সম্ভবত বরখা দত্ত আর করন থাপর-এর কাছে শুনেছে আমি ওদের ফোন করেছিলাম। হা করেছিলাম। করেছিলাম জানার জন্য কী হচ্ছে আমাকে নিয়ে। সরকারি লোক যেদিন আমাকে জানিয়ে দিয়েছে যে কিছুই সম্ভব হবে না, না কলকাতা যাওয়া, না দিল্লিতে স্বাভাবিক জীবন যাপন করা, না বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করা, আউট অব সাইট হতে হবে, দেশ ছাড়তে হবে –আমার পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গিয়েছিল, আকাশ টুকরো হয়ে গিয়েছিল, জগৎ চুপসে গিয়েছিলো। এত বড় শক্তির সঙ্গে আমার মতো তুচ্ছ প্রাণীর তো পেরে ওঠার কথা নয়। বিদেশের জগৎটা আমার দেখা, সেই জগতে আমি আর যেতে চাই না। বাংলাদেশ নেই, ভারতই ছিল একমাত্র, আর এই ভারতই কি না দুলে উঠছে, কেঁপে উঠছে, সরে যাচ্ছে আমার নাগাল থেকে তখনই করন থাপর আর বরখা দত্তকে ফোন করেছিলাম জানতে, যেহেতু তারা রাজনীতি ভালো বোঝেন, কী হচ্ছে যা হচ্ছে, যা হচ্ছে। তা কেনই বা হচ্ছে, আমি থাকলে দশটা লোকের মৃত্যু হবে এ দেশে, এসব কথা এত জোর দিয়ে বলছেন কেন, যাঁরাই বলছেন!
টেলিভিশনের জন্য সাক্ষাঙ্কার চেয়েছিলেন করণ থাপর। দিইনি। বলেছি, সরকারের লোকেরা এমন সব দুর্বোধ্য কথা বলছেন, আপনি কি অনুগ্রহ করে মনমোহন সিং বা সোনিয়া গান্ধির সঙ্গে একটু কথা বলবেন। একটু দেখবেন, কী ওঁরা চাইছেন। করণ থাপর বললেন, তিনি জানতে চাইলে কেউ তাঁকে কিছু জানাবেন না। তিনি কথা বললে কেউ শুনবেনও না।
তারপর সন্ধেবেলায় সিএনএন জানালো সেদিন নাকি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে একটা মিটিং হয়েছে সেক্রেটারি এবং আইবির মধ্যে, আমার ব্যাপারে বলা হয়েছে হয় দিল্লি থাকতে হবে যেভাবে আছে সেভাবে নয়তো চলে যেতে হবে দেশ ছেড়ে। আমি চূর্ণ হয়ে গেছি, আমি আর আমি নেই। প্রতিক্রিয়া চাইলে বললাম আমাকে যা যা বলে গেছে সরকারি লোক। এও বললাম, আমাকে একরকম গৃহবন্দি করা হয়েছে।
বীর সাংভির রাগ, কেন আমি জানিয়েছি আমি গৃহবন্দি অবস্থায় আছি। একই সঙ্গে নাকি ছ’টা এক্সকুসিভ দিচ্ছি। বাথরুমে যাওয়ার টাইম নেই। ফরেনার হয়ে নিরাপত্তা পাচ্ছি। কী দরকার আমাকে এত খাতির করার। এত টাকা পয়সা আমার মতো খারাপ লেখকের পেছনে খরচ করার। খারাপ লেখক আমি, তাবীর সাংভি জেনেছেন আমার বই পড়ে নয়, কলকাতার কেউ নাকি বলেছেন। অবশ্য কে বলেছেন তা তিনি বলেননি। এদিকে সরকারি অফিসাররা নাকি বলছেন, তাঁদের কাছে আশ্রয় চাইছি, তারপর দৌড়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে তাঁদের বিরুদ্ধে বলছি। বীর সাংভির প্রশ্ন, বিরুদ্ধে কেন বলবো ফরেনার হয়ে! আমি নাকি হেডলাইন হয়েছি নানারকম কান্ড করে। মনে মনে বলি, কান্ড কি আমি করলাম? আমি তো