আমার স্বাসকষ্ট হচ্ছে, কেউ দেখতে পাচ্ছে না। কেউ টের পাচ্ছে না, কেউ শুনতে পাচ্ছে না শ্বাসকষ্টের শব্দ। এই শব্দ কি কেউ কোনওদিন পাবে শুনতে! স্বাসকষ্টের শব্দ মোড়া থাকে নৈঃশব্দে।
জানি না কোন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি আমরা। জানি না আমি আবার কোনওদিনও ফিরতে পারবো কি না বাংলায়। বাংলা হয়তো একটা স্বপ্ন অথবা দুঃস্বপ্ন হয়েই থেকে যাবে চিরকাল।
জয় গোস্বামী একটা খুব ভালো লেখা লিখেছেন আমাকে নিয়ে। ওর সঙ্গে কথা বললাম ফোনে। ও বললো, আপনার জন্য আমাদের গর্ব হয়।
অপর্ণা সেন বিকেলে ফোন করলেন। দুঃখ করে বললেন, যারা অপরাধী তাদের শাস্তি দিয়ে নিরপরাধকে শাস্তি দেওয়া হল। হ্যাঁ হল। এই হওয়াটাকে কি মেনে নেওয়া হবে? অবশেষে বললেন, কিছু একটা করার চেষ্টা করবেন।
জয়শ্রী দাশগুপ্তও ফোন করলেন, আমার জন্য দুঃখ করলেন। কিন্তু কলকাতার বাইরেই অন্য কোথাও আমি থাকবো, তা-ই মনে করছেন তিনি। কিন্তু আমি তো কলকাতায় ফিরবো, জয়শ্রীদি।
রাতে ফোন করলেন ডলি রায় আর সৌগত রায়। সৌগত রায় বললেন, ‘সিপিএম তোমাকে চায় না। আমাদের ক্ষমতা নেই তোমাকে আনার।‘
আমি যখন বলছি, ‘বলছেন কী, আমি কি ফিরবোনা কলকাতায়? আমাকে তোফিরতে হবে কলকাতায়। সৌগত রায় বললেন, ”দেখি, আমি একবার প্রিয়দা আর প্রণবদার সঙ্গে কথা বলে দেখবো। কী অবস্থা একটু বুঝবো।’
বললাম, কণ্ঠ ভেজা, ‘আজও ফোন করেননি?’
হয়তো একটু অপ্রস্তুত হলেন। ওখানে, কলকাতায়, আমি অনুমান করি, প্রায় সকলেই হয়তো ভেবেই নিয়েছেন আমাকে আর কলকাতায় ফেরত যেতে দেবে না। এবং আমার পক্ষেও সম্ভব নয় ফেরা। তারা কেউ কেউ প্রসঙ্গ উঠলে দুঃখ করবেন। কেউ কেউ বলবেন, ‘মিস করছি’। কেউ কেউ বলবেন, ‘বেচারা’। আমার কপালের প্রসঙ্গও হয়তো কেউ তুলবেন। কপালটাই খারাপ।
আর যারা আমাকে জানে না, চেনে না, বোঝে না, তারা তো বলবেই ইচ্ছে করেই এমন সব করেছি, যেন নাম হয়, যেন জনপ্রিয়তা বাড়ে, যেন বই বিক্রি হয়, যেন বিতর্ক হয়।
এসবের জন্য ঠিক কী করেছি তারা বলতে পারবে না কিন্তু। অনেকে শান্তি পাবে বলে যে আমার লেখায় সাহিত্যগুণ এক ছটাকও নেই। সাহিত্যগুণ না থাকলে রাজ্য থেকে যে কোনও লেখককে তাড়িয়ে দেওয়া যায়, দিলে খুব একটা ক্ষতি কিছু হয় না। অথবা গন্ডগোলের অজুহাত দিয়েও তাড়ানো চলে। তাড়ানো নিয়ে কথা।
.
১৩ ডিসেম্বর
তুমি যখন একা, তোমার কেউ থাকে না। সলিটারি কনফাইনমেন্ট থাকে শুধু। এক ঘর বন্দিত্ব থাকে। তুমি যখন একা, তুমি তখন একাই। জগতে কেউ নেই তোমার জন্য।
.
১৪ ডিসেম্বর
কলকাতা থেকে প্রায়ই ফোন করছেন তপন রায় চৌধুরী। উনি নামি দামি লোক। বই লিখেছেন। ভারত সরকারের পদ্মবিভূষণ পুরস্কার পেয়েছেন। আমাকে একদিন বললেন, ‘ওদের খুব বড় একজনের সঙ্গে কথা বললাম। আমাকে বললেন, অবস্থা ভীষণ খারাপ।’
ত–খারাপ অবস্থা, কোথায়?
