সারাদিন কিছু ফোন। পাটনা থেকে কেয়া। বীরভুম থেকে এনামুল। ২৪ পরগণা থেকে মোজাফফর। আর একটি চিঠি পেয়ে মন ভরে গেল আজ। পাচুর চিঠি। চিঠি বলতে ই মেইলকেই বুঝি। অনেকমাস ধরে যোগাযোগ নেই পাঁচর সঙ্গে। এমন ভালো বন্ধুর সঙ্গে যোগাযোগ না থাকার পিছনে কারণ ছিল, অভিমান। পাচু লিখেছে, ‘নিরাপদে আছিস এটা বুঝি। কিন্তু তোর মন যে একেবারে তছনছ, সেটা ভেবে বড় ব্যাকুল লাগে। আমাদের এই সময় কি তাহলে শাসিত হবে শুধুই ধর্ম, শুধুই মৌলবাদ, শুধুই ভোট কেন্দ্রিকতার যাঁতাকলে? কী ভয়ানক রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মুখোমুখি হয়ে তুমি তিনটি পাতা প্রত্যাহার করেছো বুঝে শরীর মন হিম হয়ে যায়। আশা রাখবো এই দুর্দিন আবার কাটবে, তুমি আবার ফিরে আসবে তোমাতে, আবার ঝলসাবে তোমার কলম অনির্বাণ! ভালো থাকিস। এই অবস্থায় যতটুকু ভালো থাকা যায়। উত্তরে আমি লিখলাম, ‘পাচু তোর চিঠি পেয়ে ভালো লাগলো এই অসহ্য কষ্টের মধ্যেও। জানি না কী করবো আমি। কলকাতা যেতে চাই। কিন্তু প্রগতিশীল কলকাতা তো আমাকে নিচ্ছে না। আমি একটা অন্ধকার ঘরে হতাশা আর অনিশ্চয়তায় ডুবে আছি। এরা হয়তো চাইছে মানসিক যন্ত্রণায় ভুগে একদিন আমি আত্মহত্যা করি নয়তো এদেশ ছেড়ে চলে যাই। উত্তর লিখলো পাচু। তসলিমা, কাকেই প্রগতিশীল কলকাতা বলিস জানি না। যে কলকাতায়, আমরা জানি, মৌলবাদকে নির্লজ্জ ব্যবহার করে লাল ঝান্ডাওলা একটি দল স্রেফ মুসলিম ভোটের কারণে যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে গর্জে উঠতে গিয়ে অন্য ঝাল্ডাধারীরা সুতীব্র ধিক্কারে এককাট্টা হয়ে গলা ফাটিয়ে সর্বব্যাপী আওয়াজ তুলতে পারে না–যারা বোঝে না কোন অসহনীয় রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মুখে অসহায় একজন লড়াকু লেখককে তার সাধের তিনটি পাতা ছিঁড়ে ফেলতে হয়–সেই কলকাতাকে তুই প্রগতিশীল কলকাতা বলবি? এই চরম অন্যায়ের শোধ তুই একদিন না একদিন নিতে পারবি। এত অন্ধকারেও আমি বিশ্বাস করি, মৌলবার শেষ কথা বলে না।
বলে না? বাংলাদেশে তো আজও মৌলবাদই শেষ কথা বলে তেরো বছর হয়ে, গেল, ফিরতে পারি না। আর কী কথা বাকি আছে বাংলাদেশের বলার? চুপ করে আছে পশ্চিমবঙ্গ, আর কী কথাই বা তার শেষ কথা। নীরবতা, প্রত্যাখ্যান, অবজ্ঞা, অপমান, মৌলবাদই তো শেষ কথা।
যেখানে আছি আমি, একটি ঘর, সামনে একচিলতে বারান্দা, বারান্দার লাগোয়া একটা ছাদ। ছাদে দাঁড়ালে বা হাঁটলে আবার কেউ না কেউ কোথাও থেকে দেখে ফেললে আবার কী না কী হয়, তাই ওদিকটায় যাই-ই না। যেন না যাই, আমাকে বলে দেওয়া হল। এ আর কী, ঘরবন্দি হয়ে থাকতে তো পারিই আমি। মাসের পর মাস তো কাটিয়েছি, দেশে, বিদেশে। নিরাপত্তার নামে যন্ত্রণা ভোগ কী কম করেছি। শেকল ভাঙার কথা বলতে গিয়ে নিজের পায়ে শেকল পরতে হয়েছে, সে কী আজ থেকে!
.
৮ ডিসেম্বর
‘I think the Taslima Nasreen case has tested, and will test, the integrity of the Left intelligentsia even more than Nandigram’–Ramachandra Guha.