আমার মতো কলকাতায় আমার ফ্ল্যাটখানায় লেখাপড়া করছিলাম, কারও পাকা ধানে মই দিইনি। তোদের সরকারই তো তাড়ালো, আমাকে হেডলাইন বানালো। তোদের সরকারই তো আমাকে আটকে রেখেছে ঘরে, বেরোতে দিচ্ছে না, কাউকে আসতে দিচ্ছে না আমার কাছে। হেডলাইন তো তোরা বানাস। রাজনৈতিক অত্যাচার আমার ওপর করে আমাকে হেডলাইন তো তোরা করিস বাপু। আমাকে তোরা তোদের ধর্ম আর রাজনীতির শিকার বানিয়েছিস। তোরা তো তোদের শিকারকে হেডলাইন করছিস। ভিকটিম তো ভিকটিম হতে চায়নি। ভিকটিম মাথা উঁচু করে বাঁচতে চেয়েছিল। কবে কোন পাঁচ বছর আগে সে কী লিখেছিল, তা নিষিদ্ধ করে তোরাই তো হেডলাইন বানালি তাকে। হাইকোর্ট সেই লেখা যে নিষিদ্ধ হওয়ার মতো নয় তা দুনিয়াকে জানিয়ে বইটাকে মুক্তি দিয়ে তো আবারও হেডলাইন করলো তাকে। তারপর তোদের ধর্মবাদীরা তো আবার সেই লেখার ওপর হামলে পড়লো, তোদের অধর্মবাদীরাও ধর্মবাদীদের খুশি করতে বেচারা আমার ওপর ঝপালো। তোদের ঝপাঝাপি, তোদের তান্ডব নেত্য তো আমাকে বারবার ‘হেডলাইন’ করছে। পাঠক নির্বিঘ্নে পড়ছিল আমার বই। বই তো বছরের পর বছর ছিল বইয়ের বাজারে। কেউ তো কিছু বলেনি। তোরা গন্ডগোল করবি, আর দোষ দিবি আমাকে। তোরাই রাগ দেখিয়ে বলবি, ফরেনার হয়ে অত বাড় বেড়েছে কেন, অত হেডলাইন হওয়া কেন!
সারাদিন মন খারাপ ছিল।
সন্ধের দিকে এক বন্ধু বললো, বীর সাংভিকে নাকি ভ’বাবু ওই লেখাটি লিখতে বলেছিলেন। আরও কিছু সম্পাদক এবং সাংবাদিককেও নাকি বলেছেন, আমার নামটি কোথাও তিনি ছাপার অক্ষরে দেখতে চান না।
মানুষ যে কেন ধর্মীয় মৌলবাদীদের দোষ দেয়! ওদের যত না দোষ, তার চেয়ে বেশি দোষ এইসব রাজনীতিক, সাংবাদিক, লেখক, বুদ্ধিজীবী যাঁরা মৌলবাদী দ্বারা আক্রান্তদের অনুভূতির আঘাতের দিকে ফিরে তাকান না, কিন্তু আক্রমণকারী মৌলবাদীদের অনুভূতির আঘাত নিয়ে ভীষণ উদ্বিগ্ন, এবং সহানুভূতিশীল।
.
২৪ ডিসেম্বর
সুয়েনসনের সঙ্গে দেখা করতে চাইলাম। নাকচ হল অনুরোধ। ওকে আমার হিন্দি প্রকাশক অরুণ মাহেশ্বরীর কাছে চলে যেতে বললাম। আমার প্রকাশকই নিলেন ওর দেখাশোনার ভার।
আর এদিকে আমি। মন খারাপের আমি। অবশ্য আজ একটু একটু করে মন ভালো হল ক’টি ফোন পেয়ে। কলকাতা থেকে বিভুতিভূষণ নন্দী, সুনন্দ সান্যাল, দেবব্রত বন্দোপাধ্যায় ফোন করে সহানুভূতি প্রকাশ করলেন। একজন তো বললেন, নেলসন ম্যান্ডেলার কথা ভাবতে। ম্যাণ্ডেলা দু’যুগেরও বেশি ছিলেন জেলে। এই অবস্থা আমার থাকবে না দীর্ঘদিন, এরকমই আশ্বাস দিলেন সকলে। লিখতে বললেন। লেখার চেয়ে বড় আশ্রয় আমার আর কোথাও নেই, বললেন। আমি কী আর বুঝি না! লিখতে গেলে জানিনা কী এসে আমাকে উদাস করে দেয়। তাকিয়ে থাকি জানালার ওপারে, দীর্ঘশ্বাস আমাকে ডুবিয়ে নিতে থাকে।