আমি কি অন্যায় কিছু করেছি? আমার কাছে অন্যায় বলে মনে না হলেও আজ অনেকের কাছে এটি ঘোরতর অন্যায়। আমি ভয়াবহ রকম অপরাধ করেছি গল্পটি বলে। অপরাধ করেছি বলে জনতার আদালতের কাঠগড়ায় আমাকে দাঁড়াতে হচ্ছে। অপরাধ হয়তো হতো না যদি না আমি প্রকাশ করতাম যে, যে-মেয়েটির গল্প আমি বলেছি সে মেয়েটি আমি, আমি তসলিমা। কল্পনায় আমি যথেচ্ছাচার করতে পারি, মিথ্যে মিথ্যে আমি লিখতে পারি কোনো সাধারণ মেয়ের আর দশটি মেয়ে থেকে ভিন্ন হওয়ার গল্প, ও না হয় ক্ষমা করে দেওয়া যায়। কিন্তু এই বাস্তব জগৎটিতে দাঁড়িয়ে রক্তমাংসের মেয়ে হয়ে কোন স্পর্ধায় আমি ঘোষণা করছি যে, ওই মেয়েটি আমি, আমি দুঃখ ঝেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছি, আমার যেমন ইচ্ছে তেমন করে নিজের জীবনটি যাপন করবো বলে পণ করেছি, আমার এই দুর্বিনীত আচরণ লোকে মানবে কেন! এরকম স্পর্ধা কোনো মেয়েকেই মানায় না। বড় বেমানান আমি পুরো পিতৃতান্ত্রিক পরিবেশে।
আমার প্রিয় দেশটিতে, প্রিয় পশ্চিমবঙ্গে আজ আমি একটি নিষিদ্ধ নাম, একটি নিষিদ্ধ মানুষ, একটি নিষিদ্ধ বই। আমাকে উচ্চারণ করা যাবে না, আমাকে ছোঁয়া যাবে না, আমাকে পড়া যাবে না। উচ্চারণ করলে জিভ নষ্ট হবে, চুলে হাত নোংরা হবে, পড়লে গা রি রি করবে।
এরকমই তো আমি। সে কি আজ থেকে!
‘দ্বিখণ্ডিত’ লেখার কারণে যদি সহস্র খণ্ড হতে হয় আমাকে, তবু আমি স্বীকার করতে চাই না যে আমি কোনো অপরাধ করেছি। আত্মজীবনী লেখা কি অপরাধ? জীবনের গভীর গোপন সত্যগুলো প্রকাশ করা কি অপরাধ? আত্মজীবনীর প্রধান শর্ত তো এই যে, জীবনের সব কিছু খুলে মেলে ধরবো, কোনো গোপন কথা কোনো কিছুর তলায় লুকিয়ে রাখবো না। যা-কিছু গোপন, যা-কিছু অজানা, তা বলার জন্যই তো আত্মজীবনী। এই শর্তটিই সতোর সঙ্গে পালন করতে চেষ্টা করেছি। আত্মজীবনীর প্রথম দুই খণ্ড ‘আমার মেয়েবেলা’ আর ‘উতল হাওয়া’ নিয়ে কোনোরকম বিতর্ক না হলেও তৃতীয় খণ্ডটি নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে বিতর্ক শুরু হয়েছে। এই বিতর্ক কিন্তু আমি সৃষ্টি করিনি, করেছে অন্যরা। বিতর্ক হওয়ার মতো উত্তেজক বিষয়, অনেকেই বলেছেন, আমি বেছে নিয়েছি। এই প্রশ্ন আর যখনইউঠুক, আত্মজীবনীর ক্ষেত্রে ওঠা উচিত নয়। কারণ সব রকম অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে আমার বড় হওয়া বা বেড়ে ওঠার ঘটনাগুলোই আমি বর্ণনা করেছি। আমার দর্শন অদর্শন, আমার হতাশা-আশা, আমার সুন্দর, আমার কুৎসিত, আমার শোক সুখ, আমার ক্রোধ আর কান্নাগুলোর কথাই বলেছি। কোনো স্পর্শকাতর বা উত্তেজক বিষয় শখ করে বেছে নিইনি, আমার জীবনটিই আমি বেছে নিয়েছি জীবনী লেখার জন্য। এই জীবনটা যদি স্পর্শকাতর আর উত্তেজক হয়, তবে এই জীবনের কথা লিখতে গিয়ে আমি অস্পর্শকাতর আর অনুত্তেজক বিষয় কোত্থেকে পাবো? বিতর্ক তৈরি করার জন্য বা চমক সৃষ্টি করার জন্য আমি নাকি বই