নিজের সম্মান না হয় নষ্ট করেছি, অন্যের সম্মান কেন নষ্ট করতে গেলাম। যদিও অন্যের জীবনী আমি লিখছিনা, লিখছি নিজের জীবনী, কিন্তু অন্যের পারিবারিক সামাজিক ইত্যাদি সম্মানহানির বিষয়ে অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন। আমি ঠিক বুঝি না, নিজের মান সম্মানের ব্যাপারে যারা এত সচেতন, তাঁরা এমন কাণ্ড জীবনে ঘটান কেন, যে কাণ্ডে তাঁরা ভালো করে জানেন যে তাঁদের মানের হানি হবে। আমি বিশ্বাসভঙ্গ করেছি? কিন্তু, আমি তো কাউকে প্রতিশ্রুতি দিইনি যে এসব কথা কোনওদিন প্রকাশ করবো না! অলিখিত চুক্তি নাকি থাকে। আসলে এই চুক্তির অজুহাত তাঁরাই তুলছেন, গোপন কথা ফাঁস হয়ে গেলে নিজেদের দেবতা চরিত্রটিতে দাগ পড়বে বলে যাঁরা আশংকা করছেন। আর তাই চোখ রাঙিয়ে শাসিয়ে দিতে চান যে সীমানা লঘন করলে চুক্তিভঙ্গের অপরাধে আমার শাস্তি হবে।
আমি যা প্রকাশ করতে চাই তা যদি আমার কাছে উচিত বলে মনে হয়–তবে? উচিত অনুচিতের সংজ্ঞা কে কাকে শেখাবে? আমার কাছে যদি অশ্লীল মনে না হয় সে কথাটি, যে কথাটি আমি উচ্চারণ করেছি তবে? শ্লীল অশ্লীল হিসেব করার মাতব্বরটি কে? সীমা মেপে দেওয়ার দায়িত্বটি কার? আত্মজীবনীতে আমি কী লিখবো, বা লিখবো না, তার সিদ্ধান্ত তো আমিই নেব! নাকি অন্য কেউ, কোনও মকসুদ আলী, কোনও কেরামত মিয়া বা পরিতোষ বা হরিদাস পাল বলে দেবে কী লিখবো, কতটুকু লিখবো!
সমালোচকরা আমার স্বাধীনতাকে চিহ্নিত করতে চাইছেন স্বেচ্ছাচারিতা বলে। আসলে আমাদের সুরুচি কুরুচি বোধ, পাপ পুণ্য বোধ, সুন্দর অসুন্দর বোধ, সবই যুগ যুগান্ত ধরে পিতৃতন্ত্রের শিক্ষার পরিণাম। নারীর নম্রতা, নতমস্তকতা, সতীত্ব, সৌন্দর্য, সহিষ্ণুতা সেই শিক্ষার ফলেই নারীর বৈশিষ্ট্য হিসেবে স্বীকৃত। আমাদের সুনিয়ন্ত্রিত চেতনা কোনও রূঢ় সত্যের মুখোমুখি হতে তাই আতঙ্ক বোধ করে। কোনও নিষ্ঠুর বাক্য শুনলে কানে আঙুল দিতেইচ্ছে করে, ঘৃণায় ঘিনঘিন করে গা, অনেক সমালোচকেরও বাস্তবে তাই হচ্ছে। আমি লেখক কি না, আমার আত্মজীবনী তাও আবার ধারাবাহিকভাবে লেখার অধিকার আছে কি না, এমন প্রশ্নও তুলেছেন। বস্তুত সবার, যে কোনও মানুষেরই আত্মকথা লেখার অধিকার আছে। এমনকী আত্মম্ভর সেই সাংবাদিকদেরও সেই অধিকার আছে যিনি মনে করেন আমার হাতে কলম থাকাই একটি ঘোর অলুক্ষণে ব্যাপার। আমাকে দোষ দেওয়া হচ্ছে এই বলে যে, আমি চরম দায়িত্বহীনতার কাজ করেছি। আমি দায়িত্বহীন হতে পারি, যুক্তিহীন হতে পারি, তবু কিন্তু আমার অধিকারটি তাগ করতে আমি রাজি নই। জর্জ বার্নার্ড শ বলেছিলেন, A reasonable man