.
১৫ ডিসেম্বর
সকালে আমাকে নিয়ে যাওয়া হয় এক নিরাপদ বাড়ি থেকে আরেক নিরাপদ বাড়িতে, সেখানে রক্ত নেওয়ার একটা লোককে ধরে আনা হয়েছে। রক্ত নিল লোক। কাগজে আমার নাম লেখা হল, মিকু শ্রীবাস্তব।
.
১৬ ডিসেম্বর
দিন যেভাবে কাটে, সেভাবেই কাটছে। মৃত কচ্ছপ পড়ে আছে। দিন বলে ডাকি তাকে।
আজ বাংলাদেশে বিজয় দিবস। বাঙালির বাংলা ভাষাকে বাঁচানোর আন্দোলন বড় হতে হতে যুদ্ধে গিয়ে থামে। আজ এই দিনটিতে আমি বাংলার এক মেয়ে, বাংলা ভাষার লেখক, বন্দি। বিজয় বলতে কিছু নেই আমার। আইন ও সালিশ কেন্দ্রর হামিদা হোসেন বাংলাদেশে আমার চরম দুঃসময়ে পাশে ছিলেন, তাঁকে লিখেছিলাম অনেক বছর কোনও যোগাযোগ নেই। আশা করি ভালো আছেন। আমার জীবনের দুর্ভোগ তো আজও কমলো না। দেশে ফিরতে তো সবসময় চাই। এখন কি ফিরতে পারবো দেশে? যদি মামলাগুলো তুলে নেওয়া হয়, সরকার আমাকে ফিরতে বাধা না দেয়, নিরাপত্তা দেয় তবে তো ফিরতে পারি, সেটা কি সম্ভব হবে? আপনি যদি আমাকে সাহায্য করেন ফেরার ব্যাপারে, কৃতজ্ঞ থাকবো।
এর উত্তরে উনি লিখেছেন, .. ‘তোমার ভুলে গেলে চলবে না যে তোমার বিরুদ্ধে কোনও মামলা যদি নাও থাকে, কিছু লোক তো আছেই তারা তোমার বিরুদ্ধে রাস্তায় নামবে নিজেদের সুবিধে আদায় করতে। তুমি নিশ্চয়ই প্রথম আলো’র কার্টুনিস্টএর কথা শুনেছো। ও এখন জেলে। ওর জামিনের জন্য চেষ্টা চলছে। দেখা যাক কী হয়। আসলে আমাদের সেই স্বাধীনতা এখনও নেই, যে স্বাধীনতা যা বলতে চাই আমাকে তা বলতে দেবে। আমার মনে হয় ধর্মকে রাজনীতিতে ব্যবহার করাটা এখন আমাদের সংস্কৃতির অঙ্গ হয়ে গেছে। লেখক সাংবাদিকদের সতর্ক থাকতে হয়। সাংস্কৃতিক আর রাজনৈতিক দিক থেকে তো মনে হচ্ছে আমরা আরও বেশি সংকীর্ণ হয়েছি।
আরিফুর রহমানের কথা জানি, বেচারা কার্টুনিস্ট জেলে বসে আছে। কী অপরাধ ছিল তার! প্রথম আলোর কার্টুন ম্যাগাজিন আলপিনে কার্টুন এঁকেছিল। গ্রামের এক মোল্লা, বেড়াল কোলে নিয়ে হেঁটে বেড়ানো এক গরিব বাচ্চা ছেলেকে ডেকে জিজ্ঞেস করলো, ‘এই তোর নাম কী?’ ছেলে বললো, ‘বাবু।‘ মোল্লা ধমক দিয়ে বললো, ‘নামের আগে মোহাম্মদ বলতে হয় জানিস না?’ ছেলে ভয়ে বিস্ময়ে কুঁকড়ে গেল। এর পর আবার মোল্লার জিজ্ঞাসা, ‘তোর বাবার নাম কী?’ ছেলে বললো, ‘মোহাম্মদ আবু’। মোল্লা খুশি হল। এবার জিজ্ঞেস করলো, ‘তোর কোলে এটা কী?’ ছেলে বললো, ‘মোহাম্মদ বেড়াল।’
অশিক্ষিত কাঠমোল্লাগুলো যারা মনে করে সব নামের আগেই হয়তো মোহাম্মদ বসাতে হবে, তা যে ভুল এবং হাস্যকর, তা বোঝাতেই সম্ভবত আরিফুর রহমান ওই কার্টুন এঁকেছিল। কিন্তু কুড়ি পঁচিশ হাজার লোক বেরিয়ে গেছে ওই কার্টুনের বিরুদ্ধে মিছিল করতে। প্রথম আলোর সম্পাদক প্রাক্তন কমিউনিস্ট মতিউর রহমান এরপর ভয়ংকর লজ্জাজনক কাজ করলেন। তিনি কার্টুনিস্ট আর কার্টুন পত্রিকার সম্পাদক দুজনকেই চাকরি থেকে বরখাস্ত করলেন। দেশবাসীর কাছে ক্ষমা চাইলেন। শুধু তাই নয়, ক্ষমা চাইলেন বায়তুল মোকাররমের খতিবের কাছেও, তার পায়ের কাছে হাঁটু গেড়ে বসে।
কে যেন বলেছিল, কমিউনিস্ট যখন পচে, ভীষণ পচে। দেশ ভেসে যায় দুর্গন্ধে।
যে দেশে বাক স্বাধীনতা নেই, সে দেশ আমার নয়। এই বাংলাদেশ আমার বাংলাদেশ নয়। এই বাংলাদেশ পেতে তিরিশ লক্ষ মানুষ জীবন দেয়নি, দু’লক্ষ মেয়ে ধর্ষিতা হয়নি।
.
