মানস ঘোষ ফোন করেন না আগের মতো। স্টেটসম্যানে নিয়মিত কলাম আমি আবার লিখতে শুরু করবো বলার পর মানস ঘোষ এখন না’ বলে এড়িয়ে গেলেন। পরশু দুটো লেখা আমাকে নিয়ে ছাপা হল। ভবানীপ্রসাদের লেখায় আমার বিরুদ্ধে যে মন্তব্য আছে, তা বড় করে ছাপানো হল। কাল একটা চিঠি ছাপানো হল বিরুদ্ধে। ভারতের আইন বিরুদ্ধ কাজ করেছি, তা বলা হল। আজকে সিদ্ধার্থ শংকর রায়ের একটা লেখা ছাপা হল দ্য স্টেটসম্যানে। সেখানে তিনি লিখেছেন, একজন বিদেশি নাগরিকের আইনত কোনও অধিকার নেই এদেশের মানুষের ধর্ম নিয়ে কথা বলার, কুড়ি কোটি মুসলমানের মনে আঘাত দেওয়ার। সে ক্ষেত্রে বিদেশি নাগরিকের ভিসাই বাতিল করা উচিত।
এই লেখাটা পড়েই আমার সন্দেহ জাগল আদৌ আমার ভিসা ভারত সরকার দেবে কি না। না দেবার যথেষ্ট লক্ষণ আছে। আমার প্রতি যদি সরকারের সহানুভূতি থাকতো, তবে তার আঁচ আমি পেতাম। আমাকে এমন দুঃসহ জীবন যাপন করতে হত না। যদি কলকাতায় ফেরা রাজনৈতিক কারণে সম্ভব এখন নাও হত, আমাকে ভ’বাবু নিজ মুখে। বলতে পারতেন, এখন সম্ভব হচ্ছে না, তুমি দিল্লিতেই আপাতত থাকো। আমি দিল্লিতেই নিজের মতো করে থাকতাম। যদি নিরাপত্তার দরকার হত, তবে ব্যবস্থা এখানেই করা হত, এই দিল্লিতেই। আমি চলাফেরা করতাম নিজের মতো, নিরাপত্তা রক্ষীর প্রয়োজন হলে নিরাপত্তা রক্ষী থাকতো।
আর এক মাস আছে ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার। বিদেশ মন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায় বলেছেন বটে সংসদে যে, আমার ভিসার মেয়াদ বাড়ানো হবে। কিন্তু কোনও না কোনও কারণ দেখিয়ে তো সরকার পারেন তা বাতিল করতে। নিশ্চয়ই পারেন। নিজের দেশই আস্ত আমাকে বাতিল করে দিল। আর ভারতকে যতই নিজের দেশ বলে মনে করি না কেন, কাগজপত্রে এ তো পরের দেশ। পরের দেশ আমার ভিসা বাতিল করার অধিকার তো বেশ ভালোই রাখে। কিন্তু একটা কারণ তো দেখাতে হবে বাতিল করার। কেউ কি বলতে পারবে সত্যি করে কেন বাতিল করা হচ্ছে। ওর বিরুদ্ধে রাস্তায় কিছু ছেলে ছোঁকরা নেমেছিলো বলে ওকে আর ভিসা দেওয়া হবে না। ছেলে ছোরারা দাবি করেছিলো তসলিমাকে দেশ ছাড়া করো! এই তো! ছেলেদের ক’টা দাবি আসলে মেনে নেওয়া হয়। কোনো দিন হয়েছে কি?
