এমন জীবনে হঠাৎ দেখি আমাকে বলা হচ্ছে ঘরের বাইরে আর বেরোনো চলবে না। কেন, বাইরে কী? নিরাপত্তা রক্ষীরা বলেন, ওপর থেকে অর্ডার পেয়েছেন ওরা, আমার বাইরে যাওয়া সম্পূর্ণই বন্ধ। রাস্তাঘাটে বাজার হাটে তো নয়ই, কারও বাড়িতেও নয়। নিভৃতে, কেউ জানবে না, তাও নয়। এমনকী দু’গাড়ি নিরাপত্তা রক্ষী নিয়েও বেরোনো যাবে না। পায়ে যে আসলে শেকল পরানো হচ্ছে, বুঝিনি। ভেবেছিলাম, সত্যি বুঝি ঘরের বাইরে আমাকে মেরে ফেলার ফাঁদ পাতা আছে। প্রসূন মুখার্জি যেদিন বাড়ি এসে দু’ঘণ্টা কথা বলেছেন, বুঝিয়েছেন, আমি বাইরে বেরোলেই আমাকে মেরে ফেলা হবে, উন্মত্ত ধর্মান্ধরা সব ধেয়ে আসবে আমার বাড়িতে আমাকে মেরে ফেলতে, এবং আমার জন্য কিছুতেই এই কলকাতায়, এই পশ্চিমবঙ্গে থাকা নিরাপদ নয়, আমি যেন চনে যাই, চলে যাই ইওরোপ আমেরিকায়, চলে যাই সিঙ্গাপুর থাইল্যান্ডে, চলে যাই কেরালা বা মধ্যপ্রদেশ, কোথাও, যেন কিছুতেই পশ্চিমবঙ্গে না থাকি, থাকলে রায়ট লেগে যাবে–সেদিনও বুঝিনি আসলে আতঙ্ক সৃষ্টি করে আমাকে দেশ থেকে বা রাজ্য থেকে বের করাই আসল উদ্দেশ্য। আমার নিরাপত্তার কথা ভেবে কিছুই করা হচ্ছে না। এরপরও প্রসূনবাবু ফোন করে করে চলে যাবার কথা বলতেন। হুমকির মতো শোনাতো তার কথা। শেষ ফোনটি যেদিন করেছিলেন আমাকে, নিজেই বললেন, সিএম বলেছেন আপনাকে অ্যাজ সুন অ্যাজ পসিবল চলে যেতে। উনি কেরালায় সব ঠিকঠাক করে ফেলেছেন। ওখানে সরকারের সঙ্গে কথাও হয়েছে সিএমের। ওখানে আপনাকে সিকিউরিটি দেওয়া হবে।
আমি, বিশ্বাস করুন বুদ্ধবাবু, বিশ্বাস করতে পারিনি আপনি প্রসূন মুখার্জিকে পাঠাতেন, আমাকে বুঝিয়ে, না বুঝলে ভয় দেখিয়ে, নানা কায়দায় আতংক সৃষ্টি করে, আমাকে দেশ ছাড়া, নয়তো রাজ্য ছাড়া করতে। আমি বলেছিলাম আমাকে যে এই পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য নিরাপত্তা দিতে পারছে না, আমাকে যে অন্য রাজ্যে চলে যেতে বলা হচ্ছে, মানুষ জানুক তা, কারণ কেরালায় গেলে ওখানেও তো হানা দিতে পারে আততায়ীরা। কী ভরসা আছে বাঁচবো আমি! আমি যে কেরালায় নিজের ইচ্ছেয় মরতে যাইনি, তা আমি তাহলে বলি সবাইকে। প্রসূন মুখার্জি বললেন, না, যেন গোপনে চলে যাই, যেন ঘুণাক্ষরেও কাউকে এসব না জানাই। শুধু প্রসূনবাবুকে দিয়ে নয়, আপনি আপনার দু’একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের দিয়েও, যাদের আমি শ্রদ্ধা করি, বলিয়েছেন চলে যেতে। অন্যায় করেছি আমি, আপনার আদেশ আমি মানিনি, আমি কলকাতা ছেড়ে কোথাও যাইনি। যাইনি কারণ আমি ভেবেছিলাম আপনি আমার নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত, তাই আমাকে চলে যেতে বলছেন। শহর শান্ত, নিরাপত্তার অভাব কী করে হবে, ভেবে পাইনি। তারপর তো শহর একদিন অশান্ত হল। অশান্ত হওয়ার কথা ছিল না, কিন্তু হল।