লিখেছি। যেন বদ একটি কারণ থাকতেই হবে বই লেখার পিছনে। যেন সততা আর সরলতা কোনও কারণ হতে পারে না। যেন সাহস, যে-সাহসের প্রশংসা করা হত যে, আমি সাহস করে নাকি অনেক কিছুই বলি বাকরি, সেই সাহসটিও এখন আর কোনও কারণ হতে পারে না। আমার লেখা নিয়ে বিতর্ক নতুন কিছু নয়। লেখালেখির শুরু থেকেই তা হচ্ছে। এটিই কি মোদ্দা কথা নয় যে পুরুষতান্ত্রিক এই সমাজের সঙ্গে আপোস না করলেই বিতর্ক হয়।
আত্মজীবনীর সংজ্ঞা অনেকের কাছে অনেক রকম। বেশির ভাগ মানুষই সেই জীবনীকে গ্রহণ করতে অভ্যস্ত, যে জীবনীটি ভূরি ভূরি ভালো কথা আর চমৎকার সব আদর্শ উপস্থাপন করে। সাধারণত মনীষীরাই আত্মজীবনী লিখে যান অন্যকে নিজের জীবনাদর্শে আলোকিত করতে, সত্যের সন্ধান দিতে, পথ দেখাতে। আমি কোনও জ্ঞানী গুণী মানুষ নই, কোনও মনীষী নই, কোনও মহামানব নই, কিছু নই, অন্ধজনে আলো দেওয়ার মহান উদ্দেশ্য নিয়ে আমি জীবনী লিখছি না। আমি কেবল ক্ষুদ্র একটি মানুষের ক্ষতগুলো ক্ষোভগুলো খুলে দেখাচ্ছি।
কোনও বড় সাহিত্যিক বা বড় কোনো ব্যক্তিত্ব না হলেও এ কথা তো অস্বীকার করার উপায় নেই যে, খুব বড় বড় ঘটনা ঘটে গেছে আমার জীবনটিতে। আমার বিশ্বাস এবং আদর্শের কারণে লক্ষ লক্ষ মানুষ যদি পথে নামে আমার ফাঁসির দাবি নিয়ে, যদি ভিন্ন মতের কারণে একের পর এক আমার বই নিষিদ্ধ করা হয়, যদি সত্য কথা বলার অপরাধে একটি রাষ্ট্রযন্ত্র আমার নিজের দেশে বাস করার অধিকার হরণ করে নেয়, তবে নিশ্চয়ই জীবনটি একটি সাদামাটা জীবন নয়। এই জীবনের কাহিনী অন্যের মুখে নানা ঢঙে নানা রঙে প্রচারিত যখন হচ্ছেই, তখন আমি কেন দায়িত্ব নেব না জীবনের আদ্যোপান্ত বর্ণনা করতে। আমার এই জীবনটিকে আমি যত বেশি জানি, তত তোআর অন্য কেউ জানে না।
নিজেকে যদি উন্মুক্তনাকরি, নিজের সবটুকু যদি প্রকাশ না করি, বিশেষ করে জীবনের সেইসব কথা বা ঘটনা, যা আমাকে আলোড়িত করেছে, যদি প্রকাশ না করি নিজের ভালো মন্দ, দোষ গুণ, শুভ অশুভ, আনন্দ বেদনা, উদারতা ক্রুরতা, তবে আর যাই হোক সেটি আত্মজীবনী নয়, অন্তত আমার কাছে নয়। কেবল সাহিত্যের জন্যই সাহিত্যই আমার কাছে শেষ কথা নয়, সততা বলে একটি জিনিস আছে, সেটিকে আমি খুব মূল্য দিই।
যে-রকমই জীবন হোক আমার, যে-রকমই নিকৃষ্ট, যে-রকমই নিন্দা, নিজের জীবন কাহিনী লিখতে বসে আমি কিন্তু প্রতারণা করছি না নিজের সঙ্গে। পাঠক আমার গল্প শুনে আমাকে ঘৃণা করুক কী আমাকে ছুঁড়ে ফেলুক, এটুকুই আমার সন্তুষ্টি যে, আমার পাঠকের সঙ্গে আমি প্রতারণা করছি না। আত্মজীবনী নাম দিয়ে পাঠককে কোনো বানানো গল্প উপহার দিচ্ছি না। জীবনের সব সত্য, সত্য সবসময় শোভন বা সুন্দর না হলেও, সঙ্কোচহীন বলে যাচ্ছি। জীবনে যা কিছু ঘটে গেছে, তা তো ঘটেই গেছে, তা তো আমি বদলে দিতে পারবো না, আর অস্বীকারও করতে পারবো না এই বলে যে, যা ঘটেছে তা আসলে ঘটেনি। সুন্দরকে যেমন পারি, অসুন্দরকেও তেমন আমি স্বীকার করতে পারি।