যে পনেরো নভেম্বর তারিখে সিদ্দিকুল্লাহ চৌধুরীদের ‘বনধ’ পালন হওয়ার কথা, এবং সেই ভয়ে আগে থেকেই পুলিশ কর্তারা আমাকে দেশ বা রাজ্য ছাড়ার জন্য বলতেন, সেই পনেরো নভেম্বরে বনধ তো হলই না, একটা মিছিল হল শুধু, অথচ ভোর পাঁচটায় আমাকে তড়িঘড়ি বের করে রাসবিহারী অ্যাভিয়ে ডলি রায়ের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হল। ওখানে আমাকে একা রেখে পুলিশরা সবাই চলে গেল। কোথায় গেল? খবর নিয়ে দেখি সবাই পুলিশ অফিসে গিয়ে খামোকা বসে আছে। শেষ বিকেলে বিনীত গোয়েলকে ফোন করেছিলাম জানতে কখন বাড়ি ফিরবো। ভীষণ ক্রুদ্ধ তিনি আমার ওপর, বললেল, কখন বাড়ি ফিরবেন তার আমি কী জানি? তাঁর রাগ, আমি জয়পুর যাইনি, তার জয়পুরী দূতকে বারে বারেই ফিরিয়ে দিয়েছি। আতঙ্কে কেটেছে সারাদিন। আতঙ্ক তৈরি করার চেষ্টা ১৫ নভেম্বরের আগেই শুরু হয়েছিল যখন আমার বাড়িতে নিরাপত্তারক্ষী কমিয়ে দেওয়া হল। কী, না, যারা বাড়ির সামনে বসে, তারা এখন থেকে পুলিশ অফিসে বসবে। কেন পুলিশ অফিসে? না, এমনি। ১৫ নভেম্বরে মিল্লি ইত্তেহাদ পরিষদের অর্থাৎ সিদ্দিকুল্লাহ চৌধুরীদের পথ অবরোধ বিকেলে। ইস্যু নন্দীগ্রাম, রিজওয়ান, সাচার কমিটির রিপোর্ট, আমি। টেলিভিশনে দেখি আমার বাড়ি থেকে খুব বেশি দূরে নয় ধর্মান্ধগুলো আমার কুশ পুতুল পোড়াচ্ছে। উন্মত্ত ধর্মান্ধতা আমার বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে যেতে পারে, ভয় সত্যিই হল। সাদা পোশাকের যে পুলিশরা আগস্ট মাসের ন’তারিখ থেকে আমার বাড়ির সামনে ছিল, তারা তখন সবাই বসে আছে অফিসে। যে দিনটায় তাদের থাকার কথা সবচেয় জরুরি, সে দিনটাতেই ওরা নেই। আমি ওদের অনুরোধ করলাম আসতে। ওরা এলো। কিন্তু মিনিট পনেরো থেকে চলেও গেল। কুশ পুতুল পোড়ার আগুন নেভেনি তখনও।
একুশ তারিখে কিছু হওয়ার কথা ছিল না, কিন্তু হল। ভেবেছিলাম ইদ্রিস আলীর সংগঠন কী আর এমন করতে পারবে, যখন ১২টা সংগঠনই পনেরাই নভেম্বরে তেমন কিছু গন্ডগোল বাধাতে পারেনি। কিন্তু ২১ তারিখের ভয়াবহ কান্ড টেলিভিশনে দেখে স্তম্ভিত বসে রইলাম। স্তম্ভিত এইজন্য যে, এরা কারা, এরা তো আমার বই পড়ার ছেলে নয়, এরা আমাকে তাড়াতে চাইছে কেন, এদের তো ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগার কোনও কারণ নেই। দীর্ঘদিন থেকে এদের কি ব্রেইনওয়াশ চলেছে, নাকি কেউ লেলিয়ে দিয়েছে আজ? পেছনে কোনও চক্রান্ত নিশ্চয়ই কাজ করছে। ছেলেরা লুঙ্গি তুলে পুলিশদের পুরুষাঙ্গ দেখাচ্ছে। বিভিন্ন অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করছে। পুলিশ মারার পুলকে একেকজন দিশেহারা। এরা তো আমাকে চেনে না জানে না, কোনওদিন পড়েওনি আমাকে। শুধু কি আমাকে, এরা তো মনে হয় না এদের ধর্মগ্রন্থও কোনওদিন পড়ে দেখেছে! যেহেতু ওরা শুনেছে যে আমি ইসলাম বিরোধী, তাই আমি ইসলাম-বিরোধী, তাই আমাকে দেশ থেকে তাড়াতে হবে, এই দাবি নিয়ে কি পুলিশের দিকে ঢিল ছুড়ছিল, গাড়ি পোড়াচ্ছিল? এদের মুখ দেখে আমার মনে হচ্ছিল, পুলিশের