চৌ–তা তো বুঝতে পারছি। কিন্তু এরা তো সব পলিটিক্স করছে। এটা কি কোনও সভ্য দেশ হল! সব শুয়োরের বাচ্চা।
এসব কথা তপন রায় চৌধুরীর সঙ্গে হয়েছিল। উনি বলেছিলেন, খুব বড় একজনের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছেন, আজ বা কাল। জিজ্ঞেস করেছিলাম, বড় একজনটি কে। বলেননি। শুধু বলেছেন, আমি নাম বলবো না, তবে আমি জানি তিনিই একমাত্র তোমাকে সাহায্য করতে পারেন, সত্যি কথা বলতে কী, বাঁচাতে পারেন তোমার এই ভয়ংকর দুর্দশা থেকে তোমাকে’। বলেছিলেন আমার বিষয়েই তাঁর সঙ্গে কথা বলতে যাচ্ছেন।
আমি আশায় আশায় ছিলাম। জানি তপন রায় চৌধুরী আমাকে খুব স্নেহ করেন। কিন্তু সেই বিরাট বড় মানুষটির সঙ্গে কথা বলে এসে তিনি যা বললেন আমাকে, শুনে আমি থ।
চৌ–শোনো, কথা বললাম, উনি বললেন, সবচেয়ে ভালো হয় এখন যদি তুমি বিদেশে চলে যাও। তোমার কোনও পয়সাকড়ি খরচ হবে না। ভারত সরকারই তোমার প্লেন টিকিট দেবে, বিদেশে তোমাকে রাখার খরচও ভারত সরকার দেবে।
ত–বলছেন কী? কে বলেছে?
চৌ–তাঁর নাম বলা যাবে না। তাঁর নাম তুমি আমাকে জিজ্ঞেস কোরো না। তবে খুব বড় একজন।
ত–আমাকে তাহলে বের করে দিতে চাইছেন ওঁরা!
চৌ–একটুও না। তোমার ভিসা এক্সটেনশানটা হয়ে যাওয়ার পর তুমি যাবে। সুতরাং কোনও চিন্তা নেই। ভিসা থাকলে ফিরতে তো পারবেই।
ত–ভিসা থাকলেও ইমিগ্রেশনে আটকে দিতে পারে।
চৌ–না। কোনওদিন হতে পারে না।
ত–পারে। নিশ্চয়ই পারে। সরকারি সিদ্ধান্ত হলেই পারে।
চৌ–ভারতবর্ষে কোনওদিন এরকম হয় না। কোনওদিন এরকম হতে শুনিনি।
ত–ভারতবর্ষের কোনও রাজ্য থেকে কোনও লেখককে তাড়িয়ে দিতে শুনেছেন এর আগে?।
চৌ-না।
ত–দেখলেন তো আমাকে তাড়িয়ে দেওয়া হল! আমার তো রেসিডেন্স পারমিট আছে। কলকাতায় থাকার অধিকার তো আমার আছে। যেতে পারছি কলকাতায়?
চৌ না।
ত–একবার ভারত থেকে চলে গেলেও আমাকে আর ঢুকতে দেওয়া হবে না। যেভাবে এখন ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না পশ্চিমবঙ্গে। আর, একটা কথা কি আপনার মনে হয়নি কখনও, যে, কেন আমাকে যেতে হবে ভারতের বাইরে?
চৌ–একটা নিগোসিয়েশন করার চেষ্টা করছিলাম। বলেছি, ও আমার মেয়ের মতো। ও কলকাতায় ফিরবে। লেখালেখি করবে। কী করতে হবে তার জন্য বলুন।
ত–কিসের নিগোসিয়েশন?
চৌ–যেন তুমি ফিরতে পারো।
ত–ফেরার জন্য হলে ফিরবো কলকাতায়। বিদেশ যাবো কেন?
