চারদিক থেকে এখন বিদ্রুপের তির ছোঁড়া হচ্ছে আমাকে লক্ষ্য করে, অপমান আর অপবাদের কাদায় আমাকে ডুবিয়ে দেওয়া হচ্ছে এর কারণ একটিই, আমি সত্য কথা বলেছি। সত্য সবসময় সবার সয় না। আমার মেয়েবেলা’ আর ‘উতল হাওয়া’র সত্য সইলেও দ্বিখণ্ডিত’র সত্য সবার সইছে না। আমার মেয়েবেলায় আমাকে অপদস্থ করার কাহিনী যখন বর্ণনা করেছি, সেটি পড়ে লোকে চুকচুক করে দুঃখ করেছে আমার জন্য, উতল হাওয়ায় যখন স্বামী দ্বারা প্রতারিত হয়েছি, তখনও আহা আহা করেছে আমার জন্য, আর দ্বিখণ্ডিত’য় যখন বর্ণনা করেছি পর পর একের অধিক পুরুষের সঙ্গে আমার। সম্পর্কের কথা, তখন ছিঃ ছিঃ করতে শুরু করেছে। এর অর্থ তো একটিই, যে, যতক্ষণ একটি মেয়ে অত্যাচারিত এবং অসহায়, যখনই সে দুর্বল, এবং যখন তার দুঃসময়, ততক্ষণই তার জন্য মায়া জাগে, ততক্ষণই তাকে ভালো লাগে। আর যখনই মেয়েটি আর অসহায় নয়, যখনই সে মেরুদণ্ড শক্ত করে দাঁড়ায়, নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা করে,নিজের শরীরের এবং মনের স্বাধীনতার জন্য সমাজের নষ্ট নিয়মগুলো ভাঙে, তখন তাকে আর ভালো লাগে না, বরং তার প্রতি ঘৃণা জন্মে। আমাদের সমাজের এই চরিত্র আমি জানি, জেনেও কোনও দ্বিধা করিনি নিজেকে জানাতে।
দ্বিখণ্ডিত বইটি নিয়ে বিতর্কের একটি বড় কারণ, যৌন স্বাধীনতা। আমাদের এই সমাজের বেশির ভাগ মানুষ যেহেতু পুরুষতান্ত্রিক সংস্কারে আকণ্ঠ নিমজ্জিত, তাই একজন। নারীর যৌন স্বাধীনতার অকপট ঘোষণায় বিরক্ত, ক্ষুব্ধ, ক্রুদ্ধ। যে যৌন স্বাধীনতার কথা আমি বলি, তা কেবল আমার বিশ্বাসের কথাই নয়, নিজের জীবন দিয়ে সেই স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করেছি, অথচ যে-কোনও পুরুষ আমাকে কামনা করলেই পাবে না। এই সমাজ এখনও কোনও নারীর এমন স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত নয়। প্রস্তুত নয় এটা শিরোধার্য করতে যে, কোনও নারী তার ইচ্ছেমতো পুরুষকে সম্ভোগ করতে পারে এবং তা করেও কঠোরভাবে যৌন-সতীত্ব বজায় রাখতে পারে।
আমাদের নামি-দামি পুরুষ লেখকেরা আমাকে এখন মহানন্দে পতিতা বলে গালি দিচ্ছেন। গালি দিয়ে নিজেরাই প্রমাণ করছেন কী ভীষণ নোংরা পিতৃতান্ত্রিক সমাজের সুবিধেভোগী পুরুষ-কর্তা তাঁরা। পতিতাকে তাঁরা ভোগের জন্য ব্যবহার করেন, আবার পতিতা শব্দটিকে তারা সময় সুযোগমতো গালি হিসেবেও ব্যবহার করেন। নারীকে যৌনদাসী হিসেবে ব্যবহার করার নিয়ম আজকের নয়। যদিও দ্বিখণ্ডিত বইটিতে পুরুষতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে আমার লড়াইএর কথা বলেছি, বলেছি নারী আর ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর সমাজের নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের কথা, কেউ কিন্তু সে নিয়ে একটি কথাও বলছেন না, যারাই বলছেন, বলছেন যৌনতার কথা। আমার কোনও কষ্টের দিকে, কান্নার দিকে কারও চোখ গেল না, চোখ গেল শুধু যৌনতার দিকে। চোখ গেল আমার সঙ্গে পুরুষের সম্পর্কগুলোর দিকে। যৌনতার মতো গভীর গোপন কুৎসিত আর কদর্য বিষয় নিয়ে আমার মুখ খোলার স্পর্ধার দিকে চোখ।
