-Muchkund Dubey
আজ মানবাধিকার দিবস। দীর্ঘ দীর্ঘ দীর্ঘশ্বাস ফেলছি জীবনের কথা ভেবে। দীর্ঘ তেরো বছরের নির্বাসন জীবন আমার। আজও নিজের দেশ বাংলাদেশে যাওয়ার এবং বাস করার কোনও অধিকার আমার নেই। কী কারণে বাংলাদেশ সরকার আমার নাগরিক অধিকার লঙ্ঘন করছে, তা কোনওদিনই আমাকে জানানোর প্রয়োজন মনে করেনি।
আজ মানবাধিকার দিবস। আমি পড়ে আছি প্রিয় বাংলা থেকে শত শত মাইল দূরে অজানা একটা ঠিকানায়। পূর্ববঙ্গও নির্বাসন দিল, পশ্চিমবঙ্গও পাঠালোনির্বাসনে। বাংলায় আমার ঠাঁই নেই। আমি কোথায় আছি তা কেউ জানবে না, তা কারও জানার নিয়ম নেই। কেউ আমার সঙ্গে দেখা করতে পারবে না। আমিও কারও সঙ্গে দেখা করতে পারবো না।
একা একা সকাল হয়। একা একা দুপুর, বিকেল। একা একা রাত হয়। মানবাধিকার দিবস জুড়ে বসে থাকি এক জীবন অধিকারহীনতা নিয়ে। অসহায়। অনাথ। অবলা। হ্যাঁ অবলাই তো। কথা বলার অধিকারও তো আমার নেই। আমি যেন কথা না বলি। কথা বলার অধিকার বা মত প্রকাশের অধিকারকেও তো মানবাধিকার বলে। কথা না বলতে বলতে, মত প্রকাশ না করতে করতে আমার মনে হচ্ছে, আমি ভুলে যাব কথা বলতে। আমি ভুলে যাবো ভাবতে। ভুলে যাবো নিজের কোনও মত যে থাকতে হয়, ভিন্ন মত হলেও যে থাকতে হয়, এবং তা প্রকাশ করতে হয়, তা। ভুলে যাবো মানবাধিকারের মূল অর্থ কী। প্রতি বছর দশই ডিসেম্বর যাবে, আসবে। আমার কিছু যাবে আসবে না।
আজ রাতেই এলেন প্রভু। প্রভু আসা মানে নতুন কোনো খবর আসা। মূলত যা বললেন, তা হল, সুদূর সুইডেন থেকে আমার সঙ্গে দেখা করতে আসছেন মিস্টার সুয়েনসন, তাঁকে আমার অজ্ঞাত ঠিকানায় আনার কোনও অধিকার আমার নেই, এমনকী আমারও অধিকার নেই তার হোটেলে গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করার, যদি দেখা করার অনুমতি প্রার্থনা করে আমি দরখাস্ত করি, এবং যদি ওপরওয়ালা রাজি হন, তবে বড়জোর ঘণ্টাখানেকের জন্য তৃতীয় কোনও জায়গায় দু’জনকেই পৃথক পৃথক ভাবে নিয়ে গিয়ে দুজনের দেখা করাবার একটি ব্যবস্থা করা হবে। এর বেশি কিছু যেন আমি আশা না করি। ওপরওয়ালা এখানে ভগবান জাতীয় কিছু নন, সত্যি বলতে কী, ভগবানের চেয়েও শক্তিমান।
দুনিয়া জুড়ে মত প্রকাশের স্বাধীনতা আর ব্যক্তিগত স্বাধীনতার আবশ্যকতা নিয়ে বলছি সেই কতকাল, বিভিন্ন মঞ্চে, বিশ্ববিদ্যালয়ে। কত শত মানুষ কত শত দেশে অনুপ্রাণিত হচ্ছে। আর আমাকে কি না কোনো একটা ঘরে আটকে রেখে বলা হচ্ছে, এ করা যাবে না, ও করা যাবে না? যাঁরা আমাকে বন্দি করছেন এবং নানারকম নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগ করছেন, শেকল পরাচ্ছেন পায়ে, চোখ বেঁধে রেখেছেন কাপড়ে, তাঁরা আদৌ জানেন না আমি কে, কোনোদিন শোনেননি আমার সামান্য ইতিহাস!