আপনি আমাকে কলকাতাতেই শাস্তি দিয়েছেন। ঘর থেকে এক পা বার হওয়াও নিষেধ আমার জন্য। পাগল হয়ে যেতাম। বিশ্বাস করুন বুদ্ধবাবু, আমি পাগল হয়ে যেতাম। ঠিক আমার জায়গায় নিজেকে ফেলে দেখেছেন কেমন লাগে? ধরুন আপনাকে যদি ওভাবে বন্দি করে রাখা হত, যে বন্ধুদের আপনি কাছে পেতে চাইতেন, দেখতেন তারা আর আসছে আপনার কাছে, কারণ আপনার দরজায় যে পুলিশেরা বসে, সেই পুলিশেরা যারাই আসতো আপনার সঙ্গে দেখা করতে তাদের নাম ঠিকানা লিখে রাখতো, কবে আবার কী না কী হয়, এই ভয়ে যদি বন্ধুদের আসা বন্ধ হয়ে যেত এবং আপনি একা বসে থাকতেন ঘরে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, কেমন লাগতো? আপনার নিশ্চয়ই শ্বাসকষ্ট হত। একটা ঘরের দরজা যখন বাইরে থেকে বন্ধ থাকে, এবং কোনও শক্তি থাকে না, উপায় থাকে নাসেই দরজা খোলার, তখন নিশ্চয়ই মৃত্যুময় নিস্তব্ধতা ঘিরে থাকে চারদিক, অসহায়তা আর হতাশা ডুবিয়ে নিতে থাকে অদ্ভুত অন্ধকারে। আমার জন্য খুব গোপনেও কি আপনার একবার দুঃখ হয়নি?
প্রসূনবাবু পুলিশ কমিশনারের পদ থেকে চলে যাবার পর আমাকে গৃহবন্দি করা, ভয় দেখানো, হুমকি দেওয়ার দায়িত্ব পড়লো নিরাপত্তা প্রধান বিনীত গোয়েল বাবুর ওপর। উনি প্রায়ই ফোন করতেন। কেরালা বা মধ্যপ্রদেশে বা বিদেশে অজানা কোথাও উনি আমাকে ফেলে দেননি। উনি প্রথম থেকেই বলেছেন জয়পুর যেতে। জয়পুরে আমার জন্য সব আয়োজন থাকবে, একটা চমৎকার রিসর্ট থাকবে, কুক থাকবে, আমি ওখানে দু’দিন যেন থেকে আসি, যাওয়ার ব্যবস্থা উনি নিজেই করবেন। কেন যাবো, কারণ এখানে এই কলকাতায় মুসলিম মৌলবাদীরা আমাকে মেরে ফেলবে। বাঁচার জন্য যেতে হবে জয়পুর। একে গৃহবন্দি, তার ওপর যারা আমার নিরাপত্তার ব্যবস্থা করছেন, তাঁরা বারবারই আমাকে জানাচ্ছেন যে আমি যদি সরকারের উপদেশ না মানি, নিজ দায়িত্বে কোথাও চলে যেতে পারি। জয়পুর কেন, পরে আমি বুঝতে পারলাম যখন সন্দীপ ভুটোরিয়া আমাকে ফোন করতে শুরু করলেন। বিনীত গোয়েলের হয়ে অতপর সন্দীপ ভুটোরিয়ার কাজ আমাকে বোঝানো, যেন জয়পুর চলে যাই। ওখানে থাকার সব বন্দোবস্ত তিনিই সব করে দেবেন। যেন একটুও দুশ্চিন্তা না করি। ক’দিন কাটিয়ে পরিস্থিতি একটু শান্ত হলেই ফিরে আসতে পারবো। প্রসূনবাবু আমার চেনা এমন কাউকে খুঁজে পাননি, যাকে বিশ্বাস করে অন্য রাজ্যে পাড়ি জমাতে পারি। বিনীত গোয়েল আগে লোক খুঁজেছেন, পেয়েছেন, তারপর আমাকে পার করতে নেমেছেন। অন্য রাজ্যে আমি কী করে যাবো, কোথায় থাকবো, নিরাপত্তার ব্যবস্থা কী, এসব ব্যাপারে নিশ্চয়তা দিতে বিনীত গোয়েল এবং তাঁর বন্ধু, আমার চেনা পরিচিত সন্দীপ ভুটোরিয়া লেগে রইলেন। আমি কী যে ভুল করছি, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পড়ে রয়েছি কলকাতায়। মাথায় এক ছটাক বুদ্ধি থাকলে, মোদ্দা কথা প্রাণে বাঁচতে চাইলে জয়পুরে চলে যেতাম, ক্রমাগতই বলে চলেছেন দুজন।