পৃথিবীর ইতিহাসে, কোনো অন্ধকার সমাজে যখনই কোনও নারী পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে উঠেছে, নিজের স্বাধীনতার কথা বলেছে, ভাঙতে চেয়েছে পরাধীনতার শেকল, তাকেই গাল দেওয়া হয়েছে পতিতা বলে। অনেক আগে নষ্ট মেয়ের নষ্ট গদ্য বইটর ভূমিকায় আমি লিখেছিলাম, নিজেকে এই সমাজের চোখে আমি নষ্ট বলতে ভালোবাসি। কারণ এ কথা সত্য যে, যদি কোনো নারী নিজের দুঃখ দুর্দশা মোচন করতে চায়, যদি কোনও নারী কোনও ধর্ম, সমাজ ও রাষ্ট্রের নোংরানিয়মের বিপক্ষে রুখে দাঁড়ায়, তাকে অবদমনের সকল পদ্ধতির প্রতিবাদ করে, যদি কোনও নারী নিজের অধিকার সম্পর্কে সজাগ হয়, তবে তাকে নষ্ট বলে সমাজের ভদ্রলোকেরা। নারীর শুদ্ধ হওয়ার প্রথম শর্ত নষ্ট হওয়া। নষ্ট না হলে এই সমাজের নাগপাশ থেকে কোনও নারীর মুক্তি নেই। সেই নারী সত্যিকার সুস্থ ও শুদ্ধ মানুষ, লোকে যাকে নষ্ট বলে। আজও এ কথা আমি বিশ্বাস করি যে, কোনও নারী যদি তার সত্যিকার স্বাধীনতা অর্জন করতে চায়, তবে এই সমাজের চোখে তাকে নষ্ট হতে হয়। এই নষ্ট সমাজ থেকে নষ্ট বা পতিতা আখ্যা উপহার পাওয়া একজন নারীর জন্য কম সৌভাগ্যের ব্যাপার নয়। এ যাবৎ যত পুরস্কার আমি পেয়েছি, পতিতা উপাধির পুরস্কারটিকেই আমি সর্বোত্তম বলে বিচার করছি। পুরুষতন্ত্রের নষ্টামির শরীরে সত্যিকার আঘাত করতে পেরেছি বলেই এই উপাধিটি আমি অর্জন করেছি। এ আমার লেখকজীবনের, আমার নারীজীবনের, আমার দীর্ঘকালের সংগ্রামের সার্থকতা।
বইটি লিখেছি বলে বাংলাদেশের একজন লেখক আমার বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করেছেন, কলকাতাতেও একজন বাংলাদেশি লেখকটির পদাঙ্ক অনুসরণ করেছেন। কেবল মানহানির মামলা করেই ক্ষান্ত হননি, দুজনই আমার বইটি নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়েছেন। আমি ঠিক বুঝি না, কী করে একজন লেখক আর একজন লেখকের বই। নিষিদ্ধ করার দাবি করতে পারেন। কী করে সমাজের সেই শ্রেণীর মানুষ, যাঁদের দায়িত্ব মুক্তচিন্তা আর বাক স্বাধীনতার জন্য লড়াই করা, মৌলবাদীদের মতো আচরণ করেন। আমাকে নিয়ে এ যাবৎ অনেক মিথ্যে, অনেক কল্পকাহিনী লেখা হয়েছে, আমি তো তাদের কোনও লেখা নিষিদ্ধ করার দাবি নিয়ে আদালতে দৌড়ইনি। আমি বিশ্বাস করি, এভলিন বিয়াট্রিস হল যা বলেছিলেন, ”I disapprove of what you say, but I will defend to the death your right to say it” –আমি তোমার মতের সঙ্গে একমত না হতে পারি, কিন্তু আমি আমৃত্যু তোমার কথা বলার অধিকারের জন্য লড়ে যাবো। কেন আমাদের বিদগ্ধ লেখকগণ বাক-স্বাধীনতার পক্ষে এই চরম সত্যটি অস্বীকার করতে চান!