বলি, আমি ভারতের নাগরিক নই, আমাকে যে ভারত বাসের অনুমতি দিয়েছেন সরকার, আমি কৃতজ্ঞ। আমি মামলা করবো না। যদি মানবাধিকারে, মত প্রকাশের অধিকারে যারা বিশ্বাস করে, তারা একজোট হয়ে সরকারের কাছে দাবি জানান, আমার বিশ্বাস, আমি মুক্তি পাবো।
আমার কোনো কথাই লইয়ার মানেন না। বলেন, ”তুমি শুধু কাগজে সই দেবে, আমাকে তোমার পক্ষ হয়ে লড়ার অনুমতিটা দেবে। আমি বাকি সব কাজ করবো। এক মামলা করেই তুমি ওই বন্দিজীবন থেকে বেরোতে পারো। তা না হলে তোমাকে লাথি মেরে দেশ থেকে বের করে দেবে যে কোনওদিন, আর কখনো ফিরতে পারবে না। একবার ভিসার মেয়াদ ফুরিয়ে গেলে, এ সম্ভব হবে না। কিছু মৌলবাদী তোমার বিরুদ্ধে মিছিল করেছে বলে তোমাকে তোমার বাড়ি থেকে উঠিয়ে নিয়ে অন্য এক শহরে অনির্দিষ্টকালের জন্য একটা অজ্ঞাতস্থানে রেখে দিয়েছে, এ কারণে তোমার মানসিক অবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছে। মামলা করলে তোমার হারাবার কিছু নেই। তুমি এর মধ্যে সবই হারিয়েছে। এখন দেশ থেকে তোমাকে তাড়িয়ে দিলে মামলা করার সুযোগ তোমার জুটবে না, তসলিমা। ভেবে দেখো। ভাবার সময় চাও যদি, নাও।
কিছুদিন পর আবারও ফোন করে ইন্দিরা ওই একই কথা জিজ্ঞেস করেন। আমি রাজি কি না মামলা করতে।
আমি রাজি নই। এভাবেই চলতে থাকে। একদিন আমি বলি, যা-ই হোক, যা ইচ্ছে তাই হোক, সরকারের বিরুদ্ধে মামলা আমি করবো না। আমি অপেক্ষা করবো যতদিন না সরকারের সিদ্ধান্ত বদল হয়।
ইন্দিরা জয়সিং রাগ করে ফোন রেখে দেন।
.
২৩ জানুয়ারি
প্রভুকে বার বার জিজ্ঞেস করার পর জানিয়ে দিলেন, কদিন আগে কী-চাই-আমি বলে যে একটি লিস্ট দিয়েছিলাম তার হাতে, সেটির কোনওটিই মানা ভারত সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়।
.
২৭ জানুয়ারি
‘এই সর্বদলীয় পাষণ্ডামি এবং তৎসহ ছলনাময় অকথ্য রাজনীতি যাঁরা করেন, তাদের মুখোশ এই প্রথম, কিংবা কেবল এইবারই লোকসমক্ষে ঝুলে পড়েছে, তা বলবো না। কিন্তু মানবিকতার প্রশ্নে, মত প্রকাশের স্বাধীনতার দাবিতে কিংবা সর্বাপেক্ষা মূল্যবান যে প্রশ্ন, সংবিধানের অন্তর্নিহিত মহান আদর্শটির সংরক্ষণের দায়িত্বে এবার তাদের ব্যর্থতা আমাদের বুকে তীরের মতো বিঁধছে। তসলিমাকে নিয়ে যে অগ্নিপরীক্ষায় আমাদের রাজ্যের, অথবা কেন্দ্রের পীড়াদায়ক রাজনীতি চলছে, তার কোনও তুলনা হতে পারে না। এই লজ্জা তসলিমার লেখা বই ‘লজ্জা’র মলাট দিয়েও ঢাকা যাবে না। –শ্রীনিরেপেক্ষ
যারা পাহারা দিচ্ছে, তারা এখন কথায় কথায় আমাকে উৎসাহ দিচ্ছে দেশ ছাড়ার জন্য। ভয়ংকর সব ঘটনা ঘটছে। মানসিক পীড়ন যে কতদূর পৌঁছোতে পারে, তা দেখা হল ডাক্তারের বেলায়। ডাক্তার দেখাতে চাইছি, রক্তচাপ বাড়ছে শরীরে। কিন্তু ডাক্তার দেখানোর নামগন্ধ নেই। মুখে বলে কাজ হচ্ছে না বলে লিখিত অনুরোধ জানালাম যে ডাক্তার চাই। বিশেষজ্ঞ ডাক্তার চাই। কার্ডিওলজিস্ট চাই। কারণ, রক্তচাপ বাড়ছে, ওষুধের মাত্রা বাড়িয়েও কমার কোনও লক্ষণ নেই। তিন সপ্তাহ কোনও যোগাযোগ করলেন না প্রভু। একজন ডাক্তার দেখানোর জন্য কাতর অনুনয়ের পরও প্রভু কর্ণপাত করলেন না। আমার জামা জুতো সাবান শ্যাম্পু লাগলে তা দিচ্ছেন, কিন্তু ডাক্তার দরকার হলে দিচ্ছেন না। প্রভু তো বলেই দিয়েছেন, সম্ভব নয়।
ত–সম্ভব নয়, কেন?