চৌ–ওরা ওদের ভোটের ব্যাপারটা নিশ্চিত করতে চায়।
ত–যথেষ্ট কি হয়নি? রাজ্য থেকে বের করলো। বই থেকে কেটে বাদ দেওয়া হল। মৌলবাদীরা চুপ হয়ে আছে। তারা খুশি। তারপরও আর কী দাবি তাদের মেটাতে চাইছে? এতগুলো দাবি মেটানোর পরও ভোট পাবে বলে তাদের মনে হচ্ছে না? এখন আমাকে ভারতবর্ষ ছাড়তে হবে? এরপর মৌলবাদীরা ডিমান্ড করবে, তসলিমাকে মেরে ফেললো, তাহলে তোমাদের ভোট দেব। তখন কি আমাকে ওরা মারতে আসবে ভোটের জন্য? দাবির কি সীমা আছে? দাবি মেটানোর কি সীমা আছে? দাবি সম্ভবত নিজেরাই তুলছে, দাবি নিজেরাই তুলে নিজেরাই মিটিয়ে অশিক্ষিত মূর্খদের ভোট চাইছে।
প্রভু এলেন রাতে। ভ’বাবুর পরামর্শ মতো যে দরখাস্ত লিখে প্রভুর হাতে দিয়েছিলাম, প্রভু তা যথাস্থানে বিবেচনার জন্য পাঠানোর পর আজ সেই দরখাস্তের জবাব এসেছে। জবাব শোনার জন্য কান পেতে থাকি। প্রভু বললেন, হবেনা, আমার সুইডেনের বন্ধু আমার কাছে আসতে পারবে না, আমিও তার কাছে যেতে পারবো না। আমাদের যদি দেখা হয় কোথাও, তৃতীয় কোনও জায়গায় হবে সেই দেখা। আয়োজনটা আমার বা বন্ধুর ইচ্ছেমতো হবে না। আমি আবেদন পেশ করবো, সেই আবেদন ওপরওয়ালা মঞ্জুর করলেই প্রভু আমাকে তৃতীয় জায়গায় নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করবেন।
কেন দেখা করা যাবে না? কী কারণে আমার বন্ধুরা আমার কাছে আসতে পারবে না, বা আমি তাদের কাছে যেতে পারবো না। এর উত্তর প্রভু বললেন, তিনি জানেন না। তিনি শুধু ওপরওয়ালার নির্দেশ আমাকে জানিয়েছেন।
আমি যতই বলি না কেন যে আমার কষ্ট হচ্ছে, এভাবে মানুষ বাস করতে পারে না, আমি একটা স্বাভাবিক জীবন চাই, এমন জীবন যেখানে আমি শ্বাস নিতে পারবো, যেখানে আমি ইচ্ছে হলে বাইরে বেরোতে পারবো, বন্ধুরা আমার বাড়ি আসতে পারবে, আমি যেতে পিরবো তাদের বাড়ি, একটা স্বাভাবিক জীবন নাহলে চলছে না–প্রভুর কোনও প্রতিক্রিয়া নেই। মাছের মতো মুখ করে শোনেন আমাকে। রোবটের সামনে কথা বলারও হয়তো কোনও মানে হয়। প্রভু রোবটের চেয়েও প্রাণহীন। দেয়ালের মতো। মাথা ঠুকলে মাথা ভাঙে, দেয়ালের কিছু হয় না।
রাতে ফোন করে প্রভু জানতে চাইলেন, যে লেখকের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে, তাঁর পুরো নাম ঠিকানা ইত্যাদি।
ত–তপন রায় চৌধুরী।
প্র–রাইট তপন রায় চৌধুরী। উনি আর কী বললেন?
ত–সব তো বলেছিই আপনাকে।
প্র–উনি তো নিগোসিয়েশনের ব্যাপারে কথা বলেছেন।
ত–যাঁ, কিন্তু আমি মেনে নিইনি। আর যা কিছুই মেনে নিই, আমাকে দেশ ছাড়ার কথা বললে তা আমি মেনে নেবো না।
প্ৰ–কেন মানবেন না?
ত-মানবোনা কারণ কলকাতা ফেরার জন্য বিদেশ যাওয়ার শর্ত নিতান্তই যুক্তিহীন।
প্র–যুক্তিহীন?
ত–হ্যাঁ যুক্তিহীন।
আচ্ছা আপনিই বলুন, বিদেশ চলে গেলে কলকাতা যাওয়ার পথ সুগম হবে, এ কথা তপন বাবু যে এত বার বললেন, এর মাথামুণ্ডু আপনি কিছু বুঝতে পারেন? আপনি হয়তো পারেন, আমি পারি না। আর আসল কথা, আমি তো কচি খুকি নই। আরে বাবা, আমার তো একটা দেশ ছাড়ার অভিজ্ঞতা আছে। এখনও ঘা-টা খুব কাঁচা। আমাকেও তো এভাবে বলা হয়েছিল, ক’দিনের জন্য যাও, কিছুদিন পর ফিরে আসতে পারবে। যারা দেশ থেকে তাড়ায়, তারাই ‘বিদেশ’, ‘কিছুদিন পর’ এই শব্দগুলো ব্যবহার করে। আর যারা তাড়ায় না, তারা কোথাও কাউকে আটকে রাখে না, যার যেখানে যাওয়ার, সেখানে যাওয়ার ব্যবস্থা করে যে করেই হোক। কোনও কিছুর ছুতোয় কারও যাত্রা ভঙ্গ করে না।