১৭ ডিসেম্বর
ইঁদুর ঘোরাঘুরি করছে সুয়েনসনের হোটেলের ঘরে, আর তীব্র গন্ধ নাকি আসছে কেরোসিনের। বাথরুমের জানলা খোলা, টেনেও বন্ধ করা যায় না। অশোকা প্যালেসে বসে সুয়েনসন এই অভিযোগ করলো।
প্রভু আমাকে জানিয়েছেন, সুয়েনসনের কোনোঅসুবিধে হচ্ছেনা, তারাই তাকে বিমান বন্দর থেকে নিয়ে এসেছেন, হোটেলে রাখছেন, খাওয়াচ্ছেন, ঘোরাচ্ছেন। এই আরামে থেকে সুয়েনসন কৃতজ্ঞতা প্রকাশ তো করছেই না, বরং খুঁত ধরার চেষ্টা করছে। সে তো কস্মিনকালেও পৃথিবীর কোথাও কোনও সরকারি লোক দ্বারা আপ্যায়িত হয়নি। ইউরোপের কোথাও যদি কখনও এরকম হতো যে তাকে বিমান বন্দর থেকে নিয়ে এসে খাইয়ে দাইয়ে, শহর দেখিয়ে ঘুরিয়ে, শহরের পাঁচতারা হোটেলে ঘর দেওয়া হচ্ছে ঘুমোতে দিন রাত শুধু মাথা নুইয়েই পড়ে থাকতো সুয়েনসন। ওর হাতে একটা কাঠিলজেন্সও যদি কোনও সাদা লোক দেয়, অনন্তকাল ধরে চলতে থাকে সাদা লোকের আর কাঠিলজেন্সের প্রশংসা। আর কালোবা বাদামি উজাড় করে দিলেও ও নাক সিঁটকাবে। ভেতরে ভেতরে আস্ত একটা বর্ণবাদী এই সুয়েনসন, আজ নয়, বহুদিন আগেই আমি টের পেয়েছি। সুয়েনসনের সঙ্গে আমি দেখা করতে চাইছি, ‘আমার বাটীতে সে থাকিবেক’ এই আবেদন জানিয়ে আমি দরখাস্তও করেছি, যত না সুয়েনসনের জন্য, তার চেয়ে দ্বিগুণ ত্রিগুণ চতুগুণ আমার জন্য। আমার স্বাধীনতার জন্য। বাক স্বাধীনতার জন্য।
দুপুরে আমাকে নিয়ে আসা হল রক্ত যেখানে নিতে এসেছিল সেই বাড়িতে। ওখানে অন্য একটি গাড়িতে করে সুয়েনসনকে আনা হল। সাক্ষাৎএর অনুমতি শুধু। প্রভু বললেন, সাক্ষাতের সময় তিনি নিজে থেকে বাড়িয়ে দিয়েছেন। এক ঘণ্টার বদলে আমাদের তিন ঘণ্টা সময় দিয়েছেন দেখা করার। কী চান প্রভু, যেন কৃতজ্ঞতায় নুয়ে থাকি। এক ঘণ্টাকে তিন ঘণ্টা করা হয়েছে বলে? আমি চোর না ডাকাত না খুনী! আমার কি জেল হয়েছে। আমার ভাবতে খুব অবাক লাগে, আমি কতক্ষণ ঘরের বাইরে থাকতে পারবো, কতক্ষণ আমার বন্ধুর সঙ্গে কথা বলতে পারবো, তার সিদ্ধান্ত অন্য কেউ নিচ্ছে, আমার নেওয়ার অধিকার নেই।