.
৬ ডিসেম্বর
আজ বাবরি মসজিদ আক্রমণের পনেরো বছর পূর্তি। লজ্জা লিখেছিলাম পনেরো বছর আগে। দিন যে কীভাবে উড়ে যায়! মনে হয় এই সেদিন। ভালোবাসা জন্মেছিল ঠিক পনেরো বছর আগে, ৬ ডিসেম্বর তারিখে, ১৯৯২ সালে। আজ নাকি হরকাতুল জিহাদি দলের সদস্যরা একটা সাদা গাড়ি করে উত্তরপ্রদেশের দেওবন্দ থেকে দিল্লিতে ঢুকেছে, ইচ্ছে কিছু জনবহুল জায়গায় বোমা মেরে মানুষকে সন্ত্রস্ত করা। যদুর মনে পড়ে এই হরকাতুল জিহাদি দলটি বাংলাদেশে গড়ে উঠেছিল, আমার বিরুদ্ধে ধর্মবাদীদের আন্দোলন যখন তুঙ্গে, তখন। কী লাভ হচ্ছে তাদের মানুষ মেরে, আমি জানি না।
আজ প্রশান্ত রায়ের সঙ্গে কথা বললাম ফোনে সকালে, অনেকক্ষণ। উনি আশাবাদী কলকাতায় কিছু একটা আন্দোলন হবে আমার পক্ষে। আমি বললাম আন্দোলন হলে শুরুতেই হত। চোখের সামনে মানুষ দেখলো আমাকে কী করে বের করে দেওয়া হল পশ্চিমবঙ্গ থেকে। কী ভয়ংকর অন্যায়ভাবে বের করা হল। দিনের পর দিন মনের ওপর অত্যাচার চালিয়ে তারপর বের করলো। তারপরও কোনও একটি মিছিল বেরোলো না কলকাতার রাস্তায়! নিজেদের হাতে লেখা প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়াতে হল আমার চার পাঁচজন বন্ধুকে। কেউ নেই আমার জন্য? আমার জন্য কেউ না থাকুক, অন্তত বর্বর একটি ঘটনার বিরুদ্ধে কি কারও দাঁড়াবার নেই? হ্যাঁ কিছু লেখা হচ্ছে বটে এদিক ওদিক কিন্তু জনগণকে ততটুকু ক্ষুব্ধ করছে না, যতটুকু ক্ষুব্ধ হলে মিছিলে যেতে হয়।
পাগলের মতোকাঁদলাম। তপন রায় চৌধুরী ফোন করেছিলেন। বললাম যেন আমাকে কলকাতা নিয়ে যান। যদি কলকাতা না-ই যেতে পারি, যদি পশ্চিমবঙ্গ আমাকে না-ই নেয়, আমাকে যেন বাংলাদেশেই পাঠিয়ে দেয়। ওখানে হুজি ফুজিরা কখনও মেরে ফেলে রাখবে। তাই ভালো। তবু পরের দেশকে নিজের দেশ ভেবে ভুল যে করেছিলাম, মানুষকে ভালোবাসলেও মানুষ যে শেষ অবধি ভালোবাসে না, বরং দূরে বসে মজা দেখে, তা তো আর নিজের চোখে দেখতে হবে না।
আমার ছিঁড়ে যাচ্ছে মাথা। আর পারছি না সইতে। প্রভুকে বললাম, আমাকে বাংলাদেশে ফেলে আসুন। ওখানেই যা হবার হোক। প্রভু শুনলেন। কণ্ঠে তার আগ্রহ আরও কিছু শোনার। এরকম কিছু শোনার জন্য যেন অনেকদিন অপেক্ষা করছেন। মনে আছে প্রভুর মতোই আরও একজন সরকারি বড় অফিসার বলেছিলেন, রাজস্থান হাউজে বসে, আমি যেখানে নিরাপদ, সেখানেই থাকা উচিত আমার।
জিজ্ঞেস করেছিলাম, কোথায় নিরাপদ?
লোকটি বলেছিলেন, ‘পৃথিবীতে কি নিরাপদ জায়গার অভাব আছে?’
‘কোথায় সেই নিরাপদ জায়গা, শুনি!’
‘কেন, ইওরোপ বা আমেরিকা!’
‘না। আমি বিদেশ যাবো না।‘
কী রকম যেন ভয় লাগছিল আমার।
.