আমার তো কলকাতায় থাকার কথা ছিল, সুয়েনসনের কলকাতায় আমার কাছে বেড়াতে আসার কথা ছিল। আমি কলকাতায় থাকলে তো সুয়েনসন নিশ্চিন্তে নির্বিঘ্নে আমার কলকাতার বাড়িতে আমার সঙ্গে ক’দিন কাটাতে পারতো। স্টকহোম-কলকাতা টিকিট ছিল তার। তিন চার মাস আগেই করে রাখা টিকিট। আমি দিল্লিতে আছি শুনে কলকাতা বদলে গন্তব্য দিল্লি করে নিয়েছে শুধু। তাকে বলেছি ফোনে, দিল্লিতে আমি অনেকটা গৃহবন্দি অবস্থায় কাটাচ্ছি, তোমার সঙ্গে দেখা করা সম্ভব হবে কি না জানি না। সুয়েনসন খুশি নয় আমার কথায়। তার বক্তব্য, ওঁরা যা বলছেন, তা কেন আমি মেনে নিচ্ছি! কেন আমি যে করেই হোক তাকে আমার কাছে রাখায় যে বাধা তৈরি করা হচ্ছে, তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছি না! যুদ্ধ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয় জেনেও সুয়েনসন টিকিট বাতিল করেনি। সস্তা টিকিট বাতিল করলে টাকা ফেরত পাওয়া যায় না। দিব্যি উড়ে চলে এলো।
আমার এই মানসিক অবস্থায় হাতে গোনা দু’একজন বন্ধুর সঙ্গে আমি যদি দেখা করতে না পারি, তাহলে কী ধরনের জীবন আমি যাপন করবো এখানে, এই অজ্ঞাতবাসে? আমি তো স্বাস বন্ধ হয়ে মারা পড়বো! অন্তত কলকাতার বন্দি জীবনে বন্ধুরা আসতে পারতো আমার বাড়িতে। এখানে তো জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন আমি। প্রভু একসময় যা বললেন, প্রসূন মুখার্জির কথার মতো লাগলো শুনতে, বললেন, ‘এত যখন উনার সঙ্গে দেখা করার আপনার প্রয়োজন, আপনি সুইডেনে গিয়ে দেখা করে আসুন না! তাহলে কি ওঁরা এই-ই চাইছেন যে আমি এ দেশ ছেড়ে চলে যাই?
আহ, আজ তো মানবাধিকার দিবস! প্রভু কি জানেন আজ মানবাধিকার দিবস!
.
১১ ডিসেম্বর
যদি এই কমপিউটারটা না নিয়ে আসতাম আমি, যদি ইন্টারনেট আমার না থাকতো এই কমপিউটারে, আমি বোধহয় নির্ঘাত মারা পড়তাম। দুদিনের জন্য জয়পুর যেতে হচ্ছে, দু’দিন কী আর এমন লিখবো, কী দরকার কমপিউটার নিয়ে। একবার ভেবেছিলাম। পরে আবার ভাবলাম, যদি দু’একটা কবিতাও লেখা হয়। হাতে শুধু কমপিউটার, আর কিছু নেই। এভাবেই বেরিয়েছিলাম ঘর থেকে।
লেখাপড়া আমাকে বাঁচিয়ে রাখছে। যখন রবেন দ্বীপে নেলসন ম্যাণ্ডেলার সেই সেলটা, যেখানে তাঁর সাতাশ বছরের বন্দীজীবনের আঠারোবছরই কাটাতে হয়েছিলো, দেখেছিলাম, চোখের জল রোধ করতে পারিনি আমি। অবিরল ঝরে যাচ্ছিল। ভাবছিলাম ওই লাইম স্টোন কাটার বাইরে আর কী করতেন তিনি, ছোট্ট একটুকরো ঘরে বই ছিল পড়ার, কাগজ কলম ছিল লেখার! লিখতে পড়তে দিলে অনেক কষ্টই হয়তো ভুলে থাকা যায়।