স্বপ্নের এমন ভাঙন আর কারও জীবনে কি ঘটে, আমার ছাড়া? না, এ দেশে বড় কোনও আন্দোলন ঘটেনি। আমার জন্য ঘটে না কিছুই। কিছু বড় পত্রিকায় পক্ষে কিছুকলাম লেখা হয়েছে। আর, আমারই বন্ধুরা কলকাতায় পথে নেমেছে বা সভা করেছে। এই।
একজন দেখলাম প্রশ্ন করছে, ‘কোথায় মানবাধিকার রক্ষা করার সব বড় বড় বিপ্লবীরা? কোথায় অরুন্ধতী রায়, রোমিলা থাপার, তিস্তা শীতলবাদি, শাবানা আজমি, রাম পুন্যানি, দিনেশ দিসুজা, বিজু মেথিউ, জন দায়াল। কোথায় সোনিয়া গান্ধি? কোথায় তেহেলকা ম্যাগাজিন। হিন্দু মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে যাওয়া, মুসলিম বা ক্রিশ্চান মৌলবাদীরা অন্যায় করলে মুখ বুজে থাকাটাই এদেশে প্রগতিবাদ, মানবাধিকার রক্ষা, ধর্মনিরপেক্ষতা, এবং সেকুলারিজম’।
আমার বুকে কষ্টের একটা পাথর। পাথরটাকে সরাতে পারি না।
আজ আবদুল গাফফার চৌধুরীর সঙ্গে কথা হল। তাকে বলেছিলাম, বাংলাদেশে ফেরত যেতে চাই, যেন তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সঙ্গে কথাবলেন। আমাকে যেন আমার দেশে থাকার অধিকার তাঁরা দেন। গাফফার চৌধুরী জানালেন, তিনি ফকরুদ্দিনের সঙ্গে কথা বলেছেন, ফকরুদ্দিন নাকি আমার নাম শুনেই ভয় পেয়ে গেছেন। ডঃ কামাল হোসেনের সঙ্গেও নাকি কথা বলেছেন। নাম শুনে তিনিও ভয় পেয়েছেন। আমাকে কেউ সাহায্য করতে রাজি নন। কেউ আমার দেশে ফেরত চান না। বারবারই গাফফার চৌধুরী বললেন, ‘দেশে তোমাকে মেরে ফেলবে। তোমাকে কপি করে যে লোক লেখা শুরু করেছিল, তাকে মেরে ফেললো।’
–কে?
–কেন, হুমায়ুন আজাদ? তোমাকে পায়নি বলে হুমায়ুন আজাদকে মেরেছে। তুমি দেশে থাকলে তোমাকেও ওই একইভাবে মারতো।
আশিষ নন্দীর সঙ্গে কথা হল। তাঁকে এ দেশে পলিটিক্যাল সায়কোলজিস্ট বলে ডাকা হয়। আশিষ নন্দী আমার প্রশ্নর উত্তরে কিছু কথা বললেন, যে, আমাকে, তিনি মনে করেন ভিসা দেবে ভারত সরকার। বললেন, সোনিয়া পছন্দ করেন আমাকে।
–ভ’বাবুও তো স্নেহ করতেন। উনি কি স্নেহ আর এখনও করেন? যদি করেনই, তবে বন্দি কেন করেছেন? একটু মানবিক কি কেউ হতে পারছেন না? একটু বাইরে বেরোতে দেওয়া। একটু মানুষের মতো বাঁচতে দেওয়া।
–হয়তো ভয় পাচ্ছেন।
–কিসের ভয়?
–কিছু যদি হয়ে যায়।
–যদি কিছু তো যে কোনো সময়ই হতে পারতো।
কিছু খটকা থেকে যায়। তারপরও আশিষের আশ্বাস আশীর্বাদের মতো মনে হয়।
.
২০ জানুয়ারি
অরুন্ধতী আর রিতু মেনন ইন্দিরা জয়সিংএর কথা বলেছিলেন। ইন্দিরা জয়সিং খুব বড় মানবাধিকার ল’ইয়ার। এই ল’ইয়ার আমাকে সাহায্য করতে পারে, যদি আদৌ কেউ পারে সাহায্য করতে। মানবাধিকার ল’ইয়ারএর এক কথা, ‘মামলা করো।
–মামলা কার বিরুদ্ধে?
–সরকারের বিরুদ্ধে। আমি সোজা বলে দিলাম, এ আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
–কেন সম্ভব নয়, তুমি মামলা করলেই জিতে যাবে।
ইন্দিরা জয়সিং প্রায়ই ফোন করে আমার সিদ্ধান্ত জানতে চান। অরুন্ধতী আর রিতুরও ওই একই কথা, মামলা করা ছাড়া তোমার আর বেরোবার পথ নেই। কিন্তু আমি রাজি হই না।