তারপরও ওই নন্দনেই দু’একবার দেখা হয়েছে। আমজাদ আলী খানের সরোদ শুনতে গিয়েও একবার দেখা হল, সম্ভাষণ বিনিময় হল। শ্রদ্ধেয় আমজাদ আলী খান আপনাকে এবং আমাকে নমস্কার জানিয়ে বাজনা শুরু করলেন। তখন ২০০২ সাল, কলকাতায় পাকাঁপাকিভাবে বাস করার ইচ্ছে মনে, মনে আছে চারদিকে ফ্ল্যাট খুঁজে বেড়াচ্ছি কেনার জন্য। আপনি আমাকে সাহায্য করছিলেন একটা ফ্ল্যাট কিনতে। মন্ত্রী গৌতম দেবএর জন্য যে একটা ফ্ল্যাট বরাদ্দ ছিল উদিতায়, বলেছিলেন সেই ফ্ল্যাটটি আমার কিনে নিতে কোনও অসুবিধে নেই। আমি তৈরি ছিলাম। কাগজপত্র পাঠানো হয়েছে দিল্লি নাকি বোম্বেতে। রিজার্ভ ব্যাংক থেকে নাকি অনুমতি চলে আসছে। না, সেই অনুমতি অবশ্য আমার কোনওদিন পাওয়া হয়নি। কোনও কাগজপত্র ফেরত পাইনি। ফ্ল্যাট কেনাও হয়নি। কিছুই হয়নি। আপনার সঙ্গেও আর কোনও সৌজন্য সাক্ষাৎ হয়নি। সম্ভব হয়নি আপনার আর নাগাল পাওয়া। আপনার বন্ধুরা, যারা আমারও বন্ধু ছিল, হঠাৎ আমার পর হয়ে উঠলো।
মনে হচ্ছে এই সেদিনের কথা এসব। কী থেকে কী হয়ে গেল, অবিশ্বাস্য সব ওলোটপালোট।
আমি তখন হারভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে সেকুলারিজমের ওপর একটা ফেলোশিপ করছি। ওখানেই শুনি আপনি আমার দ্বিখন্ডিত বইটিকে নিষিদ্ধ করে দিয়েছেন। সত্যি, যেন আকাশ থেকে পড়লাম। এও কি সম্ভব? কলকাতার বন্ধুরা জানালো, সম্ভব। ছোটবেলা থেকে বামপন্থায় বিশ্বাস আমার। বামপন্থী রুশ লেখকদের লেখা পড়ে বড় হয়েছি। আমি তো ‘দ্বিখন্ডিত’তে মৌলবাদের বিরুদ্ধে আমার লড়াইএর কথা লিখেছি, নারীর স্বাধীনতা আর অধিকারের কথা লিখেছি, আমি তো সমতার কথা লিখেছি! কোথায় তবে বামপন্থার সঙ্গে সংঘাত হল আমার? আমি শুনলাম আপনি বলছেন, কয়েকজন বুদ্ধিজীবী আপনাকে বলেছেন বইটাকে নিষিদ্ধ করতে, এবং আপনিও একাধিকবার পড়ে দেখেছেন ওটা, ওটা নাকি নিষিদ্ধ হওয়ার মতোই বই। তাই কি? আপনি কি মন থেকে বলেছেন ওসব কথা, আপনি কি সত্যিই মনে করেন যে আমি যা লিখেছি, একটি শব্দ বা বাক্য ভুল লিখেছি? যদি মনে করেন লিখিনি, তবে কি আশংকা জন্মেছিল আপনার, যে, শহরে কোনও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লেগে যাবে বইয়ের কারণে? কোথাও তো দাঙ্গার আভাস মেলেনি। হাইকোর্ট বইটাকে মুক্ত করে দেওয়ার পর তো বই চলেছে মাসের পর মাস, বছরের পর বছর। কোথাও তো দাঙ্গা লাগেনি। কোনও একজন মুসলমানও তো আপত্তি করেনি। বইটি নিষিদ্ধ করার কারণ দেখাতে গিয়ে বলা হয়েছিল, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট হবে। দুটো সম্প্রদায়ে নাকি দাঙ্গা