কলকাতা থেকে প্রায়ই ফোন আসে ওখানকার বাংলা কাগজে আমার সম্পর্কে কারও যদি খুব ভালো কোনও লেখা থাকে, পড়ে শোনানোর জন্য। এনামুল কবীর আজকাল ফোনে এই পড়ে শোনানোর কাজটা করছেন। সকালে বর্তমান পত্রিকার উপসম্পাদকীয় পড়ে শোনালেন। সুখরঞ্জন দাশগুপ্তের লেখা। লেখক ইতিহাস থেকে নমুনা এনে এনে দেখিয়েছেন রাজনৈতিক আশ্রয় যে দেওয়া হয়েছে ভারতের স্বাধীনতার পর থেকে কত মানুষকে, কখনও শর্ত আরোপ করা হয়নি। আমার মতো নিরাশ্রয় লেখককে যদি আশ্রয় দেওয়া হয় তবে তিনি এই গণতন্ত্র, এই ধর্মনিরপেক্ষতা, এই ভারত, ভারতীয় জাতকে শত ধিক দিয়েছেন। সুখরঞ্জন দাশগুপ্তের সঙ্গে আমার পরিচয় নেই। অপরিচিত অচেনা কত কত মানুষ যে দাঁড়িয়েছেন আমার পক্ষে। এখন আমার পক্ষে দাঁড়ানো মানে ভীষণ রকম একটা অন্যায়ের বিপক্ষে দাঁড়ানো।
অরুন্ধতী রায় এসএমএস পাঠালেন কলকাতা থেকে। অ্যাম ইন কলকাতা। এভরিবডি আই মীট ওয়ান্টস ইউ ব্যাক হিয়ার। আই অ্যাম সিওর ইট উইল হ্যাঁপেন। স্টে স্ট্রং। অ্যাম ইন এ ক্রাউড। উইল কল হোয়েন আই ক্যান। সি ইউ। লটস অব লাভ’।
কী যে ভালো লাগে অরুন্ধতীর ওইটুকু লেখা পেয়ে। ওঁর সঙ্গে ফোনে কথা হয়েছে এই ‘সেইফ হাউজে’ ঢোকার প্রথম দিনই। করন থাপরের মাধ্যমেই যোগাযোগ। অরুন্ধতাঁকে সব বলি, সেই শুরু থেকে, হায়দারাবাদ থেকে ফেরার পর আমাকে বাড়ির বাইরে আর বেরোতে না দেওয়া, কলকাতার পুলিশ কমিশনারের আমার বাড়িতে আসা, আমাকে চলে যেতে বলা, ২১শে নভেম্বরের তাণ্ডব, ২২ শে নভেম্বর আমাকে মিথ্যে কথা বলে জয়পুরের উড়োজাহাজে তুলে দেওয়া, সব। অরুন্ধতাঁকে পরে আমার ব্যাপারে কথা বলার জন্য করন থাপর ডেভিলস এডভোকেটে ডাকেন। অসাধারণ বলেছিলেন অরুন্ধতী। আমার ওপর যে অত্যাচার চলেছে, এরকম তাঁর ওপর চললে তিনি লেখালেখি বন্ধ করে দিয়ে অন্য কিছু করতেন। পশ্চিমবঙ্গ থেকে আমাকে বের করার কারণ তিনি মনে করেন, সিঙ্গুর এবং নন্দীগ্রামে যে নির্যাতন আর হত্যাযজ্ঞ ঘটিয়েছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার, ও থেকে জনগণের দৃষ্টি অন্যদিকে সরানো। পার্ক সার্কাসের রাস্তায় একটা মিছিল নামক নাটক করে আমাকে ওই ছুতোয় রাজ্য ছাড়া করা হয়েছে। গ্রামে মুসলমান মরেছে, রিজওয়ান নামের একটা মুসলমান ছেলেও পুলিশের অত্যাচারে মরেছে–এসব খবর বাতাসের আগে রাষ্ট্র হয়েছে। দীর্ঘ বছর ক্ষমতায় থাকা বামপন্থীরা এই প্রথম মুসলমানের ভোট হারানোর ভয়ে কাতর। হাতের কাছে আর কিছু না থাক, আমি আছি। আমার গায়ে ইসলামবিরোধী তকমা আঁটার মতো সহজ কাজ আর কী আছে, আর আমার মতো অসহায় একা একটি প্রাণীকে ঘাড় ধরে বের করে দিলে কার কী এমন ক্ষতি! এতে যদি একটা ছোটখাটো ভোটও কোনও তসলিমা বিরোধী মুসলমান খুশি হয়ে দেয়!