ওপর এদের রাগও প্রচন্ড, রিজওয়ান হত্যার শোধ যেন নিচ্ছিল এরা। না, নন্দীগ্রাম নিয়ে এদের কোনও মাথাব্যথা ছিল বলে মনে হয় না। আমি হিম হয়ে যাচ্ছিলাম দেখে যে পুলিশ নীরব দর্শক হয়ে বসে আছে। পুলিশদের গুলি চালালো না, র্যাফ নামলো, র্যাফও চালালো না, সেনা নামানো হল, সেনাদেরও বলা আছে। গুলি যেন না ছোঁড়ে কারও দিকে। আমার ধারণা, উন্মত্ত ছেলেগুলো যদি আমার বাড়ির দিকে আসে আমাকে খুন করতে, পুলিশ, র্যাফ, সেনা এভাবেই নিশ্ৰুপ বসে থাকবে। নড়বে চড়বে না। ওদের বলে দেওয়া আছে মার খাওয়ার, মার না দেওয়ার।
একুশ তারিখ রাতে বাড়ি এলেন সন্দীপ ভুটোরিয়া। ভক্ত হিসেব দেখা সাক্ষাৎ করেন মাঝে মাঝে। একবার দরিদ্র শিশুদের সাহায্যের জন্য জয়পুরের একটা অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন, গিয়েছিলাম। রাজভবনে অনুষ্ঠান হয়েছিল। প্রতিভা পাটেল ছিলেন সভানেত্রী, আমি প্রধান অতিথি। সন্দীপের সেই ওই একই কথা। আপনি তো জানেন জয়পুরে আমি সব ব্যবস্থা করে রেখেছি, আপনি নামবেন জয়পুরে, সরকারকে ওখানে সব বলে রাখা আছে, আপনাকে প্রটেকশন দেবার সব ব্যবস্থা পাকা, আপনি কদিন একটু বেড়াতে যাবেন। খাবেন, দাবেন, ঘুরবেন, একটু বেড়িয়ে আসুন। এখানে যে কোনও মুহূর্তে এরা মেরে ফেলবে। এত বোকার মতো কাজ কেন করছেন। সন্দীপকে সোজা বলে দিই, স্পষ্ট বলে দিই, আমি যাবো না কোথাও।
পরদিন টিভিতে সকাল থেকেই দেখাচ্ছে পার্কসার্কাস মোড়ের লোকদের। কেউ কেউ বলছে, ‘আমি তসলিমাকে খুন করবো, এতে যদি আমার প্রাণ যায় যাবে। কী ভীষণ বর্বরতা আর হিংস্রতা কণ্ঠস্বরে ওদের। দুপুরে কথা হল বিনীত গোয়েলের সঙ্গে। কাল শুক্রবার নামাজের পর আমার বাড়িতে আক্রমণ হবে, খবর দিলেন। এরকম হলে চলে যাই সল্ট লেক বা বেলঘরিয়া, বা বেহালা বা গোলপার্ক, বা এরকম কোনও জায়গায়, আমি বললাম। না, ওসব জায়গায় সিকিউরিটি ছাড়া থাকতে হবে। সিকিউরিটি থাকলে তোক জেনে যাবে। সিকিউরিটি ছাড়া থাকা তো নিরাপদ নয়, ইন কেইস। না সে দায়িত্ব আমরা নিতে পারবো না। বিনীতবাবুর সাফ কথা, আমাকে বাঁচতে হলে জয়পুর যেতে হবে। তিনি সব ব্যবস্থা পাকা করে রেখেছেন। জয়পুর না গেলে বাঁচবো না, আমার জন্য বাঁচার কোনও রাস্তা খোলা নেই এই শহরে। আগামিকাল জুম্মার নামাজ, নামাজ শেষে মুসলমান মৌলবাদীরা, একুশ তারিখের বিজয়ী উন্মত্তরা বেরিয়ে পড়বে, গত চারমাস ধরে ভয় আর আতঙ্ক আমার ভেতর জোর জবরদস্তি করে ঢোকানোর চেষ্টা করে অবশেষে সফল হলেন বিনীতবাবু। আতঙ্ক আমার সর্বশরীরে, বেঁচে থাকতে হবে, লিখতে হবে, তাহলে দুদিনের জন্য যাই জয়পুর। তক্ষুনি একটা সাদা অ্যামবাসাডার পাঠালেন তিনি, যেন ঝড়ের মতো উড়ে এলো গাড়ি। কেবল ল্যাপটপটা নিলাম, আর কিছু নেওয়ার সময় হল না। পুলিশের লোকেরা হাতে টিকিট দিলেন বিমান বন্দরে। এভাবেই কলকাতা আমাকে গুডবাই জানালো। স্টালিন বুঝি এভাবেই মানুষকে গুলাগ পাঠাতো। স্টালিন তাদেরই পাঠাতো, যারা কট্টর স্টালিন বিরোধী ছিল। কিন্তু আমি তো বুদ্ধবিরোধী ছিলাম না।