আউটলুকের শীলা রেড্ডি বললেন, লেখক বুদ্ধিজীবীরা সই দিলেন আমার সমর্থনে। এও জানালেন, বৃন্দা কারাত দিতে চাননি।
ইউনেস্কোর গুডউইল অ্যামবাসাডার মনজিৎ সিং জ্যোতি বসুকে চিঠি লিখেছেন, টাইমস অব ইন্ডিয়ার একটা সম্পাদকীয় আমার লেখা একটি চিঠির সঙ্গে সেঁটে দিয়ে। মদনজিৎ সিংএর তুলনা হয় না। মানুষটার সঙ্গে ভালো করে কোনোদিন কথাও হয়নি, অথচ আমার জন্য কী আশ্চর্য সব কাজ করছেন।
অরুণ মাহেশ্বরী বললেন, তাঁর লেখকরা সব একজোট হয়ে আন্দোলন করছেন।
কলকাতা থেকে কিছু বন্ধু দিল্লিতে এসে অনশনে বসতে চাইছে। সোজা না বলে দিলাম। এসব করে কিছু লাভ হবে না, সে বুঝি। কারণ এই একশ কোটি লোকের দেশে লাখ লোক মিছিল করলে কাজ হয় হয়তো, দু’চারজন লোকের অভিমান বা অনশনের দিকে কেউ তাকায় না।
মন ভালো ছিল, রাতে খারাপ হয়ে গেল। দ্য স্টেটসম্যানে দেখি কলকাতায় বসে লেখা। ‘নির্বাসিত বাহিরে অন্তরে’ এর অনুবাদ ব্যানিসড উইদিন অ্যান্ড উইদাউট’ লেখাটা ছাপা হয়েছে, কিন্তু লেখার শেষে যে তারিখটা উল্লেখ করেছিলাম, সেটা নেই। তারিখ উড়িয়ে দিয়ে ঘটা করে এই বলে ছাপা হল, দিল্লির সরকারের কান্ডকারখানা দেখে বিরক্ত হয়ে লিখেছি। স্টেটসম্যানের কান্ডকারখানা দেখে আমিও বিরক্ত। তারিখ জানালে জানি না ওদের কেন ভয় হয় যে পাঠক লেখা পড়বে না। ইতিহাসের মূল্য কি তবে কিছু নেই? তুই নিষিদ্ধ, তুই কথা কইস না’ বিভিন্ন সময় ধরে আমার প্রকাশিত লেখার একটা সংকলন। সদ্য বেরিয়েছে। উনিশশ তিরানব্বই সালে লেখা প্রথম লেখাটি। শেষ লেখাটি এ বছরের। মাঝখানে বিভিন্ন সময়ে দেশের কথা মনে করে ইওরোপে বসে, অথবাকলকাতায় বেড়াতে এসে লেখা। সাল উল্লেখ না করে প্রকাশক দেখাতে চাইলো, সবই এবছর লেখা। শুধু তাই নয়, ভাবটা এমন, কলকাতা থেকে আমার নির্বাসন হওয়ার পর কেঁদে কেটে লেখাগুলো লিখেছি। ঘটনায় ঘনঘটায় দিল্লিতে ছিটকে পড়েছি, এখান থেকেই পাঠিয়েছি পান্ডুলিপি। এসব কি পাঠক ঠকানো ছাড়া অন্য কিছু? এই অসততা আমি একেবারে সইতে পারি না।
আকাশে বড় একটা গোল চাঁদ। আজ হয়তো পূর্ণিমা। পূর্ণিমা হলেই বা কী! আমি কি পূর্ণিমায় ভিজে ভিজে কোথাও কারও সঙ্গে খোলা মাঠে গান গাইতে পারবোআর। জানালা দিয়েও আনমনে চাঁদ দেখা যায়। কতদিন পর চাঁদের মুখ! আমিও চাঁদের মতো খুব একা। চারদিক ঘোর কালো আঁধার। আমি আর চাঁদ শুধু জেগে থাকি, একা একা।
.