সেই যে তেইশে নভেম্বরের রাতে কথা হয়েছিল ভ’র সঙ্গে, এর পর আর কথা হয়নি। যদিও বলেছিলেন, যখন প্রয়োজন মনে করি, যেন ফোন করি। কিন্তু প্রয়োজন মনে করলেও ফোন করিনি। এত বড় একজন মানুষ, তাঁকে বিরক্ত করতে ইচ্ছে হয় না। আজ তাকে ফোন করার কারণ, সুয়েনসন। সুয়েনসন আমি যেখানে আছি, সেখানে থাকবে দু’সপ্তাহ, এ আমার ইচ্ছে। ভ বললেন একটা যেন দরখাস্ত লিখি। এও বললেন মৌলবাদীরা আমাকেই শুধু অসুবিধে করেনি, তাঁকেও করেছে। কীরকম সেসব, কিছুই বলেননি। অনুমান করি, তিনি আমাকে দেখা শোনা করার ভার নিয়েছেন, আমাকে দেশ থেকে বের না করে উল্টে খাওয়াচ্ছেন, পরাচ্ছেন, এ কারণে তাঁকে তিরস্কার করেছে মুসলমানরা।
কবে ফিরতে পারবো? আমার হঠাৎ প্রশ্ন। কবে ফিরতে পারবোকলকাতায় তার তিনি কিছু বলতে পারলেন না। শুধু বললেন, সবই নির্ভর করে হুজুগের ওপর। যা হয়েছে তা হুজুগে হয়েছে। অন্য একটা হুজুগে লোক যদি আবার মাতে, হয়তো পরিস্থিতি আমার জন্য স্বাভাবিক হবে। তার আগ অবধি আমাকে পশ্চিমবঙ্গ থেকে বাইরে থাকতে হবে, অন্তত থাকাটা উচিত।
ব্রাত্য আমি। আমাকে পশ্চিমবঙ্গ সরকার নিচ্ছে না। ব্রাত্য আমি, পশ্চিমবঙ্গের মানুষ আমাকে চাইছে না। কেউ কেউ চাইছে, কিন্তু খুব জোর দিয়ে কেউ চাইছে না। এরকম যে কিছু ঘটতে পারে জগতে, বা ঘটবে কোনওদিন, তা আমার ভাবনার ধারে কাছেও আসেনি কখনও।
.
১২ ডিসেম্বর
দিনগুলো কাটছে। কী করে কাটছে, ঠিক বুঝতেও পারি না। একটা কালো সোয়েটার কিনে দিয়েছে ওরা। ত্বকে খরা পড়েছে। ভেনোসিয়া বলে একটা ক্রিম লাগাতে বলেছেন ত্বক বিশেষজ্ঞ মালাকার। ওরা তাও কিনে দিলো। দুজোড়া মোজাও দিল। সকালে নাস্তা তৈরি, দুপুরে ওই একই ধরনের খাবার, রাতেও তাই। দিন চলে যাচ্ছে, যেমন যায়। খাবারের ডাক পড়ে। খাই। কেন যে খাই, বুঝি না। খুব যে ক্ষিধে পায়, তাও মনে হয় না। অনুভূতিগুলো কেমন যেন ভোঁতা হয়ে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে মনে হচ্ছে মৃত্যু এসে বসছে আমার শরীরে। ক’দিন আগে চিৎকার করে কেঁদেছিলাম। প্রভুকে বলেছিলাম, বিষ নিয়ে আসুন। প্রভু আমার এই রিকোয়েস্টটিকেও সিরিয়াসলিই নিয়েছেন। এই রিকোয়েস্টটিকেও পুট করেছে নির্দিষ্ট দপ্তরে।
দুতিনটে পাথুরে মুখ আমার সামনে মাঝে মাঝে দেখা যায়। তারা আমাকে নিরাপত্তা দিচ্ছে, নাকি নজরবন্দি রাখছে ঠিক বুঝতে পারি না। গৃহবন্দি এবং নজরবন্দি এই দুই অবস্থার মধ্যে পেণ্ডুলামের মতো আমি ঘুরছি। পাথরগুলোও আমার ধৈর্য দেখে অতিষ্ঠ হচ্ছে। কবে একবার মুখ ফুটে বলবো, ”না আর পারছি না, এ দেশ থেকে চলে যাবো আমি। –তখনই সম্ভবত পাথুরে চেহারায় প্রাণ দেখা দেবে। শুধোবে, কোন দেশ ম্যাডাম? টিকিট কি ইকোনোমি ক্লাস করবো, নাকি বিজনেস ক্লাস?