দুপুরের খাওয়ার ব্যবস্থা প্রভুই করলেন ও বাড়িতে। বাড়িটাতে কেউ থাকে না। খুব নির্জন নিঝুম বাড়ি। সরকারি বাড়ি, হঠাৎ হঠাৎ কোনও গোপন দেখা সাক্ষাৎএর জন্য ব্যবহার হয়, বিশাল টেবিল জুড়ে নানারকম খাবার এমন সাজিয়ে দেওয়া হয় যে কেউ বুঝতেই পারবে না সবই বাইরে থেকে কিনে আনা, ঘরের রান্না নয়। বাড়িটা সম্পর্কে খুব বেশি কিছু আমি জানি না, কারণ আমার কৌতূহলের কোনও জবাব প্রভু কখনও দেন না।
বিকেলে জীবনের দুর্ভোগের কথা ভাবতে ভাবতে কেঁপে কান্না এলো৷ কান্না রাতে ঘুমোবার আগ অবধি থামেনি।
.
১৮ ডিসেম্বর
আজ ঘুম ভালো হয়নি। জেগে গেছি শেষ রাতে। ইন্টারনেটে খবর দেখতে গিয়ে দেখি গ্লোরিয়া স্টাইনেম কলকাতায়। আমার সম্পর্কে বলছেন। দিজ ইজ অ্যান আউটরেজাস ভায়োলেশন অব হার হিউমেন রাইটস। শি হ্যাঁজ এ রাইট টু বি সেইফ”। আমি যে দ্বিখন্ডিত থেকে তুলে নিয়েছি অংশ, সে নিয়ে গ্লোরিয়া বলেছেন, একজন লেখক যখন নিজের ইচ্ছেয় তার লেখা কাটে সে এক ব্যাপার, আর যখন সে কাটতে বাধ্য হয়, সেটা অন্য ব্যাপার। কী সহজ ভাষায় গ্লোরিয়া বলতে পারেন সত্য! চিন্তার খোরাক জোটাতে সবসময়ই তিনি পারেন। বলেছেন তার মেজ ম্যাগাজিনে লিখেছেন আমাকে নিয়ে, আমার লেখাও ছেপেছেন। দেখা হয়েছিল দিল্লিতে সাউথ এশিয়ান লেখক সম্মেলনে, বলেছেন। গ্লোরিয়াকে নিয়েও তো আমি কত লিখেছি। আজ যদি কলকাতায় সেই জীবন আমার থাকতো, গ্লোরিয়াকে আমার বাড়িতে নিয়ে যেতাম। তাঁর সান্নিধ্য পেতে পারতাম। তাঁর উপস্থিতির উৎসব করতাম।
ষাট-সত্তর দশকের জগৎ কাঁপানো নারীবাদী লেখিকা গ্লোরিয়া। সেই ষাট দশকে যা ভাবতেন, যা বলতেন, গ্লোরিয়ার কোনও বই বা লেখানা পড়েও আশির দশকে আমি একই যন্ত্রণা অনুভব করেছি, একই ভাষায় প্রতিবাদ করেছি, একই যুক্তি ব্যবহার করেছি, একই কথা ভেবেছি আর বলেছি।
.
