পৃথিবীর কত লেখকই তোলিখে গেছেন নিজেদের জীবনের কথা। জীবন থেকে কেবল পরিশুদ্ধ জিনিস ঘেঁকে নিয়ে তারা পরিবেশন করেননি। জীবনে ভ্রান্তি থাকে, ভুল থাকে, জীবনে কালি থাকে, কাঁটা থাকে, কিছুনা কিছু থাকেই, সে যদি মানুষের জীবন হয়। যাদের মহামানব বলে শ্রদ্ধা করা হয়, তাঁদেরও থাকে। ক্রিস্টান ধর্মগুরু অগুস্ত (৩৩৫-৪৩০ খ্রি.) নিজেই লিখে গেছেন তার জীবনকাহিনী, আলজেরিয়ায় তিনি যেভাবে জীবন কাটাতেন, যে রকম অসামাজিক অনৈতিক বাধনহীন জীবন কিছুই প্রকাশ করতে দ্বিধা করেননি। তার যৌন স্বেচ্ছাচারিতা, উচ্ছংখলতা, জারজ সন্তানের জন্ম দেওয়ার কোনও কাহিনীই গোপন করেননি। মহাত্মা গান্ধীও তো স্বীকার করেছেন কী করে তিনি তার বিছানায় মেয়েদের শুইয়ে নিজের ব্রহ্মচারিতার পরীক্ষা করতেন। ফরাসি লেখক জ জ্যাক রুশোর (১৭১২-১৭৭৮ খ্রি.) কথাই ধরি, তার স্বীকারোক্তি গ্রন্থটিতে স্বীকার করে গেছেন জীবনে কী কী করেছেন তিনি। কোনও গোপন কৌটোয় কোনও মন্দ কথা নিজের জন্য তুলে রাখেননি। সেই আমলে রুশোর আদর্শ মেনে নেওয়ার মানসিকতা খুব কম মানুষেরই ছিল। তাতে কী! তিনি তার পরোয়া না করে অকাতরে বর্ণনা করেছেন নিজের কুকীর্তির কাহিনী। মাদমাজোল গতোঁ তো আছেই, আরও অনেক রমণীকে দেখে, এমনকী মাদাম দ্য ওয়ারেন, যাঁকে মা বলে ডাকতেন, তাঁকে দেখেও বলেন যে তার যৌনাকাঙ্ক্ষা জাগতো। বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন (১৭০৯-১৭৯০ খ্রি.) তাঁর আত্মকথায় যৌবনের উতল উন্মাতাল সময়গুলোর বর্ণনা করেছেন, জারজ পুত্র উইলিয়ামকে নিজের সংসারে তুলে এনেছিলেন, তাও বলেছেন। বার্সাণ্ড রাসেল তাঁর জীবনীগ্রন্থে লিখে গেছেন বিভিন্ন রমণীর সঙ্গে তাঁর অবৈধ সম্পর্কের কথা। টিএস এলিয়টের স্ত্রী ভিভিয়ানের সঙ্গে, লেডি অটোলিন মোমেলের সঙ্গে তার সম্পর্কের কথা কে না জানে! লিও তলস্তয় লিখেছেন চৌদ্দ বছর বয়সেই তাঁর গণিকাগমনের কাহিনী, সমাজের নিচুতলার মেয়ে, এমনকী পরস্ত্রীদের সঙ্গে তার যৌন সম্পর্ক, এমনকী তার যৌনরোগে ভোগার কথাও গোপন করেননি। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, কেন তাঁরা, সমাজ যা মেনে নিতে পারে না, এমন তথ্য পাঠককে শোনাতে গেলেন! শোনানোর নিশ্চয়ই কোনও কারণ আছে। নিজেদের আসল পরিচয়টি তারা লুকোতে চাননি অথবা এই অভিজ্ঞতাগুলো তাদের জীবনে খুব গুরুত্বপূর্ণ, তাই শুনিয়েছেন। এতে কি তাঁদের জাত গিয়েছে নাকি তাদের মন্দ বলে কেউ? কেউই তাদের মন্দ বলে না, যে অবস্থানে ছিলেন তাঁরা সে অবস্থানে আছেনই, বরং সত্য প্রকাশ করে নিজেদের আরও মহিমান্বিত করেছেন। পশ্চিমি দেশগুলোয় নারী পুরুষ সম্পর্কটি বহুকাল হল আর আড়াল করার ব্যাপার নয়। হালের ফরাসি মেয়ে ক্যাথারিন মিলে তার নিজের কথাই লিখেছেন La Vie Sexuelle de Catherine M বইটিতে। পুরো বই জুড়ে আছে ষাটের দশকে অবাধ যৌনতার যুগে তার বহু পুরুষ-ভোগের রোমাঞ্চকর কাহিনী। মৈথুনের নিখুঁত বর্ণনা। এ কারণে বইটিকে কি সাহিত্যের বইয়ের তাকে রাখা হয়নি? হয়েছে। গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেও Vivir para contara বইটিতে পরনারীদের সঙ্গে আঁর লীলাখেলার কিছুই বলতে বাদ রাখেননি। মার্কেজকে কি কেউ মন্দ বলবে তাঁর জীবনটির জন্য, নাকি কেউ আদালতে যাবে বইটি নিষিদ্ধ করতে?