৬ ডিসেম্বরে কলকাতায় বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পনেরো বছর উপলক্ষে একটা অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। তিনি বললেন, রাম হচ্ছে কবির কল্পনা। রামসেতুটা প্রাকৃতিক সেতু। রামসেতু নিয়ে যা হচ্ছে তা ধর্মীয় উন্মাদনা। টেলিভিশনে কাল এই খবরটি দেখে আমি তাজ্জব। কদিন আগে মুসলিম মৌলবাদীদের দাবি মেনে নিলেন, শহরে ওদের বর্বরতা আর উন্মাদনার বিরুদ্ধে একটা শব্দ খরচ করলেন না, বরং বললেন, কারওর অধিকার নেই ওদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার। আর এদিকে দোষীকে শাস্তি দেবার বদলে নির্দোষকে রাজ্যছাড়া করলেন, তারপর আজ কি না তিনি হিন্দুর ধর্মীয় অনুভূতিতে নিজেই আঘাত দিচ্ছেন।
.
৯ ডিসেম্বর ‘অধিকাংশের মতামতের সঙ্গে একমত না হওয়ার অধিকার চিন্তাশীল মানুষের প্রাথমিক, মৌলিক, সর্বশ্রেষ্ঠ অধিকার। এক লেখককে ‘তুমি এত দূর অবধি লিখতে পারো, কিন্তু তার বেশি এগোবে না’ বলা আর ‘তুমি কিছুই লিখবে না’ বলার মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই। কারণ আসলে বলা হচ্ছে ‘তুমি বাপু বাক পরাধীন, তবে আমার ন্যাজে পা না-দেওয়া অবধি বাকস্বাধীন’। এই থ্রেট-সহ ছাড় স্বাধীনতা নয়। খাঁচার মধ্যে পায়চারি করার অনুমতি।
বাক স্বাধীনতার কোনও চৌকাঠ হয় না। সীমা হয় না। কারণ তা হলে যে কোনও ক্ষমতাশীল গোষ্ঠী (রাষ্ট্র। মৌলবাদী/ফাটাকেষ্ট ও চ্যালারা) যখন খুশি ইচ্ছেমতো চৌকাঠ নির্মাণ করবে, এবং পৃথিবীর যে কোনও শিল্পকেই নিজের সুবিধেমত কারও না কারও ভাবাবেগ-আঘাতকারী হিসেবে চিহ্নিত করবে, তার পর গুলি’। –চন্দ্রিল ভট্টাচার্য
একটা চিঠি লিখলাম তাঁকে। চিঠি তাঁকে পাঠানো হয়তো সম্ভব নয়, তবু লিখতে ইচ্ছে হল একটি চিঠি
মাননীয় বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য,
আমার অশেষ শ্রদ্ধা জানবেন। আপনার সঙ্গে একসময় আমার আলাপছিল, বেশ কয়েকদিন কথাও হয়েছে। আপনাকে একজন আন্তরিক মানুষ হিসেবেই তো আমি জানতাম। মনে আছে নন্দনে বসে আপনি একবার আমার বম্বে হয়ে প্যারিস যাবার বদলে দিল্লি হয়ে প্যারিস যাওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন, কারণ বোম্বের মৌলবাদী মুসলিমরাবিক্ষোভ দেখাচ্ছিল আমার বোম্বে যাওয়ার বিরুদ্ধে, বিমানবন্দর নাকি জ্বালিয়ে দেবে, আমাকে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারবে। আমি আপনার প্রস্তাব মেনে নিচ্ছিলাম, কিন্তু শাবানা আজমি, জাভেদ আখতার, জাভেদ আনন্দ আর তিস্তা শীতলবাদীরা যখন বারবার আমাকে ফোন করছিলেন, বলছিলেন আমাকে যেতেই হবে বোম্বে, আমাকে বোঝাতেই হবে যে মৌলবাদীরা যা দাবি করে, তা হতে দেওয়া যায় না, বোম্বে যেতে হবেই, না যাওয়া মানে মৌলবাদীর কাছে নতি স্বীকার করা, না যাওয়া মানে তাদের অন্যায্য দাবি মেনে নিয়ে তাদের বিজয়ী করা। আমি আপনার উপদেশ মেনে চলছিলাম বলে তাঁরা আপনার শরণাপন্ন হলেন। আপনাকেই বোঝালেন কত যে জরুরি আমার বোম্বে যাওয়া। আপনি বুঝলেন এবং মেনে নিলেন আমার বোম্বে হয়ে প্যারিস যাওয়া।