কী অন্যায় করেছি আমি, আমার কী অপরাধের শাস্তি আপনি আমাকে দিলেন, খুব জানতে ইচ্ছে করে আমার। আপনার দলের পত্রিকা এবং বন্ধুর পত্রিকায় আমাকে বছরের পর বছর যা তা ভাষায় গালি দেওয়া হচ্ছে। আমার সম্পর্কে বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যে কথা লেখা হচ্ছে। দেখেও বছরের পর বছর মুখ বুজে থেকেছি। পথে প্রান্তরে সিঙ্গুর নিয়ে, নন্দীগ্রাম নিয়ে, রিজওয়ান নিয়ে মানুষ প্রতিবাদ করছে, কোনওদিনও কিছু বলতে পারিনি, লিখতে পারিনি। এদেশি লোক নই, এদেশি রাজনীতি নিয়ে আমার মুখ খোলা নাকি উচিত নয়। বন্ধুরা বলেছে, আমি পথে নামলেই আপনি আমার ওপর প্রতিশোধ নেবেন, পশ্চিমবঙ্গে আমাকে আর থাকতে দেবেন না। অন্যায়ের প্রতিবাদ না করা আমার স্বভাববিরুদ্ধ, তারপরও আমি নির্লজ্জের মতো মুখ বুজে থেকেছি। হাঁ, পশ্চিমবঙ্গে থাকাটা আমার জন্য ভীষণ জরুরি বলে মুখ বুজে থেকেছি। আজ যদি বাংলাদেশ আমাকে দেশান্তরী না করতো, বাংলাদেশে বাস করা আমার পক্ষে সম্ভব হত, তাহলে ওখানেই থাকতাম। এখানে বাস করতে চাইতাম না। এগারো বছর আমি ইওরোপের এক দেশ থেকে আরেক দেশে ঘুরেছি। কোথাও মন বসাতে পারিনি। কোনও দেশকেই নিজের দেশ বলে মনে হয়নি আমার। ওসব দেশে আমাকে যথেষ্ট সম্মান করা হয়েছে, বাক স্বাধীনতা নিয়ে কোনওদিন কোনও শর্ত দেওয়া হয়নি, আশ্রিত বলে আমাকে সংযত হয়ে কথা বলতে বলেনি কেউ, তারপরও আমি আমার নিজের দেশে চলে যেতে চেয়েছি, নিজের বাবা মা, ভাইবোনের কাছে ফিরতে চেয়েছি, বন্ধুদের কাছে ফিরতে চেয়েছি। নির্বাসন জীবন শুরুর পর ইওরোপে বসে বসে হতাশায় ভুগতে ভুগতে বাংলাদেশের দরজায় কড়া নেড়ে বিফল হয়ে ভারতের দরজায় কড়া নেড়েছি। ভারত খুলেছে দরজা, তবে ছ’ছটি বছর নিয়েছে দরজা খুলতে। অল্প যে-কদিনের জন্য অনুমতি দেওয়া হত ভারত ভ্রমণের, সে কদিনই এসে থেকে যেতাম পশ্চিমবঙ্গে। প্রাণ ভরে দেশের স্বাদ নিতাম। ওপার থেকে আত্মীয়স্বজন আসতো এপারে আমার সঙ্গে দেখা করতে। ভারতে বাস করার অনুমতি বছর তিন আগে মিলেছে, মেলার পর এক মুহূর্ত দেরি করিনি, থাকতে শুরু করেছি। পশ্চিমবঙ্গে বাস করা আমার কাছে পশ্চিমবঙ্গে বাস করা কখনও ছিল না।
বছর তিনেক কলকাতায় বাস করছি। কারও তো অনিষ্ট করিনি। নিজের ঘরে বসে নিজের লেখালেখি করি, কিছু বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে দেখা হয়, কথা হয়। কারও সাতে নেই, পাঁচে নেই। রাজনীতি বুঝিও না। রাজনীতি থেকে সহস্র মাইল দূরে থাকি। আমার শান্তশিষ্ট জীবন কার বাড়া ভাতে ছাই দিল? পশ্চিমবঙ্গের ঘরটি আমার কাছে শুধু ঘর ছিল না। ঘরের চেয়েও অনেক বড়। আমার নিজের যে একটি ঘর ছিল বাংলাদেশে, যে ঘরটি ছেড়ে আমাকে নির্বাসিত হতে হয়েছিল, সেই ঘরটি আমি প্রাণপণে