চৌ–দেশে।
ত–কেন হবে খারাপ অবস্থা! কোনও খারাপ অবস্থাই তো দেখছি না।
চৌ কে বলেছে? লস্কর-এ-তৈবার একটা লোক তো বলছে যে তোমাকে মেরে ফেলবে, খুঁজছে নাকি তোমাকে।
ত–না। এরকম কোনও খবর আমি পড়িনি।
চৌ–টেলিগ্রাফে আছে।
ত–আমার মনে হয় না টেলিগ্রাফে এসব কিছু লিখেছে। বাংলাদেশের হুজির কথা সম্ভবত পড়েছেন। ওরা বেশ অনেক বছর আগে আমাকে মেরে ফেলার একটা প্রোগ্রাম করেছিল। এখন কেউই চাইছে না। যে গুন্ডা পাণ্ডাআর অ্যান্টি সোশাল ছেলেরা নভেম্বরের একুশ তারিখে কলকাতায় হাঙ্গামা বাধাতে নেমেছিল, ওরা আমার বই টই পড়েনি। ওদের নামানোর পেছনে অন্য কোনও ষড়যন্ত্র আছে।
চৌ–এখন একটা নিগোসিয়েসন হোক। তোমাকে লিখিত দিতে হবে কিনা কিছু, মৌলবাদীরা এখন কী দাবি করছে, সেটা জানার চেষ্টা হচ্ছে। যে দাবিই ওরা করুক, সেই দাবি মতো ওদের সঙ্গে একটা বোঝাঁপড়া হওয়া ভালো।
ত–আমি দ্বিখন্ডিত থেকে বাদ দিয়েছি কিছু অংশ। তারপর ওদের বড় বড় নেতাই বলে দিয়েছেন, ম্যাটার ক্লোজড। ব্যস। এখন আবার কী? যে কেউ যে কোনও দাবি করলেই আমাকে মেনে নিতে হবে কেন?
চৌ–লিখিত দিলে হয়তো ওরা শান্ত হবে।
ত–লিখিত মানে?
চৌ–লিখিত, যে, তুমি তোমার বই থেকে কিছু আপত্তিকর পৃষ্ঠা বাদ দিয়েছে।
ত–সে তো বলাই হয়ে গেছে। টিভিগুলোতে দেখিয়েছে। সারাদিন ধরে প্রচার করেছে এ খবর। বইএর ওই অংশটুকু কেটে বাদ দিয়ে নতুন এডিশনও ছাপা হয়ে গেছে।
চৌ–ওরা তো মানছে না।
ত–কে বলেছে মানছে না? ওরা মানছে। বিমানবাবু মানছেন না। উনি বলছেন আরও বই লিখেছি। আরও বই থেকেও কেটে বাদ দেওয়া হোক। আসলে কি জানেন, না মানতে চাইলে কিছুতেই মানবে না। লিখিত দিলেও মানবে না। শয়তানি করতে চাইলে আপনি কি পারবেন শয়তানি বন্ধ করতে?
চৌ–পরিস্থিতি তো অশান্ত।
ত–পরিস্থিতি অশান্ত ভাবলেই অশান্ত। না ভাবলেই শান্ত। কে বললো পরিস্থিতি শান্ত নয়?
চৌ–ওরা বললো। মৌলবাদীরা নাকি ভীষণ তান্ডব করছে।
ত–কিছুই করছে না। ওদের আস্কারা দিলেই তাণ্ডব করবে। যদি মিডিয়া ওদের খবর কভার করে, পলিটিশিয়ানরা নমো নমো করে, তাহলেই যা ইচ্ছে তাই করবে। এখন করছে না, করলে আপনি দেখতে পেতেন। দেখছেন কোনও মিটিং মিছিল! কিছুই দেখেননি। টিপু সুলতান মসজিদের ইমাম শুধু একবার বলেছেন তিনি নাকি কী মানেন না। ইমামকে একটা ধমক দিলেই ইমাম মানা না মানা নিয়ে মাথা ঘামাবেন না। গতবার একটা ফতোয়া দিয়েছিলেন তিনি। বেশ হম্বিতম্বি করলেন, যেই না পুলিশ কমিশনার তাঁকে ডেকে নিয়ে একটা ধমক দিয়ে দিলেন, বা হাতে কিছু টাকা ধরিয়ে দিলেন, অমনি ঘর থেকে বেরিয়ে এসে ইমাম টেলিভিশনে বললেন, না তো, কোনও ফতোয়া তো দিই নি। আমার মতো লোকের ফতোয়া দেওয়ার এক্তিয়ার নেই। মুশকিল হল, ওই চাওয়া নিয়ে। ওই ধমকটা তো এখন দিতে চাইছেন না কেউ। পরিস্থিতি সামাল যাঁরা ইচ্ছে করলেই দিতে পারেন, তাঁরা চাইছেন না দিতে।