প্ৰ–বিকজ অব সিকিউরিটি।
ত–সিকিউরিটির কারণে আমি কোনও ডাক্তার দেখাতে পারবো না?
প্র–নো ম্যাডাম।
ত–সিকিউরিটির অসুবিধেটা কী হবে, শুনি?
প্র–কোনও ডাক্তারের চেম্বারে যাওয়া সম্ভব হবে না।
ত–তাহলে ডাক্তার নিয়ে আসুন। আমার ব্লাড প্রেশার এখন একশ’ সত্তর বাই একশ’ কুড়ি। আর আপনি বলছেন সিকিউরিটির কারণে ডাক্তার দেখানো সম্ভব নয়।
প্র–ডাক্তার নিয়ে আসাও সম্ভব নয়।
ত–তাহলে ওই তৃতীয় জায়গায় নিয়ে চলুন, যেখানে নিয়ে আসতে পারেন কাউকে।
প্র–আমি আপনার প্রস্তাব যথাস্থানে জানিয়ে দেবো। স্যরি ম্যাডাম। আমি যা নির্দেশ পাই, তা-ই আপনাকে জানাই। আপনি ভুল বুঝবেন না। আপনাকেও বুঝতে হবে আপনার সিকিউরিটির ব্যাপার। আপনার একটি জিনিস নিয়েই আমরা চিন্তিত, সে আপনার নিরাপত্তা।
ত–ডাক্তার দেখালে আমার নিরাপত্তা নষ্ট হবে। কিন্তু ডাক্তার না দেখালে, ওষুধ না খেলে আমি তো মরে যাবো।
প্র–আমি দেখছি, কী করতে পারি।
প্রায় দু’মাস ডাক্তারের জন্য অনুরোধ করার পর আমি যখন তাকে বলতে লাগলাম, আমার কিন্তু হার্ট অ্যাটাক হবে, প্রভু চমকালেন না। একটু কী স্বস্তি পেলেন! হার্ট অ্যাটাক হলে তো আপদ বিদেয় হয়, একদিক দিয়ে ভালোই। এও বলি, ”আমি মারা গেলে কিন্তু লোক ভাববে আপনারা মেরে ফেলেছেন। প্রভুর পাথর-মুখে দুশ্চিন্তার কিছু ছায়া পড়েছে বলবো না। তারপর মিডিয়াকে যেদিন জানালাম, আমাকে ডাক্তার দেখাতে দেওয়া হচ্ছে না’, প্রভু ডাক্তারের ব্যবস্থা করলেন। সেই তৃতীয় জায়গায় আমাকে নিয়ে গেলেন। সেখানে যে ডাক্তারের দেখা পেলাম, তাকে আমার পছন্দ হওয়ার কোনও কারণ নেই। ডাক্তার তাঁর পরিচয় পত্র দেখালেন না, নাম বললেন না। প্রভুর বারণ আছে। ডাক্তার ডাক্তারি জানেন বলে আমার মনে হয়নি। আমাকে দেখে যথারীতি চিনে ফেলে একরকম কাপছিলেন। তার কোনও ওষুধ লেখারও দরকার হয়নি। কারণ তিনি ঠিক বুঝে পাচ্ছিলেন না তিনি কী ওষুধ লিখবেন। ওই ডাক্তারের চেয়েও রক্তচাপ বিষয়ে জ্ঞান আমার বেশি, এ শুধু ডাক্তার বোঝেননি, পাশে বসে থেকে প্রভুও বুঝেছেন। ডাক্তার চলে গেলেন, আমাকেও নিয়ে আসা হল নিরাপদ বাড়িতে।