তারপর তোজয়পুরে পৌঁছে বুঝলাম, বিনীতবাবু এবং তার জয়পুরী দূত যা বলেছিলেন সব ভুল। জয়পুরের পুলিশদের বলা হয়েছে আমি কোনও এক সাহিত্য অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এসেছি, আমাকে একটি সস্তা হোটেলে তোলা হল, ওই হোটেল বিনীত গোয়েল আর জয়পুরী দূত কলকাতা থেকেই ঠিক করে রেখেছেন। গভীর রাতে পুলিশ আমাকে জানিয়ে দিল যে আমাকে রাজস্থান থেকে চলে যেতে হবে, কারণ ল এন্ড অর্ডার প্রবলেম শুরু হবে বা শুরু হয়ে গিয়েছে। গা হিম হয়ে গেল। ঠিক আছে, কলকাতায় চলে যাবো। কিন্তু দেখি ভোরবেলা আমাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এয়ারপোর্টে নয়, কলকাতার পথে নয়, দিল্লির পথে। উড়োজাহাজে নয়, গাড়িতে। কেন, সে পরে জেনেছি, রাজস্থানে যেমন আমাকে লাথি দিয়ে ফেলা হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গ থেকে, তেমনি রাজস্থান থেকেও একই রকম লাথি দিয়ে আমাকে পশ্চিমবঙ্গে ফেলতে চেয়েছিল রাজ্যসরকার। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ জানিয়ে দিয়েছে, বল যেন তার এলাকায় এসে না পড়ে। বল তারা চায় না। অতএব ডাম্প করতে দিল্লি, কেন্দ্র। কোনও নো ম্যানস ল্যান্ডের দিকে, উদ্বাস্তু, রাজ্যহারা, এতিম, অনাথ, অসহায়কে নিয়ে চললো পুলিশ। বসে আছি পথ চেয়ে, কবে ফিরবো কলকাতা। আপনি যদিও জানিয়ে দিয়েছেন যে আপনি কিছু জানেন না আমার বিষয়ে, জানে কেন্দ্র, সিদ্ধান্ত নেবে কেন্দ্র। আসলে কিন্তু কেন্দ্রকে নিজের সিদ্ধান্তটি আপনি দিয়েই রেখেছেন, আপনি আমাকে চাননা কলকাতায়, চাননা পশ্চিমবঙ্গে।
লোকে বলে, আপনার ভয়, আমি পশ্চিমবঙ্গে বাস করলে আপনি মুসলমান ধর্মান্ধদের সমর্থন পাবেন না, না পেলে পুরো মুসলমান জাতটারই ভোট পাবেন না। তাই আমাকে তাড়িয়ে দিয়ে ভোট নিশ্চিত করেছেন। ধর্মান্ধতা ঘোচানোর জন্য আমি লিখি, আপনি আমাকে সমর্থন না করে সমর্থন করলেন উন্মত্ত ধর্মান্ধতাকে। ওদের জিতিয়ে দিলেন। ওরা কি আপনাকে ভালোবাসে বলে আপনি মনে করেন? ওরা কি নিজেরাই ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের মতো আপনার মুণ্ডু চাইবে না একদিন?