৭ ডিসেম্বর
সকালে কলকাতা থেকে শর্মিলা ফোনে শোনালো আজকের প্রতিদিনের উইকএন্ডে বের হওয়া জয় গোস্বামীর একটা লেখা। ‘কোনও লেখককে যদি তার কোনও লেখা প্রত্যাহার করে নিতে হয়, তখন কী অনুভূতি হয় তাঁর? কী অপরিসীম কষ্টের মধ্য দিয়ে তসলিমাকে যেতে হয়েছে এই প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিতে, তা, আমরা অনুমান মাত্র করতে পারি। কারণ, আমাদের কাউকেই নিজের দেশ থেকে নির্বাসিত অবস্থায় দিনের পর দিন, দেশের পর দেশে, নিরাপত্তা রক্ষী পরিবৃত হয়ে ঘুরে বেড়াতে হয়নি। আমাদের কারোরই নিজের দেশে ফেরার পথ বন্ধ নয়। আমাদের কারো বই বেরোনো মাত্র নিজের দেশে পর পর নিষিদ্ধ হয়ে আসছে না। আর আমরা কেউই জানি না, নিজের মাথার উপর মৃত্যুদণ্ডের ফতোয়া ঝুলে থাকলে কেমন লাগে।
আমরা শুধু তসলিমার সমালোচনা করতে পারি। এটা লেখা তসলিমার উচিত হয়নি। ওটা বলা তসলিমার ঠিক হল না। এমনকী, আমরা এতটাও বলেছি কখনো যে, এসবই তসলিমা প্রচার পাওয়ার জন্য করেছেন। হয়াঁ, নিজের জীবন শেষ হয়ে যেতে পারে কোনও উন্মাদ ধর্মান্ধ ঘাতকের হাতে এটা জানার পরেও হয়তো প্রচারের জন্যই করেছেন। এতটাও বলেছি আমরা।’
শুধু এটুকুই নয়, আমার অবস্থা বোঝাতে বোঝাতে গ্যালিলিওর প্রসঙ্গও এনেছেন জয়। গ্যালিলিকেও পুড়িয়ে মারার ভয় দেখানো হয়েছিল। অসম্ভব চাপের সামনে শেষ ম্যে ভেঙে পড়লেন গ্যালিলিও। প্রত্যাহার করে নিলেন নিজের মতবাদ। বললেন, ‘চার্চই ঠিক, সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘুরছে।‘ চোখ রাঙালে না হয় গ্যালিলিও বলে দিলেন পৃথিবী ঘুরছে না, পৃথিবী তবু ঘুরছে, ঘুরবেও যতই তাকে চোখ রাঙাও না।
শিবনারায়ণ রায়কে ফোন করেছিলাম, ওঁর শরীর মন কোনওটাই ভালো নেই। লিখতেও, বললেন, পারছেন না। বললাম ‘ব্লাড প্রেশার হয়তো খুব বেশি, ডাক্তার দেখান। নাহ, ডাক্তার দেখানোর খুব আগ্রহ নেই। বয়স বাড়লে, সবাই যেন কেমন কুঁকড়ে যান, ‘বেঁচে না থাকলেও চলে, অনেক তো হল’ ধরনের বাক্য আওড়ান।
বয়স ছিয়াশি। বললাম ‘জ্যোতিবাবুর বয়স তো পঁচানব্বই। আপনার চেয়ে তো অনেক বেশি বয়স।‘
কী অন্যায় করেছি যে আমাকে শাস্তি পেতে হবে? শিবনারায়ণ রায় বললেন, ‘কে বলেছে মানুষ শাস্তি পায় অন্যায় করলেই? তুমি একটা ক্ষমতাসীন শক্তির স্বার্থে আঘাত দিয়েছে, সে কারণে শাস্তি পাচ্ছো।
আজ ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’এ একটা লেখা পড়ে খুব ভালো লাগলো। মনের সঙ্গে মিলে যাওয়া কথা। সৌদি আরবের এক মেয়ে অপহরণ আর গণধর্ষণের শিকার। ইসলামের বিচারে ধর্ষকদের কোনও শাস্তি হল না। শাস্তি হল মেয়েটির। জেল হল। চাবুক হল। সুদানে এক ইস্কুল শিক্ষিকাকেও শাস্তি পেতে হল, কারণ পড়াতে গিয়ে টেডি বেয়ারের নাম রেখেছিল মুহম্মদ। এদিকে আমাকে পেতে হল শাস্তি। কবে কোন বইএ কী লিখেছি তা তাদের পছন্দ হয়নি বলে। তো ইসলামে নাকি বেশির ভাগ মুসলমানই অমৌলবাদী। ইসলামকে নাকি কিছু মৌলবাদীরা হাইজ্যাক করেছে। তাছাড়া ইসলাম খুব ভালো, ভালোর অন্ত নেই। লেখকের মতো আমারও প্রশ্ন, সেই মডারেটরা বা নরমপন্থীরা বা আধুনিক মুসলমানরা এখন কোথায়? তাঁরা মৌলবাদীদের কোনও দাঙ্গা হাঙ্গামা, কোনও শঠতা শয়তানি, কোনও ধর্ষণ লুঠের বিরুদ্ধে কিছু বলেন না তো, তাঁরা তো পথে নামেন না দল বেঁধে! অল্প কিছু মুসলমান এত বড় জঘন্য কান্ড ঘটাচ্ছে, আর বেশির ভাগই চুপ করে বসে দেখছে, তা কি হয়? মাঝে মাঝে আমার কিন্তু মনে হয় মডারেট’ বলে কিছু নেই। মুসলমান সমাজে দু’ধরনের মানুষ আছে, এক ইসলাম-বিশ্বাসী, আরেক ইসলামে অবিশ্বাসী। ইসলামে অবিশ্বাসীর সংখ্যা তুলনায় খুব কম, খুবই কম। বাদবাকি পুরোটাই ইসলাম-বিশ্বাসী। এই ইসলাম-বিশ্বাসীদের কেউ কেউ টুপি পরে, জোব্বা পরে, দাড়ি রাখে। কেউ কেউ এই পোশাকের বাইরে অন্য পোশাক পরে। বিশ্বাসীদের কেউ কেউ নামাজ রোজা ইত্যাদি করে, কেউ কেউ করে না। এই হল ঘটনা। বিশ্বাসীদের কেউ কেউ যখন মানবতার বিরুদ্ধে নামে, তার প্রতিবাদ বিশ্বাসীদের মধ্য থেকে আসে না। মডারেটদের তাই চোখে পড়ে না। মডারেট বা নরমপন্থী বলতে কিছু নেই বলেই চোখে পড়ে না।