পৃথিবীর প্রতিটি দেশেই বিখ্যাত মানুষদের জীবনী প্রকাশ হচ্ছে। বছরের পর বছর ধরে গবেষণা করে সেসব জীবনী লিখছেন জীবনীকাররা। খুঁড়ে খুঁড়ে বের করা হচ্ছে সব গোপন খবর। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গোপন কথাটিও তো রইছে না গোপনে। বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে কথা বলেও তিনি কেন নিজের বালিকা-কন্যাটির বিয়ের আয়োজন করেছিলেন, সেই কারণটি মানুষ আজ জানছে। প্রশ্ন হল, এইসব তথ্য কী আদৌ পাঠকের জানা প্রয়োজন? কে কবে কোথায় কী করেছিলেন, কী বলেছিলেন, জীবনাচরণ ঠিক কেমন ছিল কার, তা জানা যদি নিতান্তই অবান্তর হত, তবে তা নিয়ে গবেষণা হয় কেন? জীবনীকার গবেষকরা যেসব মানুষ সম্পর্কে অজানা তথ্য জানাচ্ছেন, সেসব তথ্যের আলোয় শুধু মানুষটি নন, তাঁর সৃষ্টিরও নতুন করে বিচার ও বিশ্লেষণ সম্ভব হচ্ছে।
বাঙালি পুরুষ লেখকদের অনেকেই গোপনে গোপনে বহু নারীর সঙ্গে শরীরী প্রেমের খেলা খেলতে কুণ্ঠিত নন, নিজেদের জীবনকাহিনীতে সেসব ঘটনা আলগোছে বাদ দিয়ে গেলেও উপন্যাসের চরিত্রদের দিয়ে সেসব ঘটাতে মোটেও সংকোচ বোধ করেন না। কেউ কিন্তু এ নিয়ে প্রশ্ন তোলে না। প্রশ্ন ওঠে, কোনও মেয়ে যদি যৌনতা নিয়ে কথা বলে। সে গল্প উপন্যাসে হোক, সে আত্মজীবনীতে হোক। যৌনতা তো পুরুষের ‘বাপের সম্পত্তি’। আমার তো পুরুষ-লেখকদের মতো লিখলে চলবে না। আমার তো রয়ে সয়ে লিখতে হবে। রেখে ঢেকে লিখতে হবে। কারণ আমি তো নারী। নারীর শরীর, তার নিতম্ব, স্তন, উরু, যোনি এসব নিয়ে খেলা বা লেখার অধিকার তো কেবল পুরুষেরই আছে। নারীর থাকবে কেন? এই অধিকার পুরুষতান্ত্রিক সমাজ আমাকে দেয়নি, দেয়নি বলে তোয়াক্কা না করে আমি যে লিখে ফেলেছি, যত করুণ হোক, যত মর্মান্তিক হোক, আমার সে কাহিনী, আমি যে অনধিকার চর্চা করেছি, তাতেই আপত্তি।
পুরুষের জন্য একাধিক প্রেম বা একাধিক নারীসম্ভোগ চিরকালই গৌরবের ব্যাপার। আর একটি মেয়ে সতোর সঙ্গে কাগজকলমে নিজের প্রেম বা যৌনতা নিয়ে যেই না লিখেছে, অমনি সেই মেয়ে বিশ্বাসঘাতিনী, সেই মেয়ে অসতী, সেই মেয়ে দুশ্চরিত্র। আমার আত্মজীবনীতে আমি এমন কথা বলেছি, যা বলতে নেই। আমি সীমা লঙ্ঘন করেছি, আমি বাড়াবাড়ি করেছি, আমি অশ্লীলতা করেছি, নোংরা কুৎসিত ব্যাপার ঘেঁটেছি। দরজা বন্ধ করে যে ঘটনাগুলো ঘটানো হয়, পারস্পরিক বোঝাঁপড়ায় যে সম্পর্কগুলো হয়, সেসব নাকি বলা অনুচিত। সেসব নাকি বলা জরুরি নয়। কিন্তু আমি তো মনে করি উচিত, আমি তো মনে করি জরুরি। কারণ আমার সংস্কার সংস্কৃতি, ধ্যান, ধারণা, বিশ্বাস অবিশ্বাস নিয়ে আজ এই যে আমি, এই তসলিমার নির্মাণ কাজে জীবনের সেইসব ঘটনা বা দুর্ঘটনাই অন্যতম মৌলিক উপাদান। আমি যে ভূঁইফোড় নই, তিল তিল করে চারপাশের সমাজ নির্মাণ করেছে তিলোত্তমার বিপরীত এই অবাধ্য কন্যার। নিজেকে বোঝার জন্য, আমি মনে করি, জরুরি এই আত্মবিশ্লেষণ।