কলকাতায় বাড়িঘর পড়ে আছে, আমার লেখালেখি সব পড়ে আছে। সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন আমি, নিজের জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন, আমি ঠিক কোথায় আমি জানি না। এখানে আপনার অনুমতির অপেক্ষায় কত দিন বসে থাকতে হবে আমি জানি না। আপনি কবে আমাকে বাড়ি ফিরতে অনুমতি দেবেন জানি না। হতাশায়, অনিশ্চয়তায়, অস্থিরতায় আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি। আমার রক্তচাপ বাড়ছে, প্রচন্ড উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা আমাকে আত্মহত্যা করতে প্ররোচিত করছে। আপনি খুশি হবেন, তাই আমি আপনার চক্ষুশূল ওই ‘দ্বিখন্ডিত বইটির যে লাইনগুলোকে সহ্য করতে পারতেন না, তুলে নিয়েছি। না, মৌলবাদীদের ভয়ে আমি আমার লেখা তুলে নিইনি। আমি ভয় করেছি আপনাদের, ভয় করেছি সেকুলার এবং গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলোকে, ভয় পেয়েছি আশ্রিতের জন্য যে ধর্ম বেঁধে দেওয়া হয়েছে, সেটিকে। ভয় পেয়েছি অগুনতি শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের ভয়াবহ মুখ বুজে থাকাকে। মত প্রকাশের স্বাধীনতা আমার নিজের দেশে ছিল না বলেই তো আমি আজ নিজের দেশের বাইরে, এখানে আমি সেই অধিকার পাবো বলেই তো আজ আমি এখানে। একটি গণতন্ত্র যদি আমাকে অধিকারটি না দেয়, কে দেবে? আমাকে যে মুখ বুজে থাকতে বলা হল, আমাকে যে বাধ্য করা হল নিজের লেখাকে অস্বীকার করতে, নিজের বই ছিঁড়ে ফেলতে, এ কার অপমান? আমার?
বুদ্ধবাবু, আমার বিশ্বাস হয় না আমার কারণে আপনার দলের ভোট পাওয়ায় কোনও হেরফের হবে। আপনার দল খুব শক্তিশালী দল। ভয় পাবেন না, আপনার দল যে কোনও নির্বাচনেই জিতে যাবে। তারপরও যদি আপনার বিশ্বাস হয়, যে, আমাকে তাড়িয়েছেন বলে দুটো ভোট আপনার বেশি হতে যাচ্ছে, তাহলে সেই ভোট আপনার নির্বিঘ্নে জুটুক, আপনার আরাম হোক। ভোট শেষ হলে, আপনি বিজয়ী হলে আমাকে আমার ঘরে ফিরতে দেবেন তো! অপেক্ষা করছি আপনার অনুমতির। কোনও ক্ষতি আমি আপনার করিনি। করতে চাই না। আমাকে শুধু নিরুপদ্রব নিজের লেখালেখি নিজের মতো করতে দিন। আমি আপনার শত্রু নই। শত্ৰু তারা, ওই মৌলবাদী, যাদের বন্ধু বলে জড়িয়ে ধরেছেন আপনি, সমাজকে অন্ধকার আর কুসংস্কার আর ভয়াবহ সংকীর্ণতা দিয়ে গ্রাস করতে চাইছে, এ আপনি জানেন না, আমি বিশ্বাস করি না।
আপনি যদি বিশ্বাস করেন সত্যিকার সেকুলারিজমে, সমতায়, সততায়, সাহসে, তবে আমাকে বন্ধু বলে মনে করতে আপনার তো অসুবিধে হওয়ার কথা নয়। ভোটই জগতের এবং জীবনের শেষ কথা নয়। মানবতা বলে একটি কথা আছে, আদর্শ বলেও একটি কথা আছে। সেসব খুইয়ে ফেললে কী আর থাকে। জেতে তো কত রাজাই। রাজারা সিংহাসন থেকে আবার কখনও কখনও খসেও পড়ে। রাজা কতদিন সিংহাসনে ছিল, তা দিয়ে রাজার চরিত্র বিচার হয় না। রাজার কাজ দিয়েই রাজার চরিত্র বিচার হয়।
তসলিমা
.
১০ ডিসেম্বর
‘তসলিমাকে এভাবে আটক করে রাখাটা ভারতের মতো একটি দেশের জন্য অত্যন্ত মর্যাদাহানিকর। সাম্প্রতিককালে যেসব ঘটনা ঘটেছে তার সঙ্গে তুলনা করলে বলা যায় এই ঘটনা আমাদের খুব ছোট করে দিয়েছে।.. Taslima has suffered too much and has gone through prolonged distress and agony. This must be brought to an end without delay. She should also, without much ado, be allowed to return to Kolkata, her preferred place for stay. Moreover, she should be granted Indian citizenship before her current visa expires so that her creative work does not suffer and she is never again rendered fugitive and stateless. The award of citizenship would also make it easier for her to protect her rights. In urging this, I am not alone; hundreds of millions of Indians desire likewise.’