adapts himself to the world. An unreasoble man persists in trying to adapt the world to himself. Therefore, all progress depends upon the unreasonable man. বুদ্ধিমান বা যুক্তিবাদী লোকেরা পৃথিবীর সঙ্গে মানিয়ে চলে। নির্বোধ বা যুক্তিহীনরা চেষ্টা করে পৃথিবীকে তার সঙ্গে মানিয়ে চলতে। অতএব সব প্রগতি নির্ভর করে এই যুক্তিহীনদের ওপর। আমি তসলিমা সেই যুক্তিহীনদেরই একজন। আমি তুচ্ছ একজন লেখক, এত বড় দাবি আমি করছি না যে পৃথিবীর প্রগতি আমার ওপর সামান্যতম নির্ভর করে আছে। তবে বিজ্ঞদের বিচারে আমি নির্বোধ বা যুক্তিহীন হতে সানন্দে রাজি। নির্বোধ বলেই পিতৃতন্ত্রের রাঘব বোয়ালরা আমাকে পিষে মারতে আসছে দেখেও দৃঢ় দাঁড়িয়ে থেকেছি। আমার মূর্খতাই, আমার নির্বুদ্ধিতাই, আমার যুক্তিহীনতাই সম্ভবত আমার জীবনের সবচেয়ে বড় সম্পদ।
ধর্মের কথাও উঠেছে। আমি, যারা আমাকে জানেন, জানেন যে, সব ধরনের ধর্মীয় দুঃশাসনের বিরুদ্ধে কথা বলি। ধর্ম তো আগাগোড়াই পুরুষতান্ত্রিক। ধর্মীয় পুরুষ ও পুঁথির অবমাননা করলে সইবে কেন পুরুষতান্ত্রিক ধারক এবং বাহকগণ। ওই মহাপুরুষরাই তো আমাকে দেশছাড়া করেছেন। সত্যের মূল্য আমি আমার জীবন দিয়ে দিয়েছি। আর কত মূল্য আমাকে দিতে হবে।
দাঙ্গার অজুহাত দেখিয়ে পশ্চিমবঙ্গে প্রথম নয়, এর আগে বাংলাদেশেও আমার বই নিষিদ্ধ হয়েছে। এই যে নিরন্তর দাঙ্গা হচ্ছে উপমহাদেশে, আমার বই বা বক্তব্য কিন্তু দাঙ্গার কোনও কারণ নয়। কারণ অন্য। বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচারে, গুজরাতের মুসলমান নিধনে, অসমে বিহারি নিগ্রহে, খ্রিস্টানদের ওপর হামলায়, পাকিস্তানে সিয়া সুন্নি হানাহানিতে আমি আদৌ কোনও ঘটনা নই। অকিঞ্চিৎকর লেখক হলেও আমি মানবতার জন্যই লিখি। ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ নির্বিশেষে সকল মানুষই যে সমান, সকলেরই যে সমান অধিকার মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার, সে কথাটিই হৃদয় দিয়ে লিখি। না, আমার লেখার কারণে দাঙ্গার মতো ভয়াবহ কোনও দুর্ঘটনা কোথাও ঘটে না। যদি কিছু ঘটে, সে আমার জীবনেই ঘটে। আমার লেখার কারণে শাস্তি এক আমাকেই পেতে হয়, অন্য কাউকে নয়। আগুন আমার ঘরেই লাগে। সকল গৃহ হারাতে হয় এক আমাকেই।
চারদিকের এত ভয়ংকর নিন্দার বিরুদ্ধে আনন্দবাজার পাশে দাঁড়ালোআমার। দেশ পত্রিকায় আমাকেই প্রচ্ছদ কাহিনী করা হল। শিবনারায়ণ রায়, আমার, এবং আরও ক’জনের লেখা নিয়ে বেরোলো দেশ। দেশ এর সম্পাদকীয় ছিল অসাধারণ। না স্মরণ করে পারছি না!