২৫ ডিসেম্বর
সেই বাড়িটায় নিয়ে যাওয়া হল আমাকে নিয়ে আসা হল সুয়েনসনকে, নিয়ে আসা হল অশেষ আর মুনাকে। অশেষ আর মুনা এসেছে কলকাতা থেকে আমার সঙ্গে দেখা করতে। একটা ছোট সুটকেসে ভরে কলকাতার বাড়ি থেকে কিছু জরুরি জিনিসপত্র নিয়ে এসেছে। যেহেতু যেখানে আছি, সেখানে কারও আসার নিয়ম নেই, তৃতীয় জায়গায় দেখা করে সুটকেসটি নেওয়ার ব্যবস্থা করে দিলেন প্রভু। ওদেরকে হোটেল থেকে তুলে এ গলি ও গলি ঘুরিয়ে গোলক ধাঁধার মধ্যে ফেলে নিয়ে আসা হয়েছে। সবাইকেই তাই করা হয়, যাদেরকে এই গোপন জায়গাটিতে এ পর্যন্ত আনা হয়েছে। সুটকেসের ঘটনা আছে বলেই অশেষ আর মুনার সঙ্গে দেখা হতে পারলো। অবশ্য কোনো ঘটনাই ঘটনা নয়, প্রভু যাঁর সঙ্গে লিয়াজোঁ রাখছেন, তিনি সম্মতি দিলেই তবে দেখা হওয়ার ব্যবস্থা করতে পারেন প্রভু। প্রভু একা কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার মালিক নন, হলে তিনি আমাকে অনেক আগেই কলকাতা পাঠিয়ে দিতেন।
সুয়েনসনের জন্য একটা ঝাউ গাছ, গাছ সাজানোর যাবতীয় জিনিস সবই ভারত সরকারের দান। দুপুরে বিশাল খানাপিনা। সেও সরকার। খাওয়ার পর চকলেট কেক। সেটাও। এমনকী সুয়েনসনকে যে একটাবই উপহার দিলাম, সেটাও। আমি বলিনি এসবের ব্যবস্থা করতে, শুধু বলেছিলাম সুয়েনসন নিশ্চয়ই বড় দিনটা কাটাতে চায় আমার সঙ্গে। সুয়েনসন নাস্তিক লোক। কিন্তু নাস্তিক হয়েই বড় দিনের উৎসবটা দেখেছি ঠিকই করে। অযৌক্তিক গাছ সাজানো আর পরস্পরকে এটা সেটা উপহার দেওয়া ধার্মিক উৎসবের চেয়েও বড় সামাজিক উৎসব।
অশেষরা একসময় চলে গেল। ট্রেন ধরবে কলকাতা ফেরার। ওদের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকি। আমারও তো ঘর ওই শহরে। কেবল আমারই ফেরার কোনও উপায় নেই। আর সবাই, গাধা ঘোড়া গরু মোষ, চোর ডাকাত খুনী সন্ত্রাসী কলকাতা শহরে ফিরতে পারে, কেবল আমি পারি না।
সারাদিনে বড়দিনের উপহার এল টেলিভিশনে। কলকাতা থেকে এক বন্ধু ফোনে বললো যে জ্যোতি বসু আমাকে বলেছেন কলকাতায় স্বাগতম। টেলিভিশনের সব চ্যানেলগুলোই দেখাচ্ছে জ্যোতি বসুর কথা। স্বাগত আমাকে জানিয়েছেন বটে তিনি, তবে জানানোর পরই বলে দিয়েছেন আমার নিরাপত্তার দায়িত্ব কেন্দ্রের। তাহলে তো কমিউনিস্ট নেতা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, বিমান বসু, সিতারাম ইয়েচুরির কথার মতোই কথা হল অনেকটা। ওঁরাও মাঝে মাঝে বলছেন, নিরাপত্তার দায়িত্ব কেন্দ্রকে নিতে হবে। তবে জ্যোতি বসুর মুখে ওই ‘স্বাগতম’ শব্দটি, শুনেছি মেয়েটার মন খারাপ’ বাক্যদুটো আমার মন ছুঁয়ে যায়। জানি যে এর পরের কথাগুলো খুব রাজনৈতিক, কেন্দ্রের কাঁধে দায়িত্ব দেওয়া। দ্বিখন্ডিত বইয়ে যা লিখেছি তা লেখা আমার উচিত হয়নি, এ লেখা কোনও মুসলমান মানতে পারবে না। জ্যোতি বসু বললেন। এসব কী কোনও নাস্তিকের মুখে মানায়! নাকি হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ইহুদিদেরই নাস্তিক হওয়া মানায়, তাদেরই অধিকার আছে ধর্ম নিয়ে সমালোচনা করার, মুসলমানের নেই, কারণ মুসলমান মৌলবাদীরা তা সইতে পারে না বলে? পিছিয়ে পড়া একটি অন্ধকার সমাজকে কেবল সংস্কার দিয়ে আলোকিত করা যায় না, আঘাত দিয়ে আগে সজাগ করতে হয়। সজাগ না হলে অন্ধকারে যে ডুবে আছে, তা কী করে টের পাবে। আর সত্যি কথা বলতে কী, মুসলমান সমাজকে আলোকিত করার উদ্দেশ্যে আমি কোনও লেখালেখি করি না। লিখি মনের কথা, বিশ্বাসের কথা। লিখতে গিয়ে কোনও সম্প্রদায় বা কোনও লিঙ্গ ভাবনা আমাকে আঁকড়ে ধরে না। মানুষকে মানুষ হিসেবেই দেখি আমি, সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে মানুষকে ভাগ করি না। নিজে ধর্মমুক্ত, সম্প্রদায়মুক্ত, সংস্কারমুক্ত হলেই সবাইকে সমান চোখে দেখা সম্ভব।