ফিরে পেতে চেয়েছিলাম। অপেক্ষার প্রহর গেছে কেবল সেই স্বপ্নের কাছে যেতে। সেই ঘর, সেই স্বপ্ন, ভিন্ন ভাষা আর ভিন্ন সংস্কৃতির মধ্যে পাওয়া যায় না। সেই ঘরটি, নিজের সেই ঘরটি, আমার দীর্ঘ এগারো বছরের পথে পথে ঘোরার ক্লান্তির পর পেয়েছিলাম কলকাতায়, পশ্চিমবঙ্গে, আমার বাংলায়। বাংলাকে আমি কোনওদিনই ভাগ করে দেখিনি, তাই পেরেছিলাম অত দ্রুত পশ্চিমবঙ্গকে নিজের দেশ করে নিতে, কলকাতাকে নিজের শহর করে নিতে। পশ্চিমবঙ্গের ঘর শুধু ঘর ছিল না, বহুকালের হারানো স্বপ্ন ফিরে পাওয়া ছিল। নিজের যে ঘরটি যে স্বপ্নটি আমাকে ত্যাগ করতে হয়েছিলো, সে ঘরটি ফিরে পাওয়া, সেই স্বপ্নকে ফিরে পাওয়া, সেই নিশ্চিন্তিটি, আমার জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়া। দীর্ঘ বছরের সাধনার পর সাধের ধন ফিরে পাওয়া। আমার মা খুব চেয়েছিলেন দেশের মেয়ে দেশে ফিরে আসি। বিদেশে আমার বিষণ্ণ পড়ে থাকা দেখে তিনি কাঁদতেন। চেয়েছিলেন যে করেই হোক যেন নিজের বাড়িঘরে, নিজের আত্মীয় বন্ধুদের নিয়ে থাকি। মার সেই স্বপ্ন সফল হয়নি, শত চেষ্টা করেও আমি দেশে ফিরতে পারিনি। কিন্তু বেঁচে থাকলে মা নিশ্চয়ই অন্তত স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতেন এই ভেবে যে, অন্তত বাঙালির মধ্যে আছি, দেশ না হলেও দেশের মতো জায়গায় আছি।
নিশ্চিন্তে নির্বিয় ছিলাম কলকাতায়। হঠাৎ হায়দারাবাদে আমার ওপর মৌলবাদীদের আক্রমণ হল। সাধারণ মানুষ সহানুভূতি প্রকাশ করলো। না, বুদ্ধবাবু, আপনি ফিরেও তাকালেন না। আমি মার খাই, কী মরে যাই, তাতে আপনার কিছু যায় আসে না। একটিবার বললেন না হায়দারাবাদে যা হয়েছে, তা হওয়া উচিত হয়নি। না, বুদ্ধবাবু, হায়দারাবাদের অনুষ্ঠানে ধর্ম নিয়ে আমি একটি শব্দও উচ্চারণ করিনি। তারপরও অসভ্য ঘটনাটি ঘটেছে। ঘটিয়েছে মৌলবাদীরা। এই ঘটনার পর কোথায় আমি সহানুভূতি পাবো, তা নয়, এই আপনারই শহরে, ধর্মতলার মোড়ে আমার মাথার দাম ঘোষণা করলো ক’জন মৌলবাদী। না, তাদের কাউকে আইন অমান্যের দোষে গ্রেফতার করা হয়নি। ওরকম ফতোয়া পেয়ে আমার অভ্যেস আছে। জীবন তো আমার কখনও কোনওদিন মসৃণ ছিল না। সইতে হয়েছে মৌলবাদীদের অনেক হুমকি, অনেক ফতোয়া, অনেক নির্যাতন, অনেক নিষেধাজ্ঞা। জীবন আমার এরকমই। ফতোয়ায় ভয় পাইনি। আপনি অনুগ্রহ করে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছেন, তাই দুশ্চিন্তা কখনও ছিল না। আর, সত্যি কথা কী, আমার মনে হয়নি কলকাতায় আমাকে কেউ মেরে ফেলবে। নিরাপত্তা রক্ষীদের বিদেয় করে কত আমি গড়িয়াহাটে, যদুবাবুর বাজারে একা একা বাজার করেছি, ভিড়ের রাস্তায় একা একা হেঁটেছি। কই, কখনও তো কেউ মারতে আসেনি। যারা এসেছে, ভালোবেসে কাছে এসেছে।