লাগবে। পরে হাইকোর্টে এই কারণটি উড়িয়ে দেওয়া হয় এই বলে যে, দুটো সম্প্রদায় এখানে জড়িত নয়। তখন নিষিদ্ধ করার পক্ষে আপনি নতুন কারণ দেখালেন যে, বইটি মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেবে। তিনজন বিচারক রায় দিলেন বইয়ের নিষেধাজ্ঞার বিপক্ষে। না, বুদ্ধবাবু, সবিনয়ে জানাই, রায় আমার দেওয়া নয়। নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে মামলাও, আমার নয়, কলকাতার একজন মানবাধিকার কর্মীর রুজু করা। আপনি আমার বই নিষিদ্ধ করেছেন, তারপরও আপনার প্রতি আমার শ্রদ্ধা কিছু কমেনি। চেষ্টা করেছি আপনার সঙ্গে দেখা করতে, সম্ভব হয়নি। আপনার কাছে পৌঁছোনোর সব দরজা জানালা আপনি বন্ধ করে রেখেছেন। আপনার যাঁরা কাছের মানুষ, যাঁদের সঙ্গে আমারও যোগাযোগ ছিল, তারাও দূরে সরে গেলেন হঠাৎ। তারপরও বিশ্বাস হারাইনি আপনার ওপর থেকে। ‘ভালো ছবি’ নামে একটা সিনে ক্লাব গড়ে তুলেছিলাম, ইচ্ছে ছিল বিদেশ থেকে সংগ্রহ করা আমার ভালো ভালো সব ছবি কলকাতার মানুষকে দেখাবো। নন্দনে দেখাতে পারবো, এরকম একটি আশ্বস অংশু সূরের কাছ থেকে পেয়ে পৃথিবীর প্রায় দু’হাজার শ্রেষ্ঠ ছবি যোগাড় করে দেখলাম, নন্দনে আমি নিষিদ্ধ। আমি বোকার হদ্দ, অনেক পরে ধীরে ধীরে বুঝেছি আমি মানুষটাই আসলে নিষিদ্ধ সব সরকারি জায়গায়। সরকার আয়োজিত কোনও উৎসব অনুষ্ঠানে যাওয়ার অধিকার আমার নেই, অংশ নেওয়ার তো প্রশ্ন ওঠে না। কী ভীষণ একা হয়ে গেলাম।
এত ঘৃণা কেন আমার প্রতি আপনার? আমি ইসলাম ধর্ম নিয়ে লিখেছি বলে? আপনি সত্যি করে বলুন তো আপনি ইসলাম ধর্মে বিশ্বাস করেন? ইসলাম গেল ইসলাম গেল বলে যারা চেঁচাচ্ছে, আমার মুন্ডু চাইছে, কুশপুত্তলিকা পোড়াচ্ছে, আমাকে রাজ্য থেকে তাড়িয়ে দেবার কথা বলছে, তাদের কি ভালো লোক বা সৎ লোক বলে আপনার মনে হয়? তাদের দাবিকে ন্যায্য দাবি বলে আপনি মনে করেন? যদি তা না মনে করেন, তা হলে বলছেন না কেন? হিন্দু মৌলবাদীরা অন্যায্য দাবি করলে, রামসেতু নিয়ে লাফালে আপনি তো পছন্দ করেন না। ওদের চেঁচামেচিকে নির্দ্বিধায় বলেন, ধর্মীয় উন্মাদনা। মুসলমান মৌলবাদীদের সামনে আপনি নাকি আমাকে ‘বাজে মহিলা’, ‘হরেবল উওম্যান’ বলেছেন, এবং আমাকে রাজ্য ছাড়া করবেন বলে ওদের কথা দিয়েছেন। বিশ্বাসে, আদর্শে, চেতনায় আমি তো ভেবেছিলাম আমি আপনার কাছের মানুষ, কিন্তু আশ্চর্য আপনি তাদের আপন মনে করেছেন, যারা সমাজটাকে অন্ধকারে ছুঁড়ে ফেলতে চায়, যে অন্ধকারে মেয়েরা নির্যাতিত হচ্ছে দিনের পর দিন, যেখানে সত্য এবং সাম্যের পক্ষে মুখ খোলা নিষেধ।