১৯ ডিসেম্বর
আমন্ত্রণ জুটলো লেখক খুশবন্ত সিংএর সঙ্গে দেখা করার। ওঁর বাড়িতে আমাকে যেতে হবে শনিবার সন্ধ্যে সাতটায়। পেশ করেছি আবেদনটি। খুশবন্ত সিংএর নাম ঠিকানা ফোন নম্বর লিখে প্রভুর হাতে দিয়েছি। উনি যথাস্থানে জানিয়েছিলেন। কিন্তু নাকচ হয়ে গেছে আবেদন। কমিউনিস্ট পার্টির বৃন্দা কারাতের সঙ্গেও একবার দেখা করার দিন তারিখ ঠিক করেছিলাম, সেটিও নাকচ।
বৃন্দা কারাতের সঙ্গে ফোনে যেদিন প্রথম কথা হল, বললেন, তোমাকে পশ্চিমবঙ্গে ফেরত নেওয়া সম্পূর্ণ কেন্দ্র’র হাতে, রাজ্যের হাতে নয়। ভীষণ ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। নানা লোকেনানাকথা বলে, কোনটাকে বিশ্বাস করবো, কোনটাকে করবোনা, বুঝতে পারি না। সবার কথাই বিশ্বাস হয়। কেউ মিথ্যে বলতে পারে, কেউ বানিয়ে অযথা কিছু বলতে পারে, আমার বিশ্বাস হতে চায় না। এত মিথ্যে শুনেও, এত ঠকেও বুদ্ধি বাড়ে না আমার। আমি রাজ্য, কেন্দ্র বুঝি না। মারপাঁচ বুঝি না। খুব সরল সোজা সত্য কথা বুঝি। বুঝি যে আমি কোনো অন্যায় করিনি। বুঝি যে শাস্তি আমি পাচ্ছি, তা পাওয়া আমার উচিত নয়।
সময় যাচ্ছে। বুঝি যে যাচ্ছে। আগে সাংবাদিকরা পাগল হয়ে যেতো কী করছি, কেমন আছি, কী ভাবছি জানার জন্য। এখন তেমন কেউ পাগল নয়। ফোন বাজে না আগের মতো। অবশ্য ফোন যখন ঘন ঘন বাজতো, আমি তো ফোনই ধরিনি। সাংবাদিকদের। এড়িয়ে চলেছি, কাউকে সাক্ষাৎকার দিইনি, কারও সঙ্গেই কথা বলিনি। প্রভু বারবারই সাংবাদিক মহল সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়েছেন। এরা সব লোভী, যা করে টাকার জন্য বা নামের জন্য। এরা কাজ ফুরোলে চলে যাবে। তুমি মরলে কী বাঁচলে তার দিকে ফিরেও তাকাবে না। প্রভু যে সবসময় খুব ভুল বলেন, তা নয়।
গ্লোরিয়া স্টাইনেমের একটা ইমেইল পেলাম। লিখেছেন, ”প্লিজ প্লিজ টেল মি ইফ আই ক্যান ডু এনিথিং –অ্যান্ড ইউ অলওয়েজ হ্যাঁভ এ রুম উইথ মি ইন নিউইয়র্ক। বিষণ্ণ মন মুহূর্তে ভালো হয়ে যায়। কিছু ভালো মানুষ এখনও বাস করে বলে পৃথিবীটা এখনও সুন্দর। এত বাধা, এত নিষেধ, এত অনাচার, অবিচার –কিন্তু তারপরও বাঁচতে ইচ্ছে করে।
আজ ঘটলো সেই ঘটনাটি, যেটি ঘটা উচিত নয় এই দেশে। এই দেশ তো গণতন্ত্র। গণতন্ত্র মানেই তো সবার বাক স্বাধীনতা থাকবে এ দেশে। এই দেশ হৃদয়ে অনেক বড়, এমনই তো জানি। বড় এক মন্ত্রণালয়ের বড় এক অফিসার এসেছিলেন। কী পদে আছেন, বললেন না। জানি না কী কারণে নামটা বললেন। ধরা যাক নাম তার সনাতন সেনগুপ্ত। এও অনেকটা প্রভুর মতো, নাম বলেন, কোথায় চাকরি করছেন, কী করছেন, বলেন না। আমার কাছে লুকোনোর কী কারণ থাকতে পারে, জানি না। অনুমান করি ভ’বাবুই তাঁকে পাঠিয়েছেন। কী বলতে এসেছেন তিনি? নতুন কিছু নয়, অনেকটা সে কথাই বলতে এসেছেন যে কথা প্রসূন মুখার্জি কলকাতায় বলেছেন।
স–আপনি চলে যান।
ত–কোথায় যাবো?
স–ভারত ছাড়ুন।
ত–কেন?
স–আপনি কেন আছেন এ দেশে? কলকাতায় যাওয়ার জন্য তো! ওই অপেক্ষাই তো করছেন? তাই না?
ত–হা করছি। ওখানে আমার বাড়িঘর। আমার সব কিছু। আমার বইপত্র, কাপড়চোপড়।
স–কিন্তু আপনার কলকাতায় যাওয়া চলবে না।
ত–কেন চলবে না?
স–ওখানে আপনাকে মেরে ফেলবে। তার চেয়েও বড় কথা আমাদের লোকদের জীবন বাঁচাতে হবে।
ত–আমাদের লোকদেরও জীবন বাঁচাতে হবে, মানে? স মানে হল, আপনার কারণে মানুষ মরবে এ দেশে।