তিনি কথা বলবেন।
রক্তচাপ গ্যাসবেলুনের মতো একবার ওপরে ওঠে, একবার ধপাস করে তলিয়ে যায়। এরকমই চলতে থাকে। ডাক্তাররা একেবারে সম্পূর্ণ বিশ্রাম দিয়ে রেখেছেন। কোনও ওঠা নামা মানা। বারবারই বলেছেন, স্ট্রেস, টেনশন এসব আমার রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে না। দুশ্চিন্তা, উদ্বেগ আমার জীবনে সবচেয়ে ক্ষতিকর, এগুলো অনেকটা মৃত্যু ডেকে আনছে। বাঁচতে চাইলে এগুলো আমাকে ত্যাগ করতে হবে। ত্যাগ কি চাইলেই করা যায়। পরদিন, তারপরের দিনও আমি সিসিইউতে। তারপরের দিনও। ডাক্তার বলে দিলেন, যতদিন না রক্তচাপ স্বাভাবিক হবে ততদিন থাকতে হবে হাসপাতালে। এবং ওষুধ পত্র কী খেতে হবে, তা বুঝিয়ে দিয়ে আমাকে বিদেয় দেওয়া হবে, তার আগে নয়। ডাক্তারদের এই সিদ্ধান্ত অবশ্য ডাক্তাররাই পরে পাল্টে ফেললেন। প্রভু ওঁদের আলাদা করে ডেকে নিয়ে কিছু বলেছিলেন, জানি না কী বলেছিলেন।
সরকারি সিদ্ধান্ত আমাকে হাসপাতাল ছাড়তে হবে। সরকারি হাসপাতালের ডাক্তাররা অতপর সরকারি অফিসারের আদেশ পালন করলেন, রোগীকে বিদেয় করলেন। তখন অনুমান করা সম্ভব ছিল না, পরে অনুমান করি, টাইমস অব ইন্ডিয়ায় আমার হাসপাতালে ভর্তির খবর ছাপা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার জীবন কী হবে না হবে এই ব্যাপারে যারা সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, তাঁরা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আমাকে আর হাসপাতালে রাখা যাবে না, কাউকে জানতে দেওয়া যাবে না আমার অসুখ বিসুখের খবর। লোকে তবে জেনে যাবে, কেমন আছি, কোথায় আছি, কী অবস্থায় আছি, আমাকে নিয়ে কী হচ্ছে না হচ্ছে, সব! মিডিয়াকে সরকারি লোকেরা পছন্দ করেন, তবে সবসময় নয়। তাছাড়া আমাকে যেতে হবে ভ’ বাবুর কাছে। তিনি কথা বলতে চেয়েছেন। কথা বলতে চেয়েছেন, তো ফোনে কথা বললেই হয়। না, সেটি হবে না। ভ’বাবু দেখা করতে চেয়েছেন। তিনি কি আসতে পারবেন না সিসিইউতে? মানুষ তো রোগী দেখতে হাসপাতালে যায়। আমার এই প্রশ্নটি অবাক করে প্রভুকে। আসলে আমিও বোকার হদ্দ। একজন মন্ত্রী মানুষ হবেন কেন! উনি তো মন্ত্রী। মন্ত্রী আমার মতো সাধারণ মানুষকে দেখতে হাসপাতালে আসবেন কেন? সিসিইউ থেকে তুলে আমাকে নিয়ে যাওয়া হল ভ’বাবুর কাছে। তার সঙ্গে দেখা করার সময়ের আগে যে সময়টা, বাড়তি, হাতে পাওয়া, তা হাসপাতালেও খরচ করা হল না। নিয়ে আসা হল ‘নিরাপদ বাড়ি’তে আবার। ‘নিরাপদ বাড়ি’ থেকে ভ’বাবুর কাছে। কাছে ঠিক নয়, একটি খালি বাড়িতে। সেটিও হয়তো আরেকটি নিরাপদ বাড়ি। ও বাড়িতে আমাকে বসানো হল। সম্ভবত কোনও সরকারি অতিথিশালা। রাস্তার পাড়ে, এরকম একতলা অনেকগুলো সুন্দর সুন্দর বাড়ি। বাড়িগুলো কোথায়, ঠিকানা কী, এসব কিছুই প্রভু বললেন না। প্রভু তাঁর নিজের পদ এবং পদবি দুটোই যখন গোপন রাখেন, কেন বলবেন জায়গাটা কোথায়, কোথায় এনেছেন আমাকে। একটা অদ্ভুত রহস্যের মধ্যে সব